রাজ্যে বিজেপির টিমটিমে শিখা দীপের ঔজ্জ্বল্য পেয়েছিল তাঁর আমলেই। পদ্মের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সম্পর্কে এমন কথা দলের ভিতরের লোকেরা অনেকে তো বলেনই, বিজেপি বিরোধীরাও মানেন। কিন্তু সেই দিলীপ এক প্রকার ‘দ্বীপ’ হয়ে গিয়েছেন বিজেপির অন্দরে। এই যে সন্দেশখালি আন্দোলন নিয়ে এত উত্তেজনা— রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী একের পর এক সফর করেছেন, কিন্তু দিলীপ তখন থেকেছেন অনেকটা দূরেই। কলকাতায় গান্ধীমূর্তির পাদদেশে দলের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দলের নির্দেশে কয়েক ঘণ্টার জন্য হাজিরা দিলেও, সন্দেশখালির দিকে যাননি আন্দোলনে যোগ দিতে। আবার প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীর দু’দিনের সফরে আরামবাগ বা কৃষ্ণনগরের সভার ধারেকাছে দেখা যায়নি দিলীপকে। কোথায় ছিলেন তিনি?
প্রতি সন্ধ্যায় সংবাদমাধ্যমকে পাঠানো দিলীপের কর্মসূচি বলছে, তিনি নিজের লোকসভা আসন মেদিনীপুরেই ছিলেন। প্রতি দিন ঠাসা কর্মসূচি। কিন্তু সবটাই মেদিনীপুর লোকসভা আসনের সাতটি বিধানসভা এলাকায়। তার বাইরে নয়। শনিবার কেন্দ্রীয় বিজেপি যখন বাংলার ২০টি আসনের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে, সেই তালিকায় মেদিনীপুর নেই। নেই দিলীপের নাম। কেন? তবে কি গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে যাঁর নেতৃত্বে বিজেপির আসন ২ থেকে বেড়ে ১৮ হয়েছিল, তিনিই ২০২৪ সালের দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে থাকছেন না? গত বিধানসভা নির্বাচনে যাঁর সভাপতিত্বে রাজ্য বিজেপি বিধানসভায় ৩ থেকে আসন বাড়িয়ে ৭৭ করেছে, তাঁকে নিয়ে দলে এত দোনামোনা কেন? তাঁকে কি অন্য আসনে প্রার্থী করা হতে পারে? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পদ্মশিবিরের অন্দরে। সংশয়ের ছায়া পড়েছে দিলীপের ঘনিষ্ঠ এবং অনুগামীদের মনেও।
দলের যে দোনামোনা রয়েছে তা এক রকম স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এখনও মন্ত্রী থাকা আলিপুরদুয়ারের জন বার্লার নাম বাদ দিয়েছে প্রার্থিতালিকা থেকে। সুকান্তকে প্রার্থী করে দিয়েছে বালুরঘাট থেকেই। যে সব আসন নিয়ে বিজেপি নেতাদের মধ্যে ধন্দ রয়েছে, সেই সব জেতা আসনেই শুধু প্রার্থীর নাম বলা হয়নি। তার মধ্যে মেদিনীপুর ছাড়াও রয়েছে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, বর্ধমান-দুর্গাপুর, ব্যারাকপুর এবং ঝাড়গ্রাম। এই সব আসনের সাংসদেরা সকলেই দ্বিধার মধ্যে রয়েছেন। কিন্তু দিলীপ তা নন। শনিবার যখন প্রার্থিতালিকা ঘোষণা হচ্ছে তখন দিলীপ ছিলেন খড়্গপুর স্টেশনে। অযোধ্যাগামী ট্রেনের উদ্বোধন করেন। তার আগে মোদীর কৃষ্ণনগরের সভায় যখন সব রাজ্য নেতারা উপস্থিত, দিলীপ ছিলেন নারায়ণগড়ে বুথ কর্মী সম্মেলনে। এর পরে দাঁতনে একের পর এক কর্মসূচি করেছেন।
প্রথম প্রার্থিতালিকায় তাঁর নাম না থাকলেও রবিবার মেদিনীপুর শহরে ওয়ার্ড সম্মেলন থেকে নানা কর্মসূচিতে রয়েছেন দিলীপ। বিকেলে কেশিয়ারিতেও কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু প্রথম তালিকায় নাম নেই কেন? প্রশ্নের জবাবে আনন্দবাজার অনলাইনকে দিলীপ বলেন, ‘‘দল কিছু পরিকল্পনা করেছে। দফায় দফায় নাম ঘোষণা করে গত বিধানসভা নির্বাচনেও সুবিধা মিলেছিল। এ বারেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তেমনটাই করছেন।’’ কিন্তু আপনার নাম থাকবে তো? আসন বদল হয়ে যাবে না তো? দিলীপ বলেন, ‘‘হলে হবে। দল যা করতে বলবে তা-ই করব। আমি বরাবরই এটায় বিশ্বাসী। প্রার্থী না-করে যদি গোটা রাজ্যে প্রচারে জোর দিতে বলা হয় তা-ই করব। এটাই আমার নীতি। দায়িত্ব পালন। আগে যত বার প্রার্থী করা হয়েছিল, জিতে দেখিয়ে দিয়েছি। অন্যদেরও জিতিয়েছি। এ বার যেমন নির্দেশ আসবে তেমনটাই করব।’’ প্রথম তালিকায় নাম না থাকার জন্য হতাশ লাগছে না? দিলীপ বলেন, ‘‘রাজনীতিতে হতাশার কোনও জায়গা নেই। আর আমার জীবনেও এই শব্দটা নেই। আমার লক্ষ্য ঠিক করা রয়েছে। তাতে সাংসদ, বিধায়ক এ সব নেই। দল যা ঠিক মনে করবে, সেটাই আমার জন্য ঠিক।’’
দিলীপ এমন করে বললেও অনুগামীরা তা মানতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্যেও যুক্তি রয়েছে। পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁরা বোঝাতে চাইছেন, এই রাজ্যে বিজেপিকে ‘আলোয়’ এনেছেন দিলীপ। তাঁর আমলেই যত সাফল্য। যেটার শুরু ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন দিয়ে। এক ঘনিষ্ঠ বলেন, ‘‘ওঁর মুখে কখনও কোনও আক্ষেপ শোনা যায় না। কে কোথায় কলকাঠি নাড়ছেন, তা নিয়ে কোনও নালিশও নয়। পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সময়েও শোনা যায়নি।’’ ওই নেতারই দাবি, ‘‘দিলীপদার জায়গায় ভারতী ঘোষকে প্রার্থী করা হতে পারে বলেও দলে শোনা যাচ্ছে। কারণ, ভারতীই গত লোকসভা নির্বাচনের একমাত্র চেনা মুখ যিনি জিততে পারেনি। তাঁকে এ বার ঘাটাল না-দিয়ে মেদিনীপুরের সহজ আসনে পুনর্বাসন দেওয়া হতে পারে। সেখানে দিলীপদাকে অন্য কোথাও দেওয়া হতে পারে। তবে সেটা হলে দলের জন্য ভাল হবে না।’’ দিলীপের আর এক ঘনিষ্ঠ ‘আদি’ নেতা বলেন, ‘‘বিজেপিতে দিলীপদার জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। গোটা রাজ্য তাঁকে চেনে। সব কর্মীরা আপন ভাবেন। তাঁকে প্রার্থী না-করলে এবং মেদিনীপুরেই না-করলে বড় ভুল হয়ে যাবে। দল সে ক্ষতি পূরণ করতে পারবে না।’’
এ সব নিয়ে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত কোনও মন্তব্য করতে চাননি। রাজ্য বিজেপির বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতাদের দাবি, এখনই এত ভাবার কারণ নেই। সবে তো প্রথম তালিকা ঘোষণা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, দিলীপকে মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে কৃষ্ণনগরের মতো আসনেও নিয়ে যেতে পারে বিজেপি। যদিও ওই আসনে প্রয়াত এবং প্রাক্তন এক সাংসদের আইনজীবী পুত্রের নামও ঘোরাফেরা করছে।
তবে তিনি যে মেদিনীপুরেই প্রার্থী হবেন, সেটা অনেক আগে থেকেই ‘নিশ্চিত’ হয়ে ছিলেন দিলীপ। সেই কারণে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি পদ খোয়ানোর পর থেকে নিজের আসনেই মন দেন। সংসদে অধিবেশন চলার সময় ছাড়া বেশির ভাগ দিন কাটিয়েছেন মেদিনীপুরে। প্রতি দিন কর্মসূচি রেখেছেন। এমনকি দল যখন সব মণ্ডলে সভার কথা বলেছিল, তখন মেদিনীপুরেই তা একশো শতাংশ হয় বলেও দাবি করেন দিলীপ ঘনিষ্ঠেরা। প্রার্থী হচ্ছেন ধরে নিয়ে গত পাঁচ বছরে তাঁর সাংসদ তহবিলের টাকায় এলাকায় কী কী কাজ হয়েছে তা নিয়েও প্রচার সেরে ফেলেছেন দিলীপ। আবার সন্দেশখালি আন্দোলনে যখন রোজ সুকান্ত, শুভেন্দুরা যাচ্ছিলেন, তখন দিলীপ বসিরহাট গিয়েছিলেন কিছুটা চুপি চুপিই। ন্যাজাট বাস স্ট্যান্ডের কাছে দলের আদিবাসী মোর্চার কর্মী সম্মেলনে যোগ দেন।
কিন্তু সত্যিই কি দিলীপকে বাদ দিতে পারেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব? দিলে কেন? বিজেপির অনেকে বলেন যে, বিজেপিকে একটি ‘দেশ’ মনে করা হলে দিলীপ ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’। অনেক ক্ষেত্রেই নিজের মতো কাজ করেন। নিজের মতো সফর করেন। যেমন নিজের মতো করেই ন্যাজাটে গিয়েছিলেন। দিলীপ যে প্রার্থী হতে না-ও পারেন, এমন কথা অনেক আগে থেকেই বিজেপিতে আলোচনা শোনা গিয়েছে। রাজ্য নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘‘দিলীপদার উপরে কেন্দ্রীয় নেতারা বীতশ্রদ্ধ। এর পরে ভোটের টিকিট দেবেন কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।’’ কেউ কেউ এমনও মনে করছেন যে, দিলীপকে মেদিনীপুরেই প্রার্থী করা হবে, কিন্তু প্রথম তালিকায় নাম না-রেখে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে তাঁকে একটা বার্তা দিয়ে রাখা হল। দিলীপ অবশ্য বরাবরই বলে এসেছেন, ‘‘দিলে দেবে। না-দিলে না-দেবে। সঙ্ঘের (আরএসএস) প্রচারক আমি। দল না-চাইলে বেডিং গুছিয়ে মূল সংগঠনে ফিরে যাব। তবে যত দিন আছি দলের কাজে কোনও ফাঁকি দেখাতে পারবে না কেউ।’’ এখনও দিলীপ তেমনই বলছেন। রবিবার তাঁকে আনন্দবাজার অনলাইনের পক্ষ থেকে ফোন করা হলে কিছুটা কথাবার্তার পরেই তিনি বলেন, ‘‘কর্মী সম্মেলনে ঢুকছি। বাকি কথা পরে হবে।’’ তাঁর ঘনিষ্ঠদের মতো তিনিও আপাতত নিশ্চিত টিকিট থাকবে। মেদিনীপুরেই থাকবে। তাই নাম ঘোষণার অপেক্ষায় থেকে ভোটের প্রস্তুতিতে কোনও খামতি রাখা যাবে না।