সত্য কথাটা সরাসরি বললে বলতে হয়, তাবৎ বিশ্বে কোনও দেশেরই আর্থিক অবস্থা এই মুহুর্তে এমন জোরালো নয় যে সে অপরের বাণিজ্য দরিয়ায় ঢুকে কাপ্তেনি করবে। এই অবস্থাতে একাধিক দেশ নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে যুথবদ্ধ হয়ে পরস্পরের বাজারে অবাধে ঢোকার ও বের হয়ে আসবার পুরানো যুক্তি আওড়াতেই পারে। জগৎসুদ্ধ সকল দেশ নয়, ওই যুথবদ্ধতা বহুলাংশে আঞ্চলিক এবং সেই ব্যবস্থাপনায় শেষাবধি দেখা যায় যে লাভের গুড় মুখ্যত একটি বা দুটি অথবা তিনটি দেশ রত্নখচিত পিপিলিকা হয়ে চেটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলি এমত বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর ক্রমে দেখা গেল যে ওই ব্যবস্থায় লাভবান না হয়ে কতিপয় দেশ বাণিজ্যিক তথা আর্থিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনায় কম-বেশি বিহুল।
চোখের সামনে এই রকম নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও ভারত সমেত ষোলোটি দেশ অনুরূপ একটি সঙ্ গড়ে তোলার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছিল। চুক্তিপত্রের বয়ান প্রস্তুত, এবার গঙ্গাবারিতে শুদ্ধ হয়ে তাতে স্বাক্ষর দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। সেই গোষ্ঠীবদ্ধ ‘প্রীতিময়’ মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির নাম Regional Comprehensive Economic Partnership। দেশের বিজেপি সরকার প্রথমে ভেবেছিল, এই ধরনের অবাধ বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট ১৬টি দেশের পক্ষেই স্বাস্থ্যকর হবে এবং আর্থিক উন্নয়ন গাঢ়তর হবে, বাড়বাড়ন্ত ঘটবে। কিন্তু পরিণতি যে বিপরীতমুখীই হতে পারে, ঝানু অর্থনীতিবিদরা তাদের বিশ্লেষণে সেই গুঢ়সম্ভাবনাকে সামনের দিকে টেনে আনলেন। দেশের স্বার্থরক্ষায় যারা সর্বাধিক সচেতন ও সক্রিয়, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ও এই চুক্তিকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবার পর সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে ওই প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির শামিল না হতে, যদিও ভারতই প্রথম দিকে খুব উৎসাহী ছিল ওই প্রচ্ছন্ন খতরনাক চুক্তির গুণাবলীকে ব্যাখ্যা করতে। অনেকে ঘূণাক্ষরেও টের পাননি, কী ধরনের গোয় পড়তে চলেছে দেশ। যেমন ধরুন, ওই প্রস্তাবিত চুক্তির দুই সম্ভাব্য শক্তিশালী দেশ হলো চীন ও ভারত। আমরা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে জানি, বহু দুর্জন কারবারি ভারত-চীন বর্ডার টপকে অনেককাল ধরেই তুলনায় অনেক সস্তা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিতান্ত পলকা চৈনিক দ্রব্যাদি ভারতের বাজারে ঢুকিয়ে এ দেশের বাণিজ্যিক ও আর্থিক বুনিয়াদের ক্ষতি করে চলেছে। অতঃপর ওই বেআইনি অনুপ্রবেশই নীতিসিদ্ধ আইন মোতাবেক কর্মকাণ্ড হয়ে দাঁড়াবে। ভারতের শিল্পসম্ভাবনা মার খাবে, যারা ছিল প্রকৃত দুর্জন, তারাই হয়ে উঠবে আদত নিয়ামক। উচ্চারণ করি সেই শাস্ত্রীয় বচন
দুর্জনং প্রথমে বন্দে, সুজনং তদন্তরম্।
মুখ প্রক্ষালং পূর্বে গুহা প্রক্ষলনং যথা।
চীনে শ্রমিকদের নির্বিচারে শোষণ করা হয়। প্রায় পেটচুক্তিতে তাদের কাজ করতে হয়। ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় চৈনিক দ্রব্যাদির উৎপাদন ব্যয় কথঞ্চিৎ। অন্যদিকে আমাদের দেশে সরকার শ্রমিক আন্দোলনকে সর্বদাই মান্যতা দেয়। শ্রমিকদের সাধ্যানুসারে বেতন বৃদ্ধি ঘটে। তাই জলের দরে উৎপাদিত বস্তুকে বাজারজাত করতে না পেরে ভারতের শিল্পোৎপাদনের পরিধি ও সম্ভাবনা নাগাড়ে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে চৈনিক দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করতে না পারায়। কৃষিক্ষেত্রেও বিপদ ঘনিয়ে আসবে। গম, আখ, যব, ধান, ফলফলাদি ইত্যাদির উৎপাদনে ব্রতী কৃষকরা উপযুক্ত বিক্রয়মূল্য না পেয়ে গ্রাম ছেড়ে আরও বেশি সংখ্যায় শহরের দিকে ছুটবেন। দেশে কর্মহীন ভিখিরিদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি বারোটা বাজিয়ে দেবে ভারতের ডেয়ারি শিল্পকে।
গত সাত বছর ধরে এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বিস্তর আলোচনা চললেও এমন কথা কখনও বলা হয়নি যে, কোনও দেশের অর্থনীতি এই চুক্তির ফলে ভেঙে পড়লে চুক্তিবদ্ধ অন্যান্য শরিকরা তাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে আসবে। তাই আসিয়ানভুক্ত দেশগুলি এখন চীনকে তোল্লা দিয়ে যতই চুক্তির গুণকীর্তন করুক, ভারত যেন চুক্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই মনস্থ করে। কংগ্রেস, বামপন্থী দলগুলি এই চুক্তির স্বপক্ষে অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলতে পারে জনসমক্ষে। কিন্তু তাদের যথার্থ হিসেবে আমরা সাব্যস্ত করতে পারি না। একেবারে হামলে না পড়লেও প্রথমাবস্থায়। যথেষ্ট পরিপাটি সহকারে বিজেপি সরকার এই চুক্তির অনুকূলে বাক্যজাল বিস্তার করছিল। আমাদের বিশেষ সৌভাগ্য যে আমাদের দেশের যিনি এই মুহূর্তে কর্ণধার, মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত বিবেচক। সমস্যার সৃষ্টিহলে যেমন তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন না বা ভুলভাল তথ্য সাজিয়ে নর্তনে রত থেকে মানুষকে। বল-ভরসা জোগাবার যৎপরনাস্তি নাটক করেন না, তেমনি অনেক ভাবনার অতলান্তে ডুব দিয়ে প্রকৃত সত্যকে টেনে আনতে জানেন। তিনি কতটা ডিপ্লোম্যাটিক, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ কম। জনগণের অগাধ আস্থা তার ওপর থাকায় হরেক কিসিমের প্যাচপয়জারের বাতাবরণ তৈরির দরকার এই দেশনায়কের এ যাবৎ হয়নি। তাই চুক্তিতে আগ্রহী বাকি ১৫টি দেশকে শেষাবধি তিনি জানিয়ে দিলেন, ‘অল্প তফাতে থেকেও আমাকে অনেক ভাবতে হয়েছে। আমার বিবেক এবং মহাত্মা গান্ধীর সত্যান্বেষণ কপালের জটিল ভাঁজগুলিকে মুছে দিয়েছে। ভারত সরকার সবদিক বিবেচনা করে প্রত্যাখ্যান করছে। প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে।
শেখর সেনগুপ্ত
(লেখক প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী)
2019-11-15