ময়দানের ‘দুয়োরানি’ এ বার আইএসএলে! ভারতীয় ফুটবলের মূলস্রোতে ফিরে নতুন ভোরের খোঁজে মহমেডান

বছর চারেক আগের কথা। এটিকের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের পর আইএসএলে খেলা সবে নিশ্চিত করেছে মোহনবাগান। আওয়াজ উঠেছিল, মোহনবাগানের একা কেন? কলকাতার বাকি দুই প্রধান কী দোষ করল? এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় শ্রী সিমেন্ট স্পনসর হয় ইস্টবেঙ্গলের। তারাও আইএসএলে খেলা নিশ্চিত করে ফেলে। তখন আর কেউ ভাবেনি মহমেডান স্পোর্টিংয়ের কথা। কোনও স্বর ওঠেনি মহমেডানের হয়ে। কোনও স্পনসর এগিয়ে আসেনি। মহমেডান সমর্থকেরা শুধু নন, কলকাতা তথা দেশের ফুটবলপ্রেমীরা ধরেই নিয়েছিলেন, কলকাতায় আর তিন প্রধান নয়, দুই প্রধানই রয়েছে। রাতারাতি মহমেডান যেন হারিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় ফুটবলের মানচিত্র থেকে। তবে কোথাও, কোনও একটা কোণে স্বপ্ন তখনও বেঁচে ছিল। আই লিগ জিতে মহমেডানের আইএসএল খেলা নিশ্চিত করা সেই স্বপ্নেরই ফসল। এখন মহমেডানের সমর্থকেরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, তাঁরা কলকাতার একমাত্র ক্লাব, যাঁরা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ফি না দিয়ে যোগ্যতা অর্জন করে আইএসএলে খেলতে নামবেন।

মহমেডানের বর্তমান সাফল্য নিয়ে আলোচনা করার আগে এক বার অতীতটাও ফিরে দেখা প্রয়োজন। কলকাতা তথা দেশের ফুটবল মানচিত্রে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল দাপট দেখানো শুরু করার আগে সলতেয় আগুন দেওয়া শুরু করেছিল মহমেডানই। ১৯৩৪ সালে প্রথম স্বদেশি ক্লাব হিসাবে কলকাতা লিগ জেতা মাইলফলকের থেকে কম নয়। টানা পাঁচ বছর লিগ জিতেছিল তারা। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল মহমেডানের স্বর্ণযুগ। ক্লাবকর্তা সিএ আজিজের দূরদর্শিতায় মহমেডান দেশের অন্যতম সেরা ক্লাব হয়ে উঠেছিল। ভারতীয় ফুটবলারদের তিনিই বুট পরে খেলা শেখান। কালেহ খান এবং হাফিজ়‌ রহিদের মতো তরুণেরা দাপট দেখাচ্ছিলেন সে সময়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফুটবলার তুলে আনছিল তারা। তখন মহমেডান স্রেফ একটা ক্লাব নয়, একটা বিরাট অংশের ভারতীয় সম্প্রদায়ের পরিচিতি এবং লড়াইয়ের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলের ভূমিকা যতটা, মহমেডানের ভূমিকা তার থেকে কোনও অংশেই কম নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মহমেডানের অনেক খেলোয়াড় পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ায় দাপট কিছুটা খর্ব হয় ঠিকই। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলে নাম মুছে যায়নি।

মহমেডানের বিদেশি ফুটবলারদের উচ্ছ্বাস।

১৯৮১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত মহমেডানের যাত্রা ছিল উত্থান-পতনে ভরা। নব্বইয়ের দশকে মজিদ বাসকারের সময়ে তারা সাফল্যের শীর্ষে ছিল। মজিদের সঙ্গে জামশিদ নাসিরি, পরের দিকে চিমা এসেও সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও তখন দাপাচ্ছিল মহমেডান। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে সমস্যা পড়ে তারা। ক্লাবের কর্তাদের অভ্যন্তরীণ গন্ডগোল, বিনিয়োগকারী না আসা, লাভ কম হওয়া, ফুটবলারদের বেতন দিতে না পারা— ইত্যাদি বিবিধ কারণে মহমেডানের দাপট কমতে থাকে। কিন্তু বড় ট্রফি আসছিল না ক্লাবে। মাঝে এক বার ফেডারেশন কাপ, আইএফএ শিল্ড ছাড়া গর্ব করার মতো কিছুই ছিল না। এক সময় আই লিগ থেকেও হারিয়ে যায় মহমেডান। কলকাতা লিগেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেটাও কোনও মতে। ২০১৬-তে গজল উজ জাফর সচিব হয়ে আসার পর থেকে মহমেডানের পুনরুত্থান শুরু। কলকাতা লিগে রানার্স-আপ হওয়া, সিকিম গভর্নর্স গোল্ড কাপ জয়, বরদোলই ট্রফি জয়— মহমেডান আবার ফিরতে থাকে মূলস্রোতে।

সব শেষে, বাঙ্কারহিলের সঙ্গে মহমেডানের চুক্তি সব কিছু বদলে দেয়। সমর্থকেরা আবার নতুন ভোর দেখতে শুরু করেন। বাঙ্কারহিল কর্তা দীপক সিংহ একটা দূরদর্শী ভাবনা নিয়ে যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা আজ সফল। সাত বছর পর আই লিগে ফেরে মহমেডান। স্পেনের কোচ হোসে হেভিয়ার প্রশিক্ষণে প্রথমেই আহামরি ফলাফল আসেনি। কিন্তু পরের বছর আন্দ্রে চের্নিশভ এসে দলকে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে তোলেন। মহমেডান বুঝিয়ে দেয়, আবার তারা জাতীয় ফুটবলে ফিরে এসেছে। চার দশক পর কলকাতা লিগ জিতে ঘরোয়া ফুটবলেও দাপট শুরু হয়। তার পর টানা তিন বার কলকাতা লিগ জিতেছে তারা। মাঝে চের্নিশভ সরে গিয়েছিলেন। আবার কোচ হয়ে ফেরেন। কিন্তু জাতীয় স্তরে সাফল্য আসছিলই না। ২০২২ সালে কাছাকাছি এসেও লক্ষ্যপূরণ হয়নি। দ্বিতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু ফেডারেশনের নিয়ম মহমেডানে নতুন আশার আলো জাগায়। তারা ঘোষণা করে, আই লিগ জয়ীরা আইএসএলে খেলার সুযোগ পাবেন ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ফি ছাড়াই। এ বার যেমন খেলছে পঞ্জাব এফসি। নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে মহমেডান। সঠিক পরিকল্পনা, লক্ষ্য এবং দূরদর্শিতা নিয়ে পা ফেলেই আজ মহমেডানের আইএসএলে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে।

মহমেডানের কোচ আন্দ্রে চের্নিশভ।

ভুললে চলবে না, কিছু দিন আগে পর্যন্তও ভারতীয় ফুটবলে ‘দুয়োরানি’ ছিল মহমেডান। কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ ছিল কেবল ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানকে নিয়েই। আইএসএলে মোহনবাগান সাফল্য পেয়েছে। ইস্টবেঙ্গল ব্যর্থ হয়েছে। কেউ হেসেছেন। কেউ কেঁদেছেন। এর মাঝে মহমেডান বলেও যে আর এক প্রধানের অস্তিত্ব রয়েছে, সেটা ভুলতেই বসেছিল কলকাতা তথা দেশের ফুটবল। আই লিগে খেললেও নজরকাড়া পারফরম্যান্স দেখা যাচ্ছিল না। আর সেই অনুযোগ নেই। মহমেডান ফিরেছে। দাপটের সঙ্গে ফিরেছে। আর তাদের ‘দুয়োরানি’ বলে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না। আই লিগ জয়ের পর কর্তা থেকে সমর্থকদের উচ্ছ্বাস তারই ফসল।

তবে রাতারাতি এই উন্নতি সম্ভব হয়নি। ধৈর্য রাখতে হয়েছে। এই উন্নতির পিছনে ক্লাবকর্তারা তো বটেই, যাঁদের কথা ভুললে চলবে না, তাঁরা হলেন দীপেন্দু বিশ্বাস এবং কোচ চের্নিশভ। দীপেন্দু ক্লাবের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, ফুটবল সচিব, ম্যানেজারের মতো বিভিন্ন পদে বিভিন্ন সময়ে আসীন থেকেছেন। এই ক্লাবের হয়ে এক সময় মাঠে ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছেন। কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার তাগিদ ছিল তীব্র। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলে খেললেও তারা কোনও দিন দীপেন্দুকে সাহায্যের জন্য সে ভাবে ডাকেনি। মহমেডানে তাই নিজের পুরোটা দিয়েছেন দীপেন্দু। বেছে বেছে বিদেশি আনা থেকে শুরু করে স্বদেশি ফুটবলারদের সই করানো, সব দিকেই ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। মহমেডানে এ বার এমন ফুটবলারেরা খেলেছেন, এক বছর আগেও তাঁদের লোকে চিনত কি না সন্দেহ। এদি ফার্নান্দেস, এভজেনি কোজলভ, অ্যালেক্সিস গোমেজ কোথায় খেলেছেন কেউ জানেন? গোমেজকে আনা হয়েছে সুদেবা থেকে। মিরজালল কাসিমভ এসেছেন নেরোকা থেকে। এদি বটগাছের মতো সবাইকে আগলে রেখেছেন। আইজল, ট্রাউ, রাজস্থান ইউনাইটেড থেকে বেছে বেছে নিয়ে আসা হয়েছে ডেভিড লালানসাঙ্গা, বিকাশ সিংহ, লালরেমসাঙ্গা ফানাইয়ের মতো স্বদেশিদের। তাঁরা খেলতেন এই আই লিগেই। কে তাঁদের চিনত? আইএসএলের জাঁকজমকপূর্ণ বাজারে ক’জন দেখে আই লিগ? কোন চ্যানেলে হয় কেউ জানেন?

মহমেডানের ম্যানেজার দীপেন্দু বিশ্বাস।

দলের ফুটবলারদের প্রসঙ্গে কর্তা দীপক বলেছেন, “আমরা এমন একটা দল গড়ার কথা ভেবেছিলাম যেখানে প্রতিভাবান এবং দক্ষ ভারতীয় ফুটবলারেরা থাকবে। বিরাট বাজেট নিয়ে দল গড়তে নামিনি। ট্রান্সফার মার্কেটে টাকার বস্তা নিয়ে ঘুরিনি। দলের ভারসাম্য যাতে থাকে এবং রিজার্ভ বেঞ্চ শক্তিশালী হয় সেটাই চেষ্টা করেছি।” কৃতিত্ব নিতে রাজি নন দীপেন্দুও। এক সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেছেন, “এই জয় আমাদের সবার। ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে আরও বেশি। আমি এখানে চাকরি করি না। অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন নিজের ফুটবল অ্যাকাডেমি খুলে উপার্জনের। আমি স্রেফ ভালবাসার টানে এই ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। না থাকলে এই দিনটা উপভোগ করতে পারতাম না।” প্রাক্তন ফুটবলার সাব্বির আলি বলেছেন, “মহমেডানের সমর্থকেরাও এ বার বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন, আমরাও আইএসএলে খেলতে নামব। বাংলার ফুটবলের কাছে খুব ভাল দিন।”

তবে মহমেডানের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। বলা ভাল, শুরু হল। শূন্য থেকে শুরু করতে হবে এ বার। আইএসএল মানে বড় মাপের প্রতিযোগিতা। সেখানে খেলার মতো ফুটবলার এবং কোচও থাকতে হবে তাদের। তার জন্য সবার আগে দরকার বাজেট বাড়ানো। আপাতত মহমেডানের ১৫ কোটি টাকার মতো বাজেট। ক্লাব কর্তা ইস্তিয়াক আহমেদ ইঙ্গিত দিয়েছেন, পরের বছর বাজের দ্বিগুণ, অর্থাৎ ৩০ কোটি টাকা করা হতে পারে। দুবাইয়ের লুলু গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে বাঙ্কারহিল থাকছে। তারাই জানিয়েছে, আইএসএলের দলগুলির মতো পাল্লা দিয়ে শক্তিশালী দল তৈরি করতে বদ্ধপরিকর।

মহমেডানের ফুটবলারদের উচ্ছ্বাস।

মহমেডান সমর্থকেরা সব দেখেশুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। শনিবার ক্লাব তাঁবুতে বড়পর্দায় মহমেডান-লাজং ম্যাচ দেখতে হাজির হয়েছিল মেটিয়াবুরুজ থেকে আসা এক সমর্থক। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলেছেন, “মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের কী সমর্থক দেখছেন, আইএসএলে আমরা খেলতে নামলে যুবভারতী কানায় কানায় পূর্ণ থাকবে। সমর্থকেরা ঢেলে যাবেন খেলা দেখতে। অনেক দিন ধরে এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছি আমরা। আজ আমাদের আনন্দ করার দিন।” কোনও মতে কথাগুলো বলেই চলে গেলেন আতসবাজি ফাটাতে। কিছু ক্ষণ পরেই দারুণ গর্জন করে একটা আলোর ঝলকানি আকাশ রাঙিয়ে মিলিয়ে গেল। মহমেডান কিন্তু মিলিয়ে যেতে আসেনি। তারা এসেছে দাপট দেখাতেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.