লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের আগেই অধিকাংশ আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দেওয়া হবে বলে দাবি করেছিল বিজেপি। সে পর্ব শুরুও হয়েছিল। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। ২ এপ্রিল প্রথম তালিকায় দেশের ১৯৪টি আসনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ২০টি আসন ছিল। যদিও তার মধ্যে একটি আসনের প্রার্থী নিজের থেকেই সরে দাঁড়িয়েছেন। ফলে রাজ্যের ২৩টি আসনের প্রার্থীর নাম এখনও ঘোষণা বাকি। দ্বিতীয় দফায় ১৩ মার্চ দেশের ৭২টি আসনের প্রার্থিতালিকা প্রকাশ করা হলেও তাতে বাংলার একটি আসনও ছিল না। বৃহস্পতিবারের তৃতীয় তালিকাতেও বাংলা নেই!
বিজেপি সূত্রে যা জানা গিয়েছে, তাতে এখনও পর্যন্ত বাংলার কয়েকটি আসনের প্রার্থীর নাম নিয়ে দলের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। সম্প্রতি এ নিয়ে রাজ্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও করেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেই বৈঠকে কয়েকটি আসন নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় শেষ সিদ্ধান্ত তাঁরাই নেবেন বলে জানিয়ে দেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এখন যা জানা যাচ্ছে, তাতে সপ্তাহান্তে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি আরও কয়েকটি আসনে সিলমোহর দিতে পারে। তার পরেই ঘোষণা। এর আগে দু’টি তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির বৈঠকের পর দিন প্রার্থিতালিকা ঘোষণা হয়েছে। সেই হিসাবে তার পরে পরেই বাংলার বাকি ২৩ প্রার্থীর মধ্যে কয়েক জনের নাম জানা যেতে পারে। বিজেপি সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্ব চাইছেন প্রথম চারটি দফা নির্বাচনের প্রার্থীদের নাম আগে চূড়ান্ত করে ঘোষণা করে দিতে। বকি তিনটি দফার ঘোষণা পরে করা হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু অধিকারীকে দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের যাওয়ার কথা শনিবার দুপুরে। সন্ধ্যায় বা বেশি রাতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির নেতাদের সঙ্গে তাঁদের বৈঠক হতে পারে।
বিলম্বিত প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে বিজেপির মধ্যে জল্পনার শেষ নেই। বিজেপি নেতারাই রসিকতা করে বলছেন দলের নাম এখন ‘ভারতীয় জল্পনা পার্টি’। সব চেয়ে বেশি জল্পনা ২০১৯ সালে জেতা সেই আসনগুলি নিয়ে, যেগুলির প্রার্থীর নাম এখনও অঘোষিত। উত্তরবঙ্গে গত লোকসভা নির্বাচনে একটি ছাড়া সব আসনেই জয় পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু এ বার জেতা আসনের মধ্যে তিনটির প্রার্থীর নাম এখনও জানা যায়নি। দার্জিলিং আসন থেকে এ বার প্রাক্তন বিদেশসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে প্রার্থী করা হবে বলে অনেক দিন ধরেই জল্পনা রয়েছে। এমনও শোনা গিয়েছে যে, শ্রিংলা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পছন্দের প্রার্থী। তবে ওই আসনের বর্তমান সাসংদ রাজু বিস্তার কী হবে, তা নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি। রাজু ওই আসন ছাড়তে নারাজ। বিজেপি সূত্রে যা জানা গিয়েছে, তাতে রাজুকে সরতে হলে তিনি বাংলা নয়, নিজের রাজ্য মণিপুর থেকে প্রার্থী হতে পারেন। এই জটিলতায় তৃণমূল প্রার্থী গোপাল লামা প্রচার শুরু করে দিলেও এখনও পর্যন্ত হাত গুটিয়ে পদ্মের কর্মীরা। চুপচাপ জোটসঙ্গী বিমল গুরুংয়ের দলও।
গত বছর জলপাইগুড়ি আসন থেকে বিজেপির চিকিৎসক প্রার্থী জয়ন্তকুমার রায় ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছিলেন। তবে গত বিধানসভা নির্বাচনে ওই আসনের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে মাত্র তিনটিতে জয় পায় বিজেপি। এখনও পর্যন্ত এই আসনের প্রার্থীর নাম কেন ঘোষণা করা হয়নি, তা নিয়েও অনেক জল্পনা চলছে। পাশের আসন আলিপুরদুয়ারে গত বিধানসভায় সবক’টি আসনেই জিতেছিল বিজেপি। অথচ সেই আসনের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লাকে এ বার টিকিটই দেওয়া হয়নি।
বার্লাকে ঘিরে তেমন জল্পনা না থাকলেও তা রয়েছে রায়গঞ্জ আসন থেকে জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া দেবশ্রী চৌধুরীকে নিয়ে। গত বিধানসভার ফল এবং রায়গঞ্জের বিজেপি বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী তৃণমূলে চলে যাওয়ার পরে ওই আসন ‘কঠিন’ বিজেপির কাছে। সেই কৃষ্ণই দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে রায়গঞ্জে তৃণমূল প্রার্থী। ২০১৯ সালে সিপিএমের মহম্মদ সেলিম এবং কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সির মধ্যে ভোট কাটাকাটি হওয়ায় জয়ী দেবশ্রী আগে থেকেই আসন বদলের আর্জি জানিয়েছিলেন দলের কাছে। দাবি ছিল দমদম আসনের। কিন্তু বিজেপি সূত্রে যা জানা গিয়েছে, তাতে দমদম আসন থেকে প্রার্থী হতে পারেন তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া শীলভদ্র দত্ত। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেবশ্রীকে কলকাতা দক্ষিণে প্রার্থী করতে চাওয়ায় তিনি নাকি রায়গঞ্জেই দাঁড়াতে রাজি বলে জানিয়েছেন। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা রাজ্যের নেতারা কেউই ঠিক করে বলতে পারছেন না।
২০১৯ সালে জেতা দক্ষিণবঙ্গে পাঁচটি আসনের প্রার্থীর নামও ঘোষণা করেনি বিজেপি। এর মধ্যে আসানসোলে ভোজপুরি শিল্পী পবন সিংহের নাম ঘোষণা করা হলেও নিজের থেকে সরে গিয়েছেন তিনি। সেখানে স্থানীয় কাউকে টিকিট দেওয়া হতে পারে। মেদিনীপুর আসনে দিলীপ ঘোষ এবং ভারতী ঘোষের লড়াই নিয়েও নানা জল্পনা। শেষ পর্যন্ত দিলীপকে বর্ধমান দুর্গাপুর আসনে সরানোর সিদ্ধান্ত হলেও সেখানকার সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালাকে কোন আসন দেওয়া হবে, তা নিয়ে চলছে জলঘোলা। আরও এক জয়ী সাংসদকে প্রার্থী করতে চাইছে না বিজেপি। পদ্মশিবির সূত্রে জানা গিয়েছে, ঝাড়গ্রাম আসন থেকে সাংসদ কুনার হেমব্রমকে সরিয়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের চিকিৎসক প্রণব টুডুকে প্রার্থী করা হতে পারে। প্রার্থী হতে পারবেন না বুঝে রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণাও করে দিয়েছেন কুনার। এ ছাড়া রইল ব্যারাকপুর। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়ে ফিরে আসা অর্জুন সিংহকে প্রার্থী করা হবে কি না, তা নিয়ে দলের মধ্যে যতই বিতর্ক তৈরি হোক, সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আপাতত অর্জুনের দখলেই থাকছে রণক্ষেত্র ব্যারাকপুর।
বিজেপির অন্দরে যা আলোচনা, তাতে কলকাতা উত্তরের প্রার্থী তৃণমূল থেকে যাওয়া তাপস রায় হলেও কলকাতা দক্ষিণে এখনও নানা নাম নিয়ে জল্পনা। একই অবস্থা ডায়মন্ড হারবার নিয়েও। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কাকে প্রার্থী করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। দলের একটা অংশ চাইছেন ২০১৪ সালের প্রার্থী অভিজিৎ দাসকে আবার টিকিট দেওয়া হোক। বিজেপি যে আসনগুলি নতুন করে জিততে পারে বলে দলীয় নেতৃত্বের আশা, সেখানেও প্রার্থী হওয়া নিয়ে অনেক লড়াই। সেই তালিকায় রয়েছে আরামবাগ, শ্রীরামপুর, কৃষ্ণনগর, বারাসতের মতো আসন। শ্রীরামপুরে তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাক্তন জামাই কবীররঞ্জন বোসের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো। তবে বিজেপির জয়ের স্বপ্ন দেখা তমলুক আসনে প্রার্থীঘোষণা না হলেও প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে সিলমোহর পড়ে গিয়েছে। একই ভাবে বীরভূম আসনের প্রার্থী হিসাবে চূড়ান্ত হতে পারে বিজেপির আদি নেতা দুধকুমার মণ্ডলের নাম। বাংলায় বিজেপির শৈশব থেকে গত পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত যিনি জিতেছেন। তবে অন্য একটি মহলের বক্তব্য, বীরভূমে সদ্য পদত্যাগী প্রাক্তন আইপিএস দেবাশিস ধরকেও প্রার্থী করা হতে পারে।