ছোটবেলায় দেখতাম বাড়ির জেঠু-কাকারা আজকের মতো ডট পেনে লিখতেন না। ফাউন্টেন পেন বা ঝরনা কলমে কালি ভরে লিখতেন তাঁরা। আর ঝরনা কলমে সুলেখা কালি বাঙালির কাছে নস্টালজিয়া। দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর এলাকায় যাঁদের যাতায়াত আছে, তাঁরা এক নামেই সুলেখার মোড় বললে চিনতে পারেন।কিন্তু কেন এই নাম হলো, তা কি জানেন? একটা সময় এখানেই ছিল সুলেখা কালি তৈরির কোম্পানি। কিন্তু এখন আর স্মৃতি নয়, চাইলেই দোকান থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন ‘সুলেখা কালি’।
পথচলার শুরু
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরূদ্ধে গর্জে উঠেছে গোটা দেশ। বিদেশি পণ্য বয়কটের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু ভারতীয় ব্যবসা শুরু করেছেন সেসময়। ১৯৩২ সালের দিকে মহাত্মা গান্ধী তাঁর চিঠিপত্র লেখার জন্য দেশি কালির খোঁজ করছিলেন। গান্ধীজি তাঁর এই চাহিদার কথা জানান সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তকে। স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র পেশায় ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালসের কেমিস্ট। নিজে এক সময় ‘কৃষ্ণধারা’ নামে কালিও তৈরি করেছিলেন। গান্ধীজির মুখের কথায় সেই কালি তৈরির ফরমুলা তুলে দিলেন দুই বঙ্গসন্তান ননীগোপাল এবং শঙ্করাচার্যর হাতে। দুই ভাই একসময় গান্ধীজির ডাকে স্বাধীনতা আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবসা শুরুর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা জোগাড় হবে কীভাবে, সেই নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান তাঁরা। অবশেষে ১৯৩৪ সালে বাবার জমানো টাকা দিয়েই অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে শুরু হয় কালির উৎপাদন। স্বয়ং গান্ধীজির দেওয়া নাম ‘সুলেখা’ কথার অর্থ, ভালো লেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ছিল ‘সুলেখা কালি- এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’
তবে ব্যবসায় লক্ষ্মীলাভ করতে খানিক সময় লেগেছিল দুই ভাইয়ের। প্রথমদিকে কালি তৈরির দ্বায়িত্বে থাকতেন পরিবারের মহিলারা। আর দোকানে দোকানে সুলেখা কালি পৌঁছে দেওয়া, বিক্রির দিক দেখতেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। পরবর্তী কয়েক দশকে বহুগুণ বেড়ে যায় বিক্রি। লাভের পরিমাণ বেড়ে ফুলেফেঁপে ওঠে সুলেখা কালির বাজার।
সুলেখা কালির রমরমা
এই কালির ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধু ভারতে নয়, বিদেশের বাজারেও সুলেখা কালির বিক্রি বাড়তে থাকে। কোম্পানি শুরুর কয়েক দশকের মধ্যেই চারিদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করে স্বদেশি এই কালি। একসময় প্রতি মাসে এক মিলিয়নেরও বেশি কালির বোতল বিক্রি হতো। বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে উৎপাদন কারখানাও তৈরি হয় দেশের বেশ কিছু জায়গায়। ১৯৩৬ সালে হ্যারিসন রোড অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধী রোড শিয়ালদহ-র কাছে সুলেখা কালির দোকান খোলেন ননীগোপাল। ১৯৩৮ সালে বউবাজার, এবং পরের কয়েক বছরে কসবা, যাদবপুরেও কালি তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার পৌঁছায় এক লক্ষ টাকায়। স্বাধীনতার পর উত্তর ২৪ পরগনার সোদপুরে এবং উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদেও উৎপাদন কারখানা তৈরি হয়। বিদেশের মাটিতেও সুলেখা কালির ব্যবসার জন্য আমন্ত্রণ জানান একাধিক দেশ। দক্ষিণ আফ্রিকাতে এই কোম্পানির কারখানা তৈরি হয়। বার্মা বা মায়ানমারেও রফতানি করা হতো এই কালি। ১৯৬৭ সালে কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি টাকা। ‘৭১-এর যুদ্ধের সময় ও পরে বহু বাংলাদেশি শরণার্থী কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন এই কোম্পানিতে। ১৯৮৪ সালে পূর্ব ভারতের বাজারের প্রায় ৮৯ শতাংশ সুলেখা কালির দখলে ছিল। তবে এর কয়েক বছরের মধ্যেই বাজার পড়ে যায় সুলেখা কালির।
সুলেখা কালির বিজ্ঞাপন
চ্যালেঞ্জ
আটের দশকের শেষের দিকে বাজারে বিক্রি হতে শুরু করে বল পেন। বল পেনের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বাজার হারায় সুলেখা কালি। ১৯৮৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় কালি তৈরির কাজ। তবে এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত সুলেখা কালির ইতিহাস। কিন্তু না, বাঙালি জানে কীভাবে কামব্যাক করতে হয়। প্রায় ১৮ বছর পরে ২০০৬ সালে ফের বাজারে ফিরে এল সুলেখা কালি। প্রথম কয়েক বছর আবারও কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে কেটেছে কোম্পানির। এই লড়াই আরও কঠিন হয়েছে পরিস্থিতির চাপে। ২০১১ সালে ব্যবসা খানিক ছন্দে ফিরলেও তাল কাটতে বেশি সময় লাগেনি। নোটবন্দির ধাক্কা সামলে ওঠার পরই করোনা অতিমারী বাজারে থিতু হতে দেয়নি সুলেখা কালিকে।
তবে প্রথম থেকেই কোম্পানির বর্তমান মালিক কৌশিক মৈত্র বুঝেছিলেন, শুধু কালি দিয়ে বাজারে টিকে থাকা অসম্ভব। তাই সুলেখা কালির দ্বিতীয় ইনিংসের সঙ্গী হয় একঝাঁক নতুন পণ্য। পেনসিল, রবার, বল পেন, ফিনাইল, সাবান, ন্যাপথলিন, এমনকী, সোলার প্যানেল তৈরি করতে শুরু করে কোম্পানি। সাবেক সুলেখা কালিও নতুন মোড়কে বাজারে আনে কোম্পানি। আজ দেশপ্রেমের মোড়কে স্বদেশি, স্বরাজ ও স্বাধীনতা নামে তিনটি সিরিজে বাজারে বিক্রি হয় সুলেখা কালি। সঙ্গে রয়েছে হোম ডেলিভারির সুবিধাও। খাদির পুটুলিতে মোড়া নতুন রূপে আজ হাজির সুলেখা কালি।
এক সময় গান্ধীজি থেকে শুরু করে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় সবাই লিখতেন সুলেখা কালিতে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ফেলুদা সিরিজের ‘সমাদ্দারের চাবি’ গল্পে এবং ‘জন অরণ্য’ সিনেমাতে সুলেখা কালিকে বিশেষ জায়গা দিয়েছেন। স্বমহিমায় বাজারে টিকে থাকলেও কতখানি লাভজনক হবে ব্যবসা, তা বলবে সময়। কিন্তু বাঙালির কাছে সুলেখা কালির জনপ্রিয়তা কমবে না কখনওই।