‘বিদ্রোহী’র অভিষেক পর্ব শেষ হল বিষাদে! ৬২ রানে অনেক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন সরফরাজ

৬৬টা বল দেখতে দেখতে যতটা উচ্ছ্বাস করছিলেন, খেলার পর ততটাই হতাশ অনিল কুম্বলে। স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন, কেন যে ওকে অভিষেকের টুপিটা দিতে গেলাম! ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা স্পিনার প্রথম টেস্টে রান আউট হয়েছিলেন। তাঁর হাত থেকে অভিষেকের টুপি নেওয়া সরফরাজ খানের প্রথম টেস্ট ইনিংসও থেমে গেল রান আউটে।

উল্টো দিকে থাকা রবীন্দ্র জাডেজার ভুল ‘কল’ যখন নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকা সরফরাজের স্টাম্প নড়িয়ে দিল, তখন তাঁর নামের পাশে ৬৬ বলে ৬২। সরফরাজের থেকেও বেশি বিস্মিত জাডেজা। বরং লজ্জিত। ড্রেসিংরুমে টুপি আছড়ে ফেললেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। রাজকোটের গোটা স্টেডিয়াম হতভম্ব। এক জনই শুধু অবিচলিত। তিনি সরফরাজ স্বয়ং। আউট হয়ে যখন শেষ হতে না চাওয়া পথ পেরিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, তখন অন্তত দেখে বোঝা যায়নি নিশ্চিত শতরান মাঠে ফেলে আসতে হল। বরং ৬২ রানের ইনিংসে ‘বিদ্রোহী’ সরফরাজ আরও অনেক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন।

জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন যাঁরা দেখেন তাঁরা একটা কথা একবাক্যে মানেন, যতই সুযোগ না দেওয়া হোক, যতই বার বার হতাশা গ্রাস করুক, চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। মুখ খোলা মানেই ‘নম্বর’ কাটা যাবে। সরফরাজ কোনও দিন সে সবের তোয়াক্কা করেননি। যত বার সুযোগ পাননি, কোনও না কোনও ভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ম্যাচের মাঝে নির্বাচকদের দিকে অঙ্গভঙ্গি, সমাজমাধ্যমে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, শতরানের পর উল্লাস— সবেতেই প্রতিবাদ ছিল। সঙ্গে ছিল আরও একটা জিনিস, ঝুড়ি ভর্তি রান। চটাতে সাহস পেতেন না কেউ। কারণ, সম্বল ছিল ধারাবাহিকতা। সেই কারণেই ‘বিদ্রোহী’ হয়েও বিভিন্ন সময়ে প্রাক্তন ক্রিকেটারদের সমর্থন পেয়ে গিয়েছেন সরফরাজ। নির্বাচকেরা বার বার বাদ দিয়েছেন। বার বার সরফরাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁকে উপেক্ষা করা যাবে না। সরফরাজের এই ইনিংসের ৬৬টা বল তাঁর বিদ্রোহকে পরিপূর্ণতা দিয়ে গেল।

মুম্বইয়ের যে কোনও ময়দানের আর পাঁচ জন ক্রিকেটার যে স্বপ্ন দেখেন, ছোটবেলা থেকে সরফরাজ খানের স্বপ্নটাও তার থেকে আলাদা ছিল না। স্কুল ক্রিকেট, তার পর রঞ্জি, শেষে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপাবেন, এটাই ছিল স্বপ্ন। বাকি সব লক্ষ্যপূরণ হয়ে গেলেও জাতীয় দলের জার্সি চাপানোর স্বপ্নটা অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল এত দিন। বার বার দরজায় কড়া নাড়লেও ভেতরে ঢুকতে পারছিলেন না। সরফরাজ খানের সেই স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হল বৃহস্পতিবার। জাতীয় দলের জার্সিই শুধু গায়ে চাপালেন না, অভিষেকেই এমন একটি ইনিংস খেললেন যা মনে রেখে দেওয়ার মতোই। ইংল্যান্ডকে একাই ‘বাজ়বল’ শিখিয়ে দিলেন। এ দিনের ইনিংসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর খেলায় ছিল আগ্রাসন। জাতীয় দলে সুযোগ না পাওয়ায় এত দিন সমাজমাধ্যমে বা প্রকাশ্যে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। হয়ে উঠেছেন ‘বিদ্রোহী’ সরফরাজ। অভিষেকে তাঁর খেলার মধ্যেও দেখা গেল বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ জবাবের, সুযোগ কাজে লাগানোর এবং নিজের জাত চেনানোর।

রোহিত শর্মা আউট হওয়ার পর খেলতে নেমেছিলেন সরফরাজ। তার আগে চার ঘণ্টা প্যাড পরে বসে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। রোহিত ড্রেসিংরুমে ফিরে আসার সময় সরফরাজের পিঠ চাপড়ে দেন। ওভারের শেষ তিনটি বলে কোনও ঝুঁকি নিতে যাননি তিনি। প্রথম রান আসে মার্ক উডের বলে। ৬৬তম ওভারের চতুর্থ বলে মিড উইকেটে তিন রান নেন। সেই শুরু। এর পর সময় যত এগিয়েছে, ততই ক্ষুরধার হয়ে উঠেছে সরফরাজের ব্যাট। ৬৯তম ওভারে রেহান আহমেদকে পয়েন্ট দিয়ে প্রথম বার চার মারলেন। এর পরে জো রুটকে পর পর চার ওভারে চারটি চার মারলেন তিনি। টম হার্টলির বলে খুচরো রান নিয়ে ৭৭তম ওভারে অর্ধশতরান। ছন্দ কাটল ৮২তম ওভারে। বেশ এগোচ্ছিল সরফরাজের ইনিংস। কিন্তু শতরানের থেকে এক রান দূরে থাকা জাডেজা রান নিতে গিয়ে হঠাৎই থামিয়ে দিলেন উল্টো প্রান্তে থাকা সরফরাজকে। কোনও মতে পিছনে ফিরতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তত ক্ষণে মার্ক উডের থ্রো উইকেট ভেঙে দিয়েছে। নিশ্চিত শতরান হাতছাড়া হয় মুম্বইয়ের ব্যাটারের। প্রথম দিনের খেলা শেষে কুম্বলে বলেন, “প্রথম টেস্টে আমিও রান আউট হয়েছিলাম। মনে হয় টুপি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের খারাপ ভাগ্যটাও ওকে দিয়ে দিয়েছি।”

১৭ বছর বয়সে প্রথম বার ক্রিকেটবিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন সরফরাজ। প্রথমে বাবা নওশাদ খানের অধীনে অনুশীলন শুরু করেন। নওশাদ নিজেও মুম্বইয়ের প্রাক্তন ক্রিকেটার ছিলেন। ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় সরফরাজের। তিনি সেই বিরল ক্রিকেটারদের এক জন যিনি দু’টি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছেন। ২০০৯ সালে হ্যারিস শিল্ডের একটি ম্যাচে ৪৩৯ রান করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে সচিন তেন্ডুলকরের ২১ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন। তার পরেই সরফরাজকে মুম্বইয়ের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে নিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে ভাল খেলে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও সুযোগ পান। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সরফরাজের ৫৬৬ রান তৃতীয় সর্বোচ্চ। তার আগে রয়েছেন শুধু অইন মর্গ্যান এবং বাবর আজ়ম।

সরফরাজের জীবনে বিতর্ক কম হয়নি। বয়স ভাঁড়ানোর অভিযোগে তাঁকে নিলম্বিত করে দেয় মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা (এমসিএ)। প্রথমে মানতে না চাইলেও পরে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন সরফরাজ। শৃঙ্খলাজনিত কারণে এর পর এমসিএ-র ইন্ডোর অ্যাকাডেমি ক্যাম্প থেকে নির্বাসিত করা হয় তাঁকে। সরফরাজের রাগ তাঁকে বার বার বিপদে ফেলছিল। ২০১৪-১৫ মরসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর ম্যাচ ফি আটকে রাখা হয়। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটের একটি ম্যাচে নির্বাচকদের উদ্দেশে কিছু অঙ্গভঙ্গি করেছিলেন তিনি। ২০১৪-১৫ মরসুমের পরেই সরফরাজ মুম্বই ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের হয়ে খেলতে চলে যান।

উত্তরপ্রদেশে দুটো মরসুম কাটালেও সে ভাবে সাফল্য পাননি। ফলে জাতীয় দলের দরজা খোলার কোনও সুযোগই ছিল না। ২০১৯-২০ মরসুমে সরফরাজ আবার ফিরে আসেন মুম্বইয়ে। সেটাই ছিল মোড়ঘোরানো সিদ্ধান্ত। পরের দু’টি মরসুমে যে দাপটের সঙ্গে তিনি ব্যাট করেন তা ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব কম ক্রিকেটারই করতে পেরেছেন। ওয়াসিম জাফর এবং অজয় শর্মার মতো ভারতের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসাবে প্রথম শ্রেণির ঘরোয়া ক্রিকেটে পর পর দু’বার ৯০০-এর বেশি রান করেন। গত মরসুমেও ভাল খেলেছেন।

ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পর রান করেও সুযোগ না পাওয়ায় বার বার প্রতিবাদ করেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন ‘বিদ্রোহী’ ক্রিকেটার। ২০২২-এর বাংলাদেশ সিরিজ়ে তাঁকে সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই সফর তো দূর, পরের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়েও সুযোগ পাননি। সেই সময় রঞ্জিতে একটি ম্যাচের পর বলেছিলেন, ‘‘গত রঞ্জির ফাইনালে সেঞ্চুরির পরে নির্বাচকদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ওঁরা বলেছিলেন, বাংলাদেশ সফরে সুযোগ পাব। তৈরি থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু পাইনি।’’ তৎকালীন নির্বাচক প্রধান চেতন শর্মার কথাও টেনে এনেছিলেন সরফরাজ়। বলেছিলেন, ‘‘কয়েক দিন আগেই চেতন স্যরের সঙ্গে দেখা হল। উনি বললেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি সুযোগ পাব। নির্বাচকেদের কথায় বার বার আশা জাগছে। কিন্তু বার বার হতাশ হচ্ছি। এ ভাবে আগে থেকে আশা জাগানো ঠিক নয়।’’

এর আগে ভারত ‘এ’ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ভাল খেলতে পারেননি। সেই কারণেই কি জাতীয় দলে জায়গা পেতে দেরি হচ্ছে সরফরাজ়ের? এ কথা মানতে চাননি মুম্বইয়ের ক্রিকেটার। বলেছিলেন, ‘‘কয়েকটা ম্যাচ ব্যর্থ হতেই পারি। আমি তো ভগবান নই। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে লাল ও সাদা বল, দু’ধরনের ক্রিকেটেই ধারাবাহিক ভাবে রান করেছি। আমাকে এক দিনের দলেও সুযোগ দিতে পারে বোর্ড। এত দিন ধরে খেলছি। জাতীয় দলে সুযোগ পেতে আর কী করব?”

গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সুযোগ না পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন সরফরাজ়। কিন্তু তার পরে মনকে বুঝিয়েছিলেন, তাঁর কাজ শুধু খেলা। সরফরাজ় বলেছিলেন, ‘‘দলে নাম না দেখে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কেঁদে ফেলেছিলাম। কিন্তু তার পরে মনকে বোঝালাম, আমার কাজ শুধু খেলা। ঘরোয়া ক্রিকেটে আরও ভাল খেলার চেষ্টা করব। তাতে যদি নির্বাচকদের মনে জায়গা করতে পারি।’’

২০২৪-এর ১৫ ফেব্রুয়ারিও কাঁদলেন সরফরাজ। তাঁর বাবা এবং স্ত্রীর চোখ দিয়েও বেরোল জল। তবে এটা চোখের জল বঞ্চনার নয়, আনন্দের। সতীর্থদের মাঝে দাঁড়িয়ে অনিল কুম্বলের হাত থেকে টেস্ট অভিষেকের টুপি নেন সরফরাজ়। ছেলের কেরিয়ারের সব থেকে বড় মুহূর্তের সাক্ষী থাকেন বাবা। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখেন তিনি। নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি সরফরাজ়ের বাবা নওশাদ। কেঁদে ফেলেন তিনি। সরফরাজ়কে টুপি নিতে দেখে প্রথমে হাসছিলেন নওশাদ। তার পরেই কেঁদে ফেলেন তিনি। জামা দিয়ে চোখ ঢাকেন। টুপি পেয়ে প্রথমেই বাবার কাছে যান সরফরাজ়। তাঁকে টুপি দেখান। ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন বাবা। বোঝা যাচ্ছিল, এত বছরের অপেক্ষার অবসানের পরে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না তাঁরা। চোখের জল বাধ মানছিল না নওশাদের। ছেলের টেস্ট টুপিতেও চুমু খান তিনি। সঙ্গে ছিলেন সরফরাজ়ের স্ত্রীও। বাবার পরে স্ত্রীকেও জড়িয়ে ধরেন সরফরাজ়।

সরফরাজের সঙ্গে বঞ্চনার ইতিহাস বেশ লম্বা। গত বছরও তাঁকে হতাশ হতে হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি ওয়েস্ট ইন্ডিজ়‌গামী দলেও নেওয়া হয়নি সরফরাজকে। তার পরে তিনি পাশে পেয়েছিলেন সুনীল গাওস্করকে। একটি সাক্ষাৎকারে ভারতীয় দল নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলেছিলেন গাওস্কর। তিনি বলেছিলেন, ‘‘গত তিন মরসুম ধরে ১০০ গড়ে রান করেছে সরফরাজ়। এর পরেও দলে সুযোগ পায়নি। সুযোগ পেতে ওকে আর কী করতে হবে? প্রথম একাদশে না খেলালেও ওকে অন্তত দলে নেওয়া উচিত ছিল।’’

আইপিএলে ভাল খেলায় সেই সিরিজ়‌ে ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন যশস্বী জয়সওয়াল। গাওস্করের প্রশ্ন ছিল, তা হলে কি দলে সুযোগ পেতে হলে আইপিএলে ভাল খেললেই চলবে? তিনি বলেছিলেন, ‘‘সরফরাজ়কে বলে দেওয়া হোক যে রঞ্জি খেলে কোনও লাভ নেই। শুধু আইপিএলে ভাল খেললেই লাল বলের ক্রিকেটে সুযোগ পাওয়া যাবে। তা হলে হয়তো ওকে আর এত পরিশ্রম করতে হবে না।’’

এর কয়েক দিন পরে সরফরাজকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় দলে না নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন এক বোর্ডকর্তা। তিনি বলেছিলেন, “রঞ্জিতে দুটো মরসুমে ৯০০ রান করা ব্যাটারকে নেবে না, নির্বাচকেরা অতটাও বোকা নয়। প্রথমত, সরফরাজের ফিটনেস মোটেই আন্তর্জাতিক মানের নয়। ওকে কঠোর পরিশ্রম করে ওজন ঝরিয়ে অনেক রোগা এবং ফিট হতে হবে। তা হলেই দলে সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়ত, মাঠে এবং মাঠের বাইরে ওর আচরণ খুব একটা ভাল নয়। কিছু কথা, কিছু ব্যবহার, কিছু ঘটনা নির্বাচকেরা লক্ষ করেছেন। আরও একটু শৃঙ্খলা দেখালে খুব ভাল হত। আশা করি আগামী দিনে সরফরাজ এ বিষয়ে ওর বাবা এবং কোচ নওশাদ খানের সঙ্গে আলোচনা করবে।”

সরফরাজের ফিটনেস নিয়েও বার বার কথা হয়েছে। সে সম্পর্কে আনন্দবাজার অনলাইনকে এক সাক্ষাৎকারে নওশাদ বলেছিলেন, “বিরাট কোহলি, এবি ডিভিলিয়ার্স, ক্রিস গেলের মতো ক্রিকেটারদের সঙ্গে খেলেছে সরফরাজ। আরসিবি, পঞ্জাব কিংসের মতো দলে খেলেছে। এই বছর দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে খেলছে। এই সব দলগুলি ফিটনেস পরীক্ষা নেয়। ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার সময়ও ফিটনেস পরীক্ষা দিয়েছে। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ফিটনেস পরীক্ষা দিয়েছে। মুম্বই রঞ্জি দলও ফিটনেস পরীক্ষা নিয়েছে। সেই সব ফিটনেস পরীক্ষায় পাশ করেছে বলেই খেলার সুযোগ পাচ্ছে। চার দিনের ম্যাচে তিনশো রান করেছে। টানা দু’দিন ব্যাট করেছে। রঞ্জি ফাইনালেও শতরান করার পর ফিল্ডিং করছে। মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যায়নি ও। তা হলে ওর ওজন নিয়ে কেন প্রশ্ন তোলা হবে?”

শোনা গিয়েছিল, এ বছরের শুরুতে দিল্লির বিরুদ্ধে শতরান করার পর সরফরাজের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেই ম্যাচে হাজির ছিলেন প্রাক্তন প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মা। তিনি বিষয়টি ভাল ভাবে নেননি। গত বছর রঞ্জি ফাইনালেও সরফরাজের একটি আচরণে বিতর্ক হয়। তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের সঙ্গেও ঝামেলা হয়। তবে আইপিএলের পারফরম্যান্স কোনও ভাবেই না নেওয়ার পিছনে দায়ী নয়। বোর্ডকর্তা বলেছিলেন, “এটা সংবাদমাধ্যমের যুক্তি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০০০ রান করে মায়াঙ্ক আগরওয়াল দলে ঢুকেছিল। তখন কি কেউ ওর আইপিএল রেকর্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল? হনুমা বিহারীর ক্ষেত্রেও একই কথা বলব। সে-ও ঘরোয়া ক্রিকেট এবং ভারত ‘এ’ দলের পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলে ঢুকেছিল। এখন তা হলে নতুন তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছে কেন?”

এর পর মাঝে কিছু দিন তিনি চর্চায় ছিলেন না। কিন্তু ইংল্যান্ড সিরিজ়‌ে ভারতের প্রথম সারির একের পর এক ক্রিকেটার চোট পেতে আবার তাঁর নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে গত ২৯ জানুয়ারি ভারতীয় দলে ডাক পান তিনি। দলে সুযোগ পাওয়ার খবর পেয়ে মুম্বইয়ের ব্যাটার সমাজমাধ্যমে বাবার সঙ্গে খুশির মুহূর্তের একটি ছবি দিয়েছিলেন। সঙ্গে ‘চক্‌ দে ইন্ডিয়া’ সিনেমার একটি জনপ্রিয় গান জুড়ে দিয়েছিলেন। সমাজমাধ্যমে তাঁর পোস্ট ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। সমাজমাধ্যমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন সরফরাজের বাবাও। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড শেষ পর্যন্ত তাঁর বড় ছেলের উপর ভরসা রাখায় সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তিনি।

পরে জিয়ো সিনেমাজ়‌ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সরফরাজ বলেছিলেন, “আমি বিরাট কোহলি, এবি ডিভিলিয়ার্স, স্যর ভিভ রিচার্ডস, এমনকি জাভেদ মিয়াঁদাদের ব্যাটিং দেখি। বাবা বলেন আমি নাকি ওঁদের মতো ব্যাট করি। জো রুটের ব্যাটিংও দেখি। শুধু তাই নয়, যারাই সফল হচ্ছে তাদের দেখি এবং শেখার চেষ্টা করি যে কী ভাবে সাফল্য পাচ্ছে। নিজের ক্ষেত্রেও সেটা কাজে লাগাই। এটাই করে যেতে চাই। রঞ্জি ট্রফি খেলাই বা ভারতের হয়ে খেলা।”

সরফরাজ জানিয়েছিলেন, তাঁর জীবনের আদর্শ বাবা নওশাদ আহমেদই। অতীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুই ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর জন্য দিয়েছেন তিনি। সরফরাজের কথায়, “ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচিতি বাবার হাত ধরেই। কেন খেলছি সেটা সব সময় ভাবতাম। আমি আগ্রাসী ব্যাটার। বাকিদের থেকে তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যেতাম বলে বড় রান করতে পারতাম না। খুব খারাপ লাগত বাকিদের সফল হতে দেখে। কিন্তু বাবা আমায় বরাবর বলতেন, কঠোর পরিশ্রম করো। কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই।” তিনি এ-ও জানিয়েছেন, যেখানে খেলতে যেতেন সেখানেই বাবা সঙ্গে যেতেন।

কিছু দিন বোর্ডের তরফে একটি ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছিল। সেখানে কিছু অজানা কথা তুলে ধরেন এই ব্যাটার। তখনও সরফরাজ় যে খেলবেন না তা জানা ছিল না। ২৬ বছরের মিডল অর্ডার ব্যাটার বলেছিলেন, “রঞ্জি খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ব্যাগ গোছানোই ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে ফোন পেলাম। প্রথম বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার বাবা এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিল। বাবাকে ফোন করে বলতেই কেঁদে ফেলে। বাড়ির সকলে খুব খুশি হয় খবরটা পেয়ে।”

সরফরাজ়ের বাবা নওশাদ খানই তাঁর কোচ। ছেলেকে ভারতীয় দলের খেলতে দেখাই ছিল নওশাদের প্রধান লক্ষ্য। সেই পথে এগিয়ে চলেছেন সরফরাজ়। শুক্রবার তাঁকে দলে রাখা না হলেও আগামী দিনের রাস্তাটা কিছুটা পরিষ্কার হল তাঁর জন্য। সরফরাজ় বলেছিলেন, “আমার বাবার স্বপ্ন সত্যি করাটাই আমার লক্ষ্য। বাবা চায় আমি দেশের হয়ে খেলি। ফোন পেয়ে মনে হল আমার এত দিনের কষ্ট সার্থক। আমি খুব খুশি।”

রঞ্জিতে ধারাবাহিক ভাবে রান করেছেন সরফরাজ়। কিন্তু এর আগে কখনও ভারতীয় দলে ডাক আসেনি। বোর্ডের ডাক না পেয়ে অনেক সময়ই ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট করেছেন। বোর্ডকে খোঁচা দিয়েছেন। তবে ডাক পেয়ে তিনি খুশি। সরফরাজ় বলেছিলেন, “ভারতীয় দলে ডাক পাওয়ার জন্য যে পরিমাণ অপেক্ষা করেছি, তা ভাবলে কান্না পায়। বাবা আমাকে বলত, পরিশ্রম করে যেতে। এক দিন ঠিক সুযোগ আসবে। আমি বাবার জন্য খুশি। এটা ভেবেই ভাল লাগছে যে আমি জাতীয় দলের অংশ। এত বড় দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছি আমি।”

টেস্টে সরফরাজ়‌ের জার্সি সংখ্যা ৯৭। এই সংখ্যার নেপথ্যে রয়েছেন সরফরাজ়ের বাবা নওশাদ খান। তিনি মুম্বইয়ের ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত নাম। কোচ নওশাদের নামে দু’টি সংখ্যা রয়েছে। হিন্দি ৯-কে নও আর ৭-কে সাত (শাদ-এর অপভ্রংশ) বলা হয়। বাবার জন্যই এই নম্বরের জার্সি গায়ে খেলেন সরফরাজ়। অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দল থেকে শুরু করে আইপিএল, সব জায়গায় ৯৭ নম্বরই দেখা গিয়েছে সরফরাজ়ের জার্সিতে। রাজকোটেও সেটাই দেখা গিয়েছে।

এ ছাড়া, ম্যাচ চলাকালীন সম্প্রচারকারী সংস্থার হিন্দি ভাষার ধারাভাষ্য বক্সে দেখা যায় সরফরাজ়‌ের বাবা নওশাদকে। সেখানে আকাশ চোপড়া জিজ্ঞেস করেন, “সরফরাজ়ের অভিষেক হওয়ার জন্য কি একটু বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল?” উত্তরে নওশাদ বলেন, “রাত কো ওয়াকত চাহিয়ে গুজ়ারনে কে লিয়ে, লেকিন সূরজ মেরি মর্জি সে নেহি নিকালনে ওয়ালা।” বাংলা যার অর্থ, রাতের অন্ধকার কাটতে সময় লাগে, কিন্তু সূর্য আমার ইচ্ছা অনুযায়ী উঠবে না। তবে কি নওশাদের কথাতেও অভিমান ঝরে পড়ল? তিনি কি বোঝাতে চাইলেন ভারতীয় দলে তাঁর ছেলের আরও আগে জায়গা পাওয়া উচিত ছিল?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.