মেদিনীপুরে দিলীপ নন, তবে নতুন আসনেই রাজি, যেটা আনন্দবাজার অনলাইন লিখেছিল, তাঁর বদলে কে?

মেদিনীপুর আসনে ভোটের ফল কী হবে তার জন্য অপেক্ষা এখনও অনেক দিনের। কিন্তু নিজের আসনে দলীয় লড়াইয়ে ‘হেরে’ গেলেন দিলীপ ঘোষ। দল তাঁকে প্রার্থী করল না। তাঁর জায়গায় টিকিট পেলেন দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। দিলীপ প্রার্থী হলেন বর্ধমান-দুর্গাপুর আসন থেকে। গত লোকসভায় এই আসনে জিতেছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। তাঁকে এখনও পর্যন্ত কোনও আসনেই প্রার্থী করা হয়নি। ঠিক এমনটাই লিখেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। দিলীপ যে নতুন আসনে লড়তে রাজি হয়ে যাবেন, সেটাও লেখা হয়েছিল। এখন আসন বদলের পরে দিলীপ আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমি যেখানে যাই জেতার জন্যই যাই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হয়ে আমি ভোট চাইতে যাব। আর বিজেপির জেতা আসনে এ বার অনেক বেশি ব্যবধানে জিতব।’’ তাঁর আসনে অগ্নিমিত্রা প্রার্থী হওয়া নিয়ে দিলীপ বলেন, ‘‘মেদিনীপুরের মাটি তৈরিই রয়েছে। আমি সেটা করে রেখেছি। আর মানুষ ভোট দেবেন মোদীজিকে দেখে। আমি মনে করি শুধু লড়াই দেওয়া নয়, অগ্নিমিত্রার জয় নিশ্চিত।’’

রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি মেদিনীপুর আসন থেকেই ২০১৯ সালে জিতেছিলেন। নিজে জেতার সঙ্গে সঙ্গে আরও ১৭ আসনে জয় এসেছিল দিলীপের নেতৃত্বেই। এর পরে নিজের লোকসভা এলাকার মাটিকে আরও পোক্ত করার লড়াই চালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের আসনে টিকিট পাবেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠে যায়। গত তিন সপ্তাহ ধরে টান টান উত্তেজনা ছিল বিজেপির অন্দরে। চলে নানা নাটকীয় পট পরিবর্তন। পদ্মশিবির সূত্রেই জানা গিয়েছে, মেদিনীপুর আসনে দিলীপকে না দাঁড় করানো নিয়ে অনেক চাপানউতর চলে বিজেপির কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কমিটিতে। এর আগে এ নিয়ে বৈঠকে রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষে দুই মত ছিল। একটি অংশের দাবি ছিল, প্রাক্তন আইএএস ভারতী ঘোষকে প্রার্থী করা হোক। প্রসঙ্গত, এই এলাকায় নিজের কার্যকালে পুলিশকর্তা ছিলেন ভারতী। বিজেপি সূত্রে খবর, এই জেলায় থাকার সময়ের ভাবমূর্তি ভারতীর পক্ষে মেদিনীপুরে কাঁটা হতে পারে মনে করেই একটা সময় পর্যন্ত তাঁকে প্রার্থী করা হতে পারে বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু শেষ বেলায় পিছিয়ে আসেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে বিজেপির প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল ২ মার্চ। সেই শনিবার প্রকাশিত তালিকায় ২০ জন প্রার্থীর নাম থাকলেও একটি আসনের নাম না-থাকা নিয়েই বেশি আলোচনা শুরু হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জন বার্লাকে টিকিট দেওয়া হয়নি বা দার্জিলিঙের প্রার্থীর নাম তালিকায় কেন নেই, এ সব নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও সবচেয়ে বেশি আলোচনা ছিল দিলীপ এবং তাঁর আসন মেদিনীপুরকে নিয়েই।

রাজ্য বিজেপিতে অনেক দিন ধরেই কোণঠাসা দিলীপ। এমনকি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক রাজ্য সফরে চারটি জনসভার একটিতেও মঞ্চের ধারেকাছে দেখা যায়নি দিলীপকে। বারাসতে দর্শকাসনে থাকলেও তাঁর আসনের কাছেই আরামবাগে যখন মোদী সভা করেছেন, তখন দিলীপ নিজের আসনে জনসংযোগে ব্যস্ত ছিলেন। দলের রাজ্য নেতৃত্বের অস্বস্তি বাড়ানোর অভিযোগে দিলীপের ‘মুখ বন্ধ’ করার পদক্ষেপ আগেই করেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেই সময়ে রাজ্য বিজেপি দফতরে অনেককে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে যে, ‘‘এমনটা করতে থাকলে দিলীপদাকে হয়তো টিকিটই দিতে চাইবেন না কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।’’

BJP leader Dilip Ghosh is happy after party announces Agnimitra Pal will be the candidate of Midnapore in Lok Sabha Election election 2024

এমন জল্পনা বিজেপির কর্মীদের মধ্যেও চলে যায়। আর তার জেরেই প্রথম তালিকায় দিলীপের নাম না-থাকা নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। উত্তেজনা দেখা দেয় বিজেপি কর্মীদের মধ্যে। ৩২ বছর আরএসএস প্রচারক থাকার পরে রাজনীতিতে এসে ঝড়ের গতিতে এগিয়েছেন দিলীপ। প্রথমে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক, তার পরে দু’দফায় রাজ্য সভাপতি। এরই মধ্যে বিধায়ক এবং সাংসদ হয়েছেন। সর্বভারতীয় সহ-সভাপতিও হয়েছেন। কিন্তু কয়েক মাস আগে সব পদ গিয়ে দিলীপ শুধুই মেদিনীপুরের সাংসদ হয়ে যান। সেই সাংসদ পদের লড়াইতেও কি আর থাকবেন না? প্রশ্ন ওঠে বিজেপির চৌহদ্দি পার করে সঙ্ঘ পরিবারেও। কারণ, দিলীপই সরাসরি সঙ্ঘ পরিবার থেকে আসা বাংলার প্রথম সফল রাজনীতিক।

এর পরে অপেক্ষা ছিল দ্বিতীয় দফায় তালিকা প্রকাশিত হলে তাঁর নাম থাকে কি না, তা নিয়ে। সেই তালিকা প্রকাশ হলে দেখা যায় বাংলার কোনও আসন তাতে নেই। তত দিনে দিলীপের নামে নানা জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলতে শুরু করেন, মেদিনীপুরের জেতা আসন ছেড়ে ‘লড়াকু’ দিলীপকে কোনও ‘সম্ভাবনাময়’ আসনে পাঠানো হতে পারে। কৃষ্ণনগর থেকে দমদম নানা আসন নিয়েই জল্পনা তৈরি হয়। আবার অনেকে এমনটাও বলেন যে, ডায়মন্ডহারবারে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ‘জোশ’ আনতে সামনে রাখা হবে দিলীপকে। তবে এ সব জল্পনা নিয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বেশি জল্পনা ছড়িয়েছিল দিলীপকে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে প্রার্থী করার সম্ভাবনা নিয়েই। এর পিছনে কারণও রয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে খুবই কম ভোটে এই আসন থেকে জিতেছিলেন অহলুওয়ালিয়া। এ বার তাঁকে প্রার্থী করা হবে কি না, তা নিয়েও তৈরি হয় জল্পনা। ওই আসনের প্রার্থীর নামও প্রথম তালিকায় ছিল না। অনেক বলতে শুরু করেন, বর্ধমান-দুর্গাপুর থেকেই প্রার্থী করা হতে পারে দিলীপকে। গত ভোটে জয় মিললেও এখন কঠিন ওই আসনে জয় নিশ্চিত করতে দিলীপকে প্রার্থী করা হতে পারে।

বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, দিলীপকে মেদিনীপুরে প্রার্থী না-করার নেপথ্যে মূলত তিনটি যুক্তি ছিল। এক, কেন্দ্রীয় বিজেপির করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে মেদিনীপুর থেকে দিলীপের জয়ের সম্ভাবনা কম। দুই, গত বিধানসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পেয়েছিল বিজেপি। তার নেপথ্যে মূল কারণ ছিল, দিলীপের নানা মন্তব্য। একমাত্র জেতা আসন খড়্গপুর সদর আসনের বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দিলীপের সম্পর্কও ‘মধুর’ নয়। তিন, হিরণকে যে হেতু ঘাটাল লোকসভা আসনে প্রার্থী করা হয়েছে, তাই প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষকে মেদিনীপুর আসনে টিকিট দেওয়া উচিত। কারণ, গত লোকসভা ভোটে ঘাটাল থেকে লড়াই দেওয়া ভারতীর জায়গা নিয়ে নিয়েছেন হিরণ। তবে রাজ্য বিজেপির সেই রদবদলের অঙ্কে সায় দেননি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

বিজেপি সূত্রে এমনটাও জানা গিয়েছে যে, ভারতীর জায়গায় হিরণ এবং দিলীপের জায়গায় ভারতীকে দেওয়ার মত মূলত ছিল শুভেন্দুর। রাজ্য বিজেপিতে হিরণ এবং ভারতী শুভেন্দু শিবিরের বলেই পরিচিত। সেই সঙ্গে তৃণমূলের মহিলা প্রার্থী জুন মালিয়ার বিরুদ্ধে মহিলা প্রার্থী দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। তবে সুকান্তের নাকি দিলীপকে মেদিনীপুরে প্রার্থী করা নিয়ে কোনও আপত্তি ছিল না। তবে কেন্দ্রীয় বিজেপির করা সমীক্ষা নিয়ে তিনি যে চিন্তিত, সেটা জানিয়েছিলেন দিল্লির বৈঠকে। এখন অগ্নিমিত্রাকে প্রার্থী করায় মহিলার বিরুদ্ধে মহিলা প্রার্থীর যুক্তি প্রাধান্য পেল।

দিলীপকে নিজের আসন না-দিলে বিক্ষোভ, বিদ্রোহের সম্ভাবনাও থাকবে বলে মনে করা হয়েছিল। কারণ, দিলীপ তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে এমনটা আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন, তিনি শুধু মেদিনীপুর আসন পেলেই নির্বাচনে লড়বেন। নচেৎ, প্রার্থী না-হয়ে দলের কাজ করবেন। তবে পরে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষেও দিলীপকে বোঝানো হয় বলে জানা গিয়েছে। তার পরেই দিলীপ নতুন আসনে যেতে সম্মত হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.