রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ সংক্ষেপে আরসিইপি প্রসঙ্গ ইতিমধ্যে অনেকেই জেনেছেন। বুনিয়াদি হিসেবে দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়া, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চালাবার জন্যই ২০১২ সালে ইউপিএ-২-এর আমলে ভারত এই সংগঠনটির সদস্য হতে যায়। ২০১২ থেকে আজ অবধি এই আর সি ই পি-এর অন্তর্গত ১৬টি দেশ অর্থাৎ ১০টি Association of South East Asian Nation (Aseon Countries) 17 37625 রয়েছে কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া ফিলিপাইনস, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, মায়নামার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড। একই সঙ্গে জাপান, ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে ধরলে এই ১৬টি দেশ পরস্পরের সঙ্গে আরসিইপি আবদ্ধ হলে বিশ্বের মধ্যে তারাই বৃহত্তম সংগঠিত একটি ব্লক বলে গণ্য হতো।
২০১২ সালের আইএমএফ -এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী আরসিইপি-এর দখলে বিশ্বের ৪০ শতাংশ বাণিজ্য। চীন ভারতের মতো দেশ থাকায় জনসংখ্যায় যা ৪৫ শতাংশ। তাহলে হলো না কেন? এখানে মূল প্রশ্ন উঠবে দুটি—(১) ভারতীয় অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ার কারণ হয়ে উঠবে মূলত সস্তা দামের চীনা জিনিসের আরও ব্যাপক হারে বাজারে ঢুকে পড়া। দ্বিতীয়ত ভারতের যে নড়বড়ে ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পক্ষে তুলনামূলকভাবে। উৎপাদনশীলতার অযোগ্যতা। যেমন চীন বা জাপানে যে মালটা ১০ টাকায় তৈরি হচ্ছে একই পরিমাণ ফ্যাক্টরস অব প্রোডাকশন দিয়ে যেমন— ৪ টাকা মূলধন, ২ টাকা দোকান ভাড়া, ২ টাকা মজুরি, মালিকের ২ টাকা লাভ রেখে মোট ১০ টাকায় ১০টা দেশলাই বাক্স তৈরি হলো। প্রত্যেকটা ১ টাকায় বিক্রি করলেই Break even বা অর্থনৈতিকভাবে সাকার একটি প্রকল্প চলতে পারে। কিন্তু ভারতে একই পদ্ধতিতে ৭টি দেশলাই বেরোল। অর্থাৎ উৎপাদনশীলতায় খামতি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। যার ফলে ব্যবসা চালু রাখতে গেলে প্রতিটি দেশলাই অন্তত ১.৪৫ পয়সা করে বিক্রি করতে হবে।
আরসিইপি দেশগুলির মধ্যে রপ্তানির প্রতিযোগিতায় চীন বা বাংলাদেশ ১ টাকা বা ৯০ পয়সা দরে দেশলাই সরবরাহ করে ৫০০ কোটি টাকার দেশলাই সরবরাহের বরাতটা ধরে নেবে। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে উদাহরণ দিয়ে বলা যায় চীনের ভারতে রপ্তানি ৭০.৩ বিলিয়ন ডলার। ভারতের চীনে রপ্তানি ১৬.৮ বিলিয়ন ডলার। টাকার অঙ্কে বাণিজ্যের ঘাটতি ৫৪০০ কোটি ডলার। বাজারে লোকে বলে, এটা কি চীনের মাল নাকি? তাহলে তো দুদিন পরেই ফেলে দিতে হবে’ বলার পরও তাৎক্ষণিক দাম ভয়ংকর কম হওয়ায় কমদামি ইস্পাত, নানা ধরনের ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, এই দীপাবলীতে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের তরফে বারবার প্রচার সত্ত্বেও চোখ ধাঁধানো আলো অবলীলায় কিনে নিয়ে গেছে। নীচে ভারতের সঙ্গে ১০টি আসিয়ান দেশ-সহ মোট ১৬টি দেশের ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের প্রতিকুল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের খতিয়ান দেওয়া হলো।
এখানে FTA বা Free Trade Agreement-এর প্রসঙ্গ জরুরি। আগে বলা হয়েছে ১০টি এসিয়ান দেশের বাইরে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি ৬টি দেশের সঙ্গে আমাদের আলাদা চুক্তি মাধ্যমে আমদানি রপ্তানি চলছে। প্রতিটি দেশের সঙ্গেই আমাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত নেতিবাচক। এই দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে আমদানি শুল্ক উভয়দেশ পারস্পরিক ভাবে ঠিক করে। এখন RCEPএর ১৬টি দেশ পূর্ণ মুক্ত বাণিজ্য মারফত এই আমদানি শুল্কের হার কমিয়ে দিতে চাইছে। অর্থাৎ আমদানি শুল্ক ভারত নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট বস্তুর দাম এমন জায়গায় রাখার চেষ্টা করে যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন মার না খায়। অনেক সময়ই সক্ষম হয় না, ভারত যে Make in India’ প্রকল্পে হাত দিয়েছে তার মূল উদ্দেশ্যই তো রপ্তানি নির্ভর। ভারতের অভ্যন্তরে তো বিক্রি হবেই, ব্যাপক রপ্তানিও করতে হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন ‘manufacture, export or perish’. ( ট্রিলিয়নের অর্থনীতির লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে ব্যাপক উৎপাদন চাই। সেখানে যদি আরসিইপি-তে প্রস্তাবিত আমদানি শুল্ক আরও কমিয়ে দেওয়া হয় ফলে সস্তামালের অনুপ্রবেশ হয়— মেক ইন ইন্ডিয়া কিনবে কে। সারা দেশ ও বিদেশ নিয়ে আমূলের ৩৮ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে দুগ্ধজাত উৎপাদন প্লাবনের হারে চলে। তাদের ভারতে অবাধ গতি যদি রোখা না যায়। আমুলের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কত দূর সম্ভব হবে? দেশীয় গোয়ালারা কাদের দুধ বিক্রি করবে? এগুলি বড়ো মাথাব্যথা ও অর্থনীতির বিপদের কারণ হওয়ার ক্ষমতা ধরে। একই রকম পরিপ্রেক্ষিত কিন্তু WTOএর ক্ষেত্রেও। সেখানে অতি সম্প্রতি WTO-এর তরফে একটি মার্কিন দাবির যৌক্তিকতা মেনে রায় দেওয়া হয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত তার সংসস্থাগুলিকে যে সমস্ত ছাড় বা সুযোগ সুবিধে দিচ্ছে তা WTO চুক্তির বিরোধী। যেমন ধরুন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করতে পারলে সরকার উৎপাদককে কিছুটা এক্সপোর্ট ডিসকাউন্ট বা ভরতুকি দিয়ে দেবে। আগে এমন বহু শিল্পদ্যোগ খোলা হয়েছে যেগুলি কেবলমাত্র এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড। যার ফলে ব্যাপক ছাড়ের অধিকারী। পরিণতিতে তাদের দাম কমে যাচ্ছে ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাড়তি সুবিধে পাচ্ছে। এখানেই আপত্তি উঠেছে।
একটা জিনিস মাথায় রাখা দরকার, এই ধরনের বাদানুবাদ আপোস, মীমাংসা বিশ্ব বাণিজ্যে থাকবেই। কিন্তু রাগ করে পুরো জানালা কোনো দেশই বন্ধ করতে পারবে না। কালকেই দিল্লিতে পিঁয়াজ আবার ৯০ টাকা কিলো হয়েছে। সরকার কম দামে পিয়াজ আমদানির অর্ডার দিয়েছে।
RCEP থেকে বেরোলেও ভারতকে প্রথমেই ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে FTA নিয়ে প্রস্তাবিত আলোচনা দ্রুত শুরু করতে হবে। কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকলে যা বেড়ে চলেছে তা সামগ্রিক fiscal deposit-এর মাত্রা যা ৩.৩ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে ধরে রাখা যাবে না। অর্থবর্ষের প্রথম ৬ মাসেই তা লক্ষ্যমাত্রার ৭৮ শতাংশ ছুঁয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা অর্থনীতির সামগ্রিক দুর্বলতার সূচক। বাঁচার রাস্তা এখন একটাই, কেননা ভারতের পক্ষে RCEP-তে থাকা আর না থাকা বাস্তবে শাঁখের করাত। আমদানি শুল্ক কমাবো না বলে চলে এলাম। কিন্তু রপ্তানি তো করতেই হবে। আর আমদানি তো সব দেশের সঙ্গে বন্ধ রাখলে চলবে না। আমার আলপিন তৈরির খরচা ২ টাকা হলে আমদানি তো করতেই হবে। রাফেল বিমানের প্রযুক্তি কি আমার আছে? রাস্তাটা হচ্ছে দেশের উৎপাদনের উপাদানগুলির ব্যাপক কাঠামোগত সংস্কার (Stractural reform)। স্বস্তিকার পাতায় নীতি আয়োগের পূর্বর্তন অধিকর্তা অরবিন্দ পানাগাড়িয়া, সদানন্দ ধুমের মতো অর্থনীতিবিদ বারবার সেকথা লিখেছেন।
নিদেন হিসেবে খুব সংক্ষেপে সেগুলিকে আবার উল্লেখ করছি।
(১) সস্তা দরে মূলধন পেতে ব্যাঙ্কের সুদ ও হ্যাপা কমানো।
(২) শ্রম আইন সংশোধন করে গুজরাটের মতো পূর্বে চুক্তি সম্পাদন করে শ্রমিক নিয়োগ। যাতে যে কোনো দাবি দাওয়ায় কারখানা বা উৎপাদন যেন বন্ধ না হয়ে যায়। চাকরি থাকা বা না-থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার মালিকের।
(৩) জমি সংগ্রহের ব্যাপারে আইন সংশোধন। মান্দাসোরে সরকার বড়ো উদ্যোগের জন্য জমি নিতে গেলে বিরোধী আন্দোলন তা ভণ্ডুল করে দেয়।
(৪) ব্যবসা চালুর স্বাচ্ছ্যন্দের সূচিতে ভারত অনেকটা এগোলেও দূষণ ছাড়পত্র থেকে বর্জ্য নিকাশ ব্যবস্থা প্রভৃতি আরও বহু কিছুর অনুমোদন দিতে ১৮ মাসে বছর না হলেও ১৪ মাসে তো হচ্ছেই।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালে আরসিইপি-এর সমগোত্রীয় বৃহত্তর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সংগঠন WTOতৈরির সময় ভারতের মাথা পিছু আয় ছিল ৩৫০ ডলার, চীনের ৫৯২ ডলার। বলা হয়েছিল Both were called biggest beggers.”
আজ ২০১৯ সালে আমার সেই ভিখিরি ভাইয়ের মাথা পিছু আয় ৯০০০ ডলার ছুঁয়েছে। ভারতের ২০০০ ডলারের সবই কিন্তু রপ্তানি বাণিজ্য। চীন ডান্ডা ঘুরিয়ে, নির্যাতন করে স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে শিখর ছুয়েছে। ঠিক কথা। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভারতকে তো অর্ধেকটাও যেতে হবে। সে পথের পাথেয় নিজেকে সংস্কারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ক্ষুরধার করে তোলা। কেননা লক্ষ্য ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
2019-11-15