ভারতবর্ষের হাজার হাজার বছরের রাষ্ট্রজীবন কেবল হিন্দুধর্মে নয়, ‘হিন্দুত্ব’-এও সম্পৃক্ত। হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুত্বের আন্তর্সম্পর্ক কী, রাষ্ট্রবোধে কোথায় হিন্দুত্বের শিকড় প্রোথিত আছে, তার বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে।
এ দেশে যারা অত্যাচারী, লুণ্ঠনকারী, তাদের মুখেও নামটি শোনা যেত ‘হিন্দুস্থান’। হতে পারে ব্যজস্তুতি, অথবা বিদ্বেষ। কিন্তু এদেশের আত্মায়, প্রাণভোমরায়, জীয়নকাঠিতে ধর্ম রয়েছে। সেটা হিন্দুধর্ম এবং সে ধর্মনদী পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়ে হাজার হাজার ক্রোশ অতিক্রম করে ফেলেছে, তাকে ফের পাহাড়ে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ‘The Hindu Monk of India’ নামে পরিচিত স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় আমরা তা খুঁজে পাই। ইদানীং ‘হিন্দুত্ব’ বলে যে শব্দটি প্রচলিত রয়েছে তার প্রথম ব্যবহার করেন ঊনবিংশ শতকের এক বাঙালি মনীষী, হুগলি নিবাসী চন্দ্রনাথ বসু। ভারত নামক একটি ভূখণ্ডে সনাতনী ধর্ম সংস্কৃতির আদর্শে ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় যে ন্যায় ও কর্তব্যের রূপরেখা, নীতিবোধ, নীতিমালা স্থির হতে থাকে এবং যা আবহমানকাল ধরে বয়ে চলে জীবনচর্যা ও মানসচর্চার মধ্যে এবং যা ভৌগোলিক, রাজনৈতিক গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে বৃহত্তর আত্মীয়সভার জন্ম দেয়, তারই নাম ‘হিন্দুত্ব’। ভারতে হিন্দুত্ব এবং রাষ্ট্রীয়ত্ব যেন DNA মলিকিউলের ডবল হেলিক্স স্ট্রাকচারের মতো; জড়ানো, এবং এই প্যাঁচ খোলা অসম্ভব।
‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি আম-জনতার মধ্যে, রোমে রোমে, শিরায় শিরায়, চেতন-কোষের অভ্যন্তরে প্রোথিত করে দিয়েছিলেন বীর সাভারকার, গত শতকের তিনদশকের শেষে। ভারতবর্ষে এমনই পূজার ঘরে প্রিয় ডাক্তারজী, প্রিয় গুরুজী এবং প্রমুখ রাষ্ট্রবাদী সন্ন্যাসীর ‘পৌরোহিত্য’ ছিল দেখবার মতো।
এককথায় বলা যায় ভারতবর্ষ নামক একটি মহাদেশে মহাভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার গভীরতর তত্ত্ব ও স্বরূপ হল ‘হিন্দুত্ব’। এটি একটি সাংস্কৃতিক ধারণা। তা অধ্যাত্মচেতন সম্ভূত, তা অর্থনৈতিক স্ব-এর দ্যোতক, তা কৃষিকৃষ্টির প্রবাহধারা। বর্তমান রাষ্ট্র-রাজনীতির যে কেন্দ্রবিন্দু, যে অন্দরমহল, যে অন্তরঙ্গতা তাও হিন্দুত্ব। বিগত শতাব্দীর তিন-এর দশক থেকে পাঁচের দশকের মধ্যে ভারতবর্ষের নানান উর্বর মনোভূমিতে এর বীজ বপন করতে লাগলেন সাভারকার থেকে শ্যামাজননীর মহাপ্রসাদ শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু আমরা কীভাবে পেলাম এই উত্তরাধিকার?
“ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী”। বন্দেমাতরম মন্ত্র থেকে পেলাম। দেবী দুর্গা, যিনি রাষ্ট্রদেবীর মধ্যে মিলেমিশে একাকার। যে ধ্বনি উচ্চারণ করে বিপ্লবীরা ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিতে পারতেন, তা তো এই মন্ত্র। বঙ্কিমী সাহিত্য-স্বরাজে দেখলাম অখণ্ড জাতির ভাবনা এবং অসুর বিনাশের যজ্ঞ।
শ্রীঅরবিন্দের ‘কারাকাহিনী’-তে কারাগারে কৃষ্ণ সান্নিধ্য অথবা সাভারকারের কারাজীবনের অনুভব — কোথায় যেন মিল! “আমি আর জেলের উচ্চ দেওয়ালের মধ্যে বন্দী নই, আমাকে ঘিরে রয়েছে বাসুদেব”, ১৯০৯ সালে উত্তরপাড়া অভিভাষণে অরবিন্দ বলবেন, সনাতন ধর্ম হচ্ছে জীবনই। “When it is said that India shall rise, it is the Sanatan Dharma that shall rise.”
কারাগারের মধ্যেই ধর্মের উজ্জীবন, উজ্জ্বল উদ্ধার; হিন্দুত্বের জোয়ার। সে কংসের কারাগার হোক, শ্রীঅরবিন্দের প্রেসিডেন্সী জেল, সাভারকারের সেলুলার জেল, কিংবা জরুরি অবস্থার সময় অজস্র স্বয়ংসেবকের কারারুদ্ধতা। কারাগারে বসেই হিন্দুত্বের জীবনচর্যায়, মানসচর্চায় রাষ্ট্রীয়ত্বের রোডম্যাপ আঁকা হতে থাকে। দেশমায়ের দুর্ভোগে, শৃঙ্খলে আমার বেদনার অনুভূতি যদি না জন্মায়, তবে কীসের রাজ্যপাট! ‘রামরাজ্য’ কথাটির মধ্যে কী অবতারত্ব, ধর্ম, রাজধর্মের সারাৎসার নেই!
‘বাঙ্গালীত্ব’ বলে যে কথাটি হয়, সেটাও রাষ্ট্রীয়ত্বেরই একটি প্রকাশ, হিন্দুত্বের বাইরে নয়।
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!”
বাংলার শক্তি সাধনার যে ধারা, যে বাংলা তন্ত্রের পীঠস্থান, যেখানে আদ্যাশক্তি লীলাময়ী, যেখানে ভগবান মাতৃরূপে সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যে প্রকাশিত, তারই আদলে দেশমাতৃকাকে দেখার চৈতন্য অর্জন করেছে দেশবাসী।
মাটি-ই মা, মাতৃকা আরাধনার চরম দার্শনিকতা ভারতমাতা। সে পূজার আয়োজন বঙ্গদর্শনের মধ্যেই ছিল! তবে কেন বাঙালি মহাভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবে?
ধর্মের জন্য এবং এই ধর্মের দ্বারাই ভারত বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে, এটা শ্রীঅরবিন্দের কথা। ধর্মটিকে বড় করে তোলার অর্থই হল দেশকেই বড় করে তোলা। ডি. এল. রায় বাঙালিকে শতাধিক বছর আগে শুনিয়ে গেছেন —
“ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে
গাও উচ্চে রণজয় গাথা।
রক্ষা করিতে পীরিত ধর্মে
শুন ঐ ডাকে ভারতমাতা।”
তবে এই মুহূর্তে বাঙালির কর্তব্য কী? দেবী দুর্গার পায়ে যেমন শতদল পদ্ম দিই আমরা, তেমনই ভোটের অর্ঘ্য হিসাবে ভারতমাতার পায়ে হৃদয়ের সহস্রদল পদ্ম অর্পণ করবো। বন্দী বঙ্গমাতাকে
ভারতমাতার সঙ্গে মিলিয়ে দেবো, স্বর্ণান্বেষী রথযাত্রায় রজ্জু টানবো বাঙালি। হিন্দুত্বই রাষ্ট্রীয়ত্ব। আবার বাঙালিত্বই হিন্দুত্ব। বাংলা ভাষায় কথা বললেই কেউ বাঙালি হয়ে যান না৷ হিন্দুত্বের শেকড়-সংস্কৃতি যদি কারো মধ্যে অভাব থাকে, তিনি দেখতে শুনতে বাঙালি হলেও তিনি বাঙালি নন।
ছবি : শীর্ষ আচার্য