লিয়োনেল মেসিকে যখন বার্সেলোনার ‘লা মাসিয়া’ অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন শুধু তাঁর খেলার দিকে নজর দেওয়া হয়নি। শারীরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা সব দিকে নজর ছিল। সেখান থেকেই বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হয়ে উঠেছেন তিনি। পরবর্তীতে যে ক্লাবেই তিনি খেলুন না কেন, লা মাসিয়া তাঁর মনেই থেকে গিয়েছে। সেই কাজটাই করার চেষ্টা করছে ‘ধানুকা ধুনসেরি সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি’ বা ডিডিএসপি। বাংলার টেবল টেনিসের ছবিটাই বদলে দিয়েছেন তাঁরা। শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় টেবল টেনিসেও কি এত বড় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে? শুধু পরিকাঠামো নয়, বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সব দিক থেকে সাহায্য করছে টেবল টেনিসের এই বিদ্যালয়। তাদের একটাই লক্ষ্য। অলিম্পিক্স পদক। সেই পথে কিছুটা হলেও এগিয়েছে তারা। এশিয়া স্তরে পদক এসেছে। অলিম্পিক্স পদকটাও তাড়াতাড়িই চলে আসবে, আশাবাদী সেখানকার কর্নধার চন্দ্র কুমার ধানুকা। অ্যাকাডেমির হাল-হকিকত ঘুরে দেখল আনন্দবাজার অনলাইন।
ADVERTISEMENT
কে এই চন্দ্র কুমার ধানুকা? তিনি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শিল্পপতি। মূলত চায়ের ব্যবসা। দার্জিলিং, অসম তো বটেই, দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার মালাউইতে চা বাগান রয়েছে তাঁর। অসমে ১৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয় প্রতি বছর। মালাউইতে প্রতি বছর ৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয় তাঁর কারখানায়। এ ছাড়া পেট্রোকেমিক্যাল কারখানাও রয়েছে তাঁর। পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া, হরিয়ানার পানিপথ ও মিশরে রয়েছে সেই সব কারখানা। ছোটবেলায় অবশ্য টেবল টেনিস নয়, টেনিস খেলতেন তিনি। পরে টেবল টেনিসে আগ্রহ বাড়ে। তিনি জানতেন, বাংলায় টেবল টেনিসে প্রতিভার অভাব নেই। শুধু দরকার ঠিক পথে তাদের নিয়ে যাওয়া। সেই কারণেই অ্যাকাডেমি তৈরি করার কথা ভাবেন। এ ভাবেই টেবল টেনিসের দুনিয়ায় পা পড়ে তাঁর।
২০১৯ সালে লাউডন স্ট্রিটে শুরু হয়েছিল ধানুকাদের প্রথম টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি। ভারতের দুই প্রাক্তন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সৌম্যদীপ রায় ও পৌলমী ঘটক তখন নিজেদের অ্যাকাডেমি চালান। কিন্তু তাঁরা চেষ্টা করছিলেন এমন একটি বড় অ্যাকাডেমি গড়ার যেখানে সব রকম সুযোগ সুবিধা থাকে। সেই সময়ই ধুনসেরি গ্রুপের সঙ্গে আলাপ সৌম্যদীপ-পৌলমীর। ২০২১ সাল থেকে ধুনসেরি গ্রুপের সঙ্গে জুড়ে যান তাঁরা। তৈরি হয় ‘ধানুকা ধুনসেরি সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি’। এই প্রসঙ্গে পৌলমী বললেন, ‘‘আমার আর সৌম্যদীপের স্বপ্ন ছিল একটা বড় অ্যাকাডেমি গড়া। যে সব সুযোগ সুবিধা আমরা ছোটবেলায় পাইনি সেটা পরের প্রজন্ম যাতে পায়। কিন্তু চাইলেই তো হবে না। বড় অ্যাকাডেমি করার খরচও অনেক। অনেক জায়গায় ঘুরেছি। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। সেই সময়ই ধানুকাজির সঙ্গে আলাপ। তার পর থেকেই এই অ্যাকাডেমির সঙ্গে আমরা যুক্ত। লাউডন স্ট্রিটে ধানুকাজির একটা অ্যাকাডেমি আছে। সৌম্যদীপের অ্যাকাডেমি যাদবপুরে। আমার রাজডাঙায়। এ ছাড়া রাজারহাটে একটা বড় অ্যাকাডেমি তৈরি হচ্ছে। সব অ্যাকাডেমিগুলো একটা ছাতার মধ্যে আনা হচ্ছে। রাজারহাটের অ্যাকাডেমি হবে প্রধান অ্যাকাডেমি। বাকিগুলো শহরের আলাদা আলাদা শাখা।”
এখন লাউডন স্ট্রিট ও রাজডাঙার অ্যাকাডেমিতে বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা শেখে। সংখ্যাটা কম নয়। দু’টি অ্যাকাডেমিতে প্রায় ২৫০ জন শেখে। যাদবপুরের অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন সেরারা। ঐহিকা মুখোপাধ্যায়, সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়, সিন্ড্রেলা দাসের মতো ৩০ জনকে বেছে নিয়ে সেখানে প্রশিক্ষণ দেন সৌম্যদীপ। তবে এখনও থাকার কোনও জায়গা করে উঠতে পারেননি তাঁরা। ফলে যাঁরা প্রশিক্ষণ নেন, তাঁদের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। নইলে অনেক দূর থেকে প্রতি দিন আসতে হয়। সেই সমস্যা যাতে আর ছাত্র-ছাত্রীদের না হয়, সেই চেষ্টা করছে ডিডিএসপি। তাই রাজডাঙায় নতুন অ্যাকাডেমি তৈরি করা হচ্ছে। এখন তিনটি অ্যাকাডেমিতে পাঁচটি করে টেবল রয়েছে। অন্যান্য অ্যাকাডেমিতেও এই ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। ছেলে-মেয়েরা যাতে আন্তর্জাতিক স্তরে আরও সফল হয় তার জন্যই আরও বড় পরিকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে।
রাজারহাটের কী কী থাকছে? ৪৫,০০০ বর্গফুটের অ্যাকাডেমিতে ৩২টি টেবল থাকবে। এখন ভারতের কোনও অ্যাকাডেমিতে এত টেবল নেই। ৪০ জনের থাকার ব্যবস্থা থাকবে। তাঁরা সেখানে থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা আলমারি থাকবে। শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য থাকবে জিম। থাকবে ক্যাফেটেরিয়া। এক্সারসাইজের জন্য আলাদা জায়গা থাকবে। খেলায় একটি বড় বিষয় ডায়েট। ফিটনেসের চূড়ায় থাকতে কী ধরনের খাবার খেতে হবে তা দেখার জন্য থাকবেন পুষ্টিবিদ। এ ছাড়া ফিজিক্যাল ট্রেনার, মেন্টাল ট্রেনার ও চিকিৎসক থাকবেন সেখানে। দেশ ও বিদেশ থেকে আরও বেশি কোচ নিয়োগ করা হবে। অর্থাৎ, এক জন খেলোয়াড়কে আন্তর্জাতিক স্তরে সফল করার জন্য যা যা দরকার সব থাকছে ওই অ্যাকাডেমিতে। বেশির ভাগ কাজ হয়ে গেলেও এখনও কিছু কাজ বাকি থাকায় অ্যাকাডেমি শুরু হয়নি। তবে খুব তাড়াতাড়ি সেটা হয়ে যাবে।
কিন্তু কেন এত বড় অ্যাকাডেমি তৈরি করছে ধুনসেরি গ্রুপ? তার একটা বড় কারণ টেবল টেনিসে বিবর্তন। খেলাটা অনেক বদলে গিয়েছে। আগে যে ভাবে সবাই প্রশিক্ষণ নিতেন সে ভাবে এখন নিলে চলবে না, এমনটাই মনে করেন পৌলমী। তিনি বললেন, ‘‘আগে আমরা জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পরে বিদেশে খেলতে যেতাম। সেই প্রতিযোগিতার পয়েন্ট যোগ হত। এখন সবটা বদলে গিয়েছে। এখন সারা বছর দেশে-বিদেশে প্রতিযোগিতা হচ্ছে। সেখানে না খেললে পয়েন্ট কমে যাবে। তাই সারা বছর সবাইকে খেলতে হচ্ছে। সে ভাবে নিজেদের তৈরি করতে হচ্ছে।” এই ভাবে সারা বছর খেলার জন্য দরকার অর্থ। যেটা সবাই দিতে পারে না। এখন অনেক মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে আসছে। তারা হয়তো ভাল খেলছে, কিন্তু জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে জিততে যে সাহায্য দরকার তা পাচ্ছে না। সেই কাজটাই করছে এই অ্যাকাডেমি।
তারই ফসল ঐহিকা, সুতীর্থা, সিন্ড্রেলারা। ঐহিকা-সুতীর্থা ভারতের প্রথম মহিলা জুটি হিসাবে চিনে গিয়ে বিশ্বের এক নম্বর চিনা জুটিকে হারিয়ে এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছেন। পরে বিশ্বের এক নম্বরকে সিঙ্গলসে হারিয়েছেন ঐহিকা। সিন্ড্রেলা ভারতের অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৭ স্তরে এক নম্বর হয়েছে। বিদেশে গিয়ে সাফল্য পাচ্ছে। পৌলমীর কথায়, “এখন ভারতীয় টেবল টেনিসের সোনার সময়। সাইনা (নেহওয়াল) আন্তর্জাতিক স্তরে পদক জিততে শুরু করার পরে ব্যাডমিন্টনকে যেমন পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, এখন টেবল টেনিসেও তাই। পাঁচ বছর আগে আমরা ভাবতে পারতাম এ ভাবে চিনে গিয়ে বিশ্বের ১ নম্বরকে কেউ হারাতে পারবে। তা-ও সেটা এক বার নয়, বার বার। ছোটদের প্রজন্ম আরও ভাল। ওদের তৈরি করতে হবে। সেই কাজটাই ধানুকাজি করছেন। উনি প্রত্যেককে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন। বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটান। কেউ পদক জিতলে তার সঙ্গে কথা বলেন।”
অ্যাকাডেমির কথা বার বার শোনা গিয়েছে ঐহিকাদের মুখেও। বিশ্বের এক নম্বরকে হারানো ও অর্জুন সম্মান পাওয়ার সুবাদে লাউডন স্ট্রিটের অ্যাকাডেমিতে ঐহিকাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন ধানুকা। সেখানে ঐহিকা জানিয়েছিলেন, তাঁর এই সাফল্যের নেপথ্যে এই অ্যাকাডেমির কতটা গুরুত্ব রয়েছে। কী ভাবে তাঁকে প্রশিক্ষণের সব রকম ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। কী ভাবে তাঁকে নিয়ে সৌম্যদীপ পড়ে থেকেছেন। পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। তার ফলেই সাফল্য এসেছে। ঐহিকা, সুতীর্থাদের সামনে তখন বসে অ্যাকাডেমির ছোটরা। বয়স অল্প হলেও তাদের কথায় ধরা পড়ছিল আত্মবিশ্বাস। আগামী দিনে ভাল করার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসকে বাস্তবে পরিণত করার কাজ করে চলেছে এই অ্যাকাডেমি।
ভারতে ক্রিকেট বা ফুটবলের বড় অ্যাকাডেমি থাকলেও টেবল টেনিসে এই প্রথম। কেন হঠাৎ এই খেলায় যুক্ত হলেন শিল্পপতি চন্দ্র কুমার ধানুকা। তিনি চেয়েছিলেন, যে খেলায় অনেক প্রতিভা, কিন্তু সে রকম পরিকাঠামো নেই, আর্থিক সাহায্য নেই, সেখানে যুক্ত হতে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। লাউডন স্ট্রিটে অ্যাকাডেমি শুরু। পরের চার বছরে তা আরও বড় হয়েছে। এই কাজে তিনি পেয়েছেন সৌম্যদীপ ও পৌলমীকে। ধানুকা বললেন, “আমার চিন্তা-ভাবনা অন্য রকম ছিল। সৌম্যদীপ, পৌলমীর অন্য রকম ছিল। আমাদের দু’ধরনের চিন্তা-ভাবনাকে এক জায়গায় এনে এই অ্যাকাডেমি তৈরি হয়েছে। টেবল টেনিসে অলিম্পিক্স পদক জেতার জন্যই সব করা। আমার একটাই লক্ষ্য। দেশের জন্য অলিম্পিক্সে পদক জেতা। এশিয়ান গেমসে প্রথম বার পদক এসেছে। আমরা নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি।”
বাবা-মায়েদের কাছ থেকেও ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন তাঁরা। ছেলে-মেয়েদের অ্যাকাডেমিতে রেখে শেখাতে কোনও সমস্যা নেই তাঁদের। গত কয়েক বছরে টেবল টেনিসে পারফরম্যান্সের দিক দিয়ে এই অ্যাকাডেমি এখন ভারতের সেরা। এ বার পরিকাঠামোর দিক থেকেও তারা এক নম্বর হতে চান। টেবল টেনিসকে আরও জনপ্রিয় করতে চান ধানুকা। তিনি বললেন, “যাতে আরও বেশি ছেলে-মেয়ে টেবল টেনিসে আসে সেই চেষ্টা করছি। এই খেলাকে আরও জনপ্রিয় করতে চাই। যাদের আন্তর্জাতিক স্তরে পদক জেতার ইচ্ছা আছে তারা জানবে যে এমন একটা অ্যাকাডেমি আছে, যেখানে গেলে তারা সব শিখতে পারবে। টেবল টেনিস খেলতে তো শুধু একটা বোর্ড লাগে। কিন্তু যারা সত্যি ভাল খেলতে চায় তারা একটা ভাল অ্যাকাডেমি পাবে। সিন্ড্রেলার মতো খেলোয়াড় যদি সব রকম সাহায্য পায় তা হলে ও অনেক দূর যেতে পারবে। সেটাই করার চেষ্টা করছি।” কয়েক জনকে বেছে নিয়ে তাদের উপর বিনিয়োগ করতে চাইছেন ধানুকা। সব রকমের আর্থিক ও পরিকাঠামো গত সাহায্য দিতে চাইছেন। তাতে যদি এই অ্যাকাডেমি থেকে ব্যবসা খুব একটা ভাল না-ও হয় তাতে দুঃখ নেই তাঁর। উল্টে দেশের জন্য পদক এলে বেশি খুশি হবেন তিনি।
সব রকমের সুযোগ সুবিধা একটি অ্যাকাডেমিতে পেলেই কি একের পর এক চ্যাম্পিয়ন উঠে আসবে? না। সবাই হয়তো পারবে না। কিন্তু কয়েক জনও যাতে পারে সেই রাস্তাটাই দেখাতে চায় ‘ধানুকা ধুনসেরি সৌম্যদীপ পৌলমী টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি’। আর সেই পথে বাবা-মায়েদের ধৈর্য রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন পৌলমী। তাঁর কথায়, “যুগ বদলছে। এখন বাবা-মায়েরা অনেক বেশি আগ্রহ দেখান। পড়াশোনা একটু পিছনে ফেলে ঝুঁকি নিতেও রাজি তাঁরা। কিন্তু তাঁদের ধৈর্য খুব কম। তাঁদের মাথায় রাখতে হবে, রাতারাতি সাফল্য পাওয়া যায় না। বিশ্বের সেরা অ্যাকাডেমিতে নিয়ে গেলেও হবে না। ধৈর্য ধরতে হবে। আর পরিশ্রম করে যেতে হবে।” এই ধৈর্য আর পরিশ্রমই ঐহিকা, সুতীর্থাকে তৈরি করেছে। সিন্ড্রেলাও সেই পথেই এগোচ্ছে। আর তাদের চলার পথ মসৃণ করার কাজ করে চলেছে একটি অ্যাকাডেমি। লা মাসিয়ার মতো আরও মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তাদের তুলে আনার কাজ করছে তারা।