নতুন প্রজন্ম মুখ ফেরাচ্ছে বহুরূপী শিল্প থেকে

‘মহারানি কটকটি গাড়ি চালায় ভটভটি…এই বুলি আওড়াতে আওড়াতে দৌড় লাগান অমৃতবাঁকে দাঁড়ানো বাসের দিকে। আজ যে তাঁকে যেতে হবে সাঁইথিয়ায়।ঠিক পেছনেই । তখন পাগলের সাজে গলা দিয়েবিকট আওয়াজ করতে করতে গ্রাম ছাড়েন উত্তম। তারপরেই সাইকেল চেপে‘ডাকাত সর্দার’নয়ন রওনা দেন কীর্ণাহারের দিকে। সাজ সেজে নিলেই যন্ত্রণা, কষ্ট দুর্দশা সব যেন নিমেষে উধাও এই সকল ‘বহুরূপী’দের জীবন থেকে। কারণ এখন তাদের লক্ষ্য একটাই, মানুষকে আনন্দ দেওয়া। বহুরূপী শিল্পীদের কথায়, মানুষকে আনন্দ দিয়েই তো ঢেকে রাখি আমাদের জীবনের যন্ত্রণা, শত কষ্টকে।
প্রতিদিন-ই নিত্যনতুন সাজ নিয়ে গ্রামবাঙ্গলার পাড়ায় পাড়ায়, শহরের আনাচে কানাচে দেখা মিলত বহুরূপীদের। যাদের অপেক্ষায় থাকত গ্রাম শহরের মানুষেরা। কিন্তু আগামীদিনে আর কি পাওয়া যাবে এই সকল শিল্পীদের দেখা? বহুরূপীদের গ্রাম বলে পরিচিত বীরভূমের লাভপুরের বিষয়পুরের ব্যাধ পাড়ার ‘বহুরূপীদের কথায় কিন্তু অশনি সংকেত। কারণ তারা আর চায় না যে পরবর্তী প্রজন্ম আর আসুক এই শিল্পে। কারণ তিন পুরুষ ধরে বহুরূপী শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এই সকল ব্যাধদের যন্ত্রণা, ‘তারা আজ আর শিল্পী নন। তাদের জীবন হয়ে উঠেছে ভীক্ষুকের জীবন।
সকাল ছ’টা বাজতে না বাজতেই বিষয়পুর গ্রামের অমৃতবাঁক মোড়ে এসে দাঁড়ায় বাস। ভোর রাতে উঠে দু-মুঠো পান্তা মুখে দিয়েই সীতারাম, সঞ্জিত, অশোক, বাবুরা লেগে পড়ে মুখে রং লাগাতে। এক এক দিন এক রকম রং। যে সাজের সঙ্গে যে রং মানায়। কোনোদিন রামচন্দ্র, মহাদেব, পাগলা খ্যাপা তো কোনোদিন। ডাকাত সর্দার তো কোনোদিন লালন ফকির। সাতসকালেই বাস ধরে জেলার এপ্রান্ত, এপাড়া থেকে ওপাড়া ঘুরে ঘুরেই তো এঁদের দিনগুজরান। গলা ছেড়ে নানা বুলি আওড়ে মানুষকে খুশি করাই তো এঁদের কাজ। বিনিময়ে যার কাছ থেকে যা মেলে তাই দিয়েই দিন গুজরান। কোনোদিন একশো, তো কোনোদিন দু-শো আবার কোনোদিন খালি হাতেই মনমরা হয়ে ফিরে আসতে হয় গাঁয়ে।
লাভপুরের চৌহাট্টা মোড় বাঁ-দিকে কয়েক কিলোমিটার গিয়েই হাতিয়া মোড়। সেখান থেকে পিচ রাস্তার ধরে এক কিলোমিটার গেলেই বিষয়পুর গ্রাম। যার পশ্চিম প্রান্তেই রয়েছে ‘ব্যাধ’-দের বাস। গত তিন পুরুষ ধরে তাদের পেশা-‘বহুরূপী। এখনও ৪০-৫০ ঘর রয়েছে যাদের দিন চলে সারাশরীরে রং মেখে, মোটা কাপড়ের রং বেরঙের তাপ্পি দেওয়া পোশাক পড়ে দিনভর ঘুরে ঘুরে নানা অভিনয় করে। যা দেখে আনন্দ নেয় সবাই।
ব্যাধপাড়ার পুকুড়পাড়ে দাঁড়াতেই এবাড়ি ওবাড়ি থেকে গুটি গুটি পায়ে জড়ো হয়ে যান। শিল্পীরা। তাদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গ্রামের প্রবীণ বহুরূপী শিল্পী আনন্দ চৌধুরী ব্যাধ। গত ৫৫ বছর ধরে রয়েছেন এই শিল্পে। একরাশ হতাশা তাঁর গলায়, কী পেলাম জীবনে। এখন তো শিল্পী বলেও মানে না। একটি শিল্পীর কার্ড পেয়েছি বটে। ঘরে টাঙিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।”
বীরভূমের লোক গবেষক ড. আদিত্য মুখোপাধ্যায় কথায়, তখন নবাবি আমল। মুর্শিদাবাদের ব্রজেশ্বর রায়ের হাত ধরে বীরভূমে বহুরূপী প্রচলন হলো। প্রবীণ শিল্পী আনন্দ চৌধুরী ব্যাধের পূর্বপুরুষ ফুলছড়ি ব্যাধের হাত ধরেই এলাকায় এই শিল্পের বিস্তার। তবে এখন নতুন প্রজন্ম এই শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যেটা সত্যিই খুব উদ্বেগের। ধরুন একজন শিব সেজেছে। তাকে হাত পেতে পেতে বা ঝোলা বাড়িয়ে পয়সা চাইতে হচ্ছে। প্রকারান্তরে ভিক্ষা চাওয়া। যানতুন প্রজন্ম মানতে চাইছেনা। ফলে তারা ছেড়ে দিচ্ছে এই শিল্প ধারা। আগামী দিনে হয়তো হারিয়েই যাবে।
গত তিন পুরুষ ধরে এই পেশায় রয়েছে। ব্যাধ সম্প্রদায়ের মানুষ। একশো বছরেও বেশি সময় অতিক্রান্ত এই পেশায়। আগে বনের ফুল তুলে বাজারে বিক্রি, বন্য পাখি শিকার করা। ধনেশ পাখির তেল বিক্রি করত। বনের কাঠ সংগ্রহ, জরি-বুটি বানিয়ে তা বিক্রি করাই ছিল এঁদের পেশা। পরবর্তী সময়ে বলিষ্ঠ চেহারার ব্যাধ সম্প্রদায়ের ডাক পড়ত জমিদার – জোতদারদের লেঠেলের কাজে। কারণ যোদ্ধা হিসাবে এঁদের সুনাম ছিল সেই সময়। তারপর ধীরে ধীরে তাদের প্রবেশ ঘটে বহুরূপীর শিল্পে। বিষয়পুরে ব্যাধদের বাড়ি উঠানে বসে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা জিজ্ঞাসা করতেই আক্ষেপের সঙ্গে রাজেন্দ্র চৌধুরী ব্যাধ জানান, “আর দিন চলে না। ভোর থেকে পায়ে হেঁটে দরজায় দরজায় ঘুরে কি পরিশ্রমটাই না হয়। সারাদিন। কোনোদিন খাবার জোটে তো জোটে না। দিনের শেষে উপার্জনের কোনো ঠিক থাকে না। হরেক রকমের রং, নানা ধরনের পোশাক কেনারও তো খরচা আছে। কিন্তু বহুরূপী সেজে হাত না পাতলে আর নিজে থেকে কেউ পয়সা দেয় না।”
সরকারি সাহায্য, শিল্প পরিচয়পত্রের কথা জিজ্ঞেস করলে রাজেন্দ্র আক্ষেপের সঙ্গে জানায়, আজও আমি শিল্পীর সরকারি পরিচয় পত্র পাইনি। ব্যাধ পাড়ার আক্ষেপ, বংশ পরম্পরায় যারা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তারা কার্ড পাচ্ছেন না। অথচ বহুরূপী শিল্পের কিছুই জানে না তারা সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন কার্ড। কারণ তাদের যোগাযোগ’ভালো। প্রবীণ আনন্দ চৌধুরী ব্যাধ বলেন, এই কারণেই ছেলে-মেয়েদের আর এই লাইনে আনব না বলেছে আমাদের ছেলেরা। পড়াশুনা যতদিন পারে করুক। অন্য জীবিকা খুঁজে নেবে।”
আনন্দের কথাতেই সায় দেয় সীতারাম, উত্তম, সঞ্জিত, অশোক বাবুরাও। তাদের অধিকাংশেরই অভিযোগ, “সরকার বলেছিল মাসে এক হাজার টাকা ভাতা ও সঙ্গে চারটে করে অনুষ্ঠানের সুযোগ দেবে। তাতে মাসে হাজার পাঁচেক টাকা হয়ে যাবে ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। কিন্তু কই!
এক সময় শুধু এই জেলা নয় রাজ্যের নানা প্রান্তে তো বটেই এমনকী ভিনরাজ্যে পরিবেশন করতে পেরেছি আমাদের শিল্পকে। আমাদের জীবন নিয়ে গবেষণা হয়েছে কিন্তু সেদিন আর নেই।” এই বলেই আনন্দ ব্যাধ গান ধরলেন— ‘ওই সেনাপতি বিটকেল, করে দিল খিটকেল।’
তিলক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.