সন্দেশখালিতে চর্চায় শিবুর কীর্তি, কখনও ভয় দেখানো, কখনও জোর করে জলের দরে জমি হাতিয়ে নেওয়া

কখনও ভয় দেখানো। কখনও জোর খাটিয়ে বাজারদরের এক-তৃতীয়াংশ দামে হাতিয়ে নেওয়া। আবার কখনও কেউ বেঁকে বসলে, লোক পাঠিয়ে ফসল কেটে ফেলা রাতারাতি। সন্দেশখালিতে কান পাতলেই অভিযোগ, এমন হাজারো ফন্দি-ফিকিরে সাধারণ মানুষের বিপুল জমি হাতিয়ে নিয়েছেন শিবপ্রসাদ হাজরা ওরফে শিবু!

একে গায়ে শাসকদলের ‘ছাপ’। তার উপরে মাথার উপরে হাত এলাকার ‘বেতাজ বাদশা’ শেখ শাহজাহানের বিশ্বস্ত শাগরেদের। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভয়ের চোটে ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও জমি দিয়ে দিতে হয়েছে অনেককে। এঁদেরই এক জন বলছিলেন, ‘‘না বলার উপায়ই ছিল না প্রায়। তবু কেউ বেগড়বাই করলে ধানিজমিতে নদীর নোনা জল ঢুকিয়ে দখল নিত শিবুর লোকজন!’’

শাহজাহান ‘বেপাত্তা’ হওয়ার পরে হাজারো ক্ষোভের জ্বালামুখ খুলে গিয়েছে সন্দেশখালিতে। মহিলাদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের উপরে অত্যাচার— সামনে আসছে বিভিন্ন অভিযোগ। অভিযোগ, গত সাত-আট বছরে এ ভাবেই সন্দেশখালি গ্রামে একরের পর এক জমি হাতিয়ে নিয়েছিলেন জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য শিবপ্রসাদ হাজরা এবং তাঁর বাহিনী। ইদানীং এ সবের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন গ্রামের মানুষ।

জেলিয়াখালি ৬ নম্বর স্লুস গেট চত্বরে বছর পাঁচেক আগে ৭-৮টি পরিবারের কাছ থেকে খুব অল্প দামে প্রায় ৮ একর জমি কেনেন শিবপ্রসাদ। সে সময়ে তিন লক্ষ টাকা বিঘা সেই জমির দাম শিবপ্রসাদ দিয়েছিলেন মাত্র এক লক্ষ টাকা করে। এই এলাকারই ৬ নম্বর পাড়ায়, যেখানে শিবপ্রসাদের পোলট্রি, সেই জমির পরিমাণও নয় নয় করে আট একর। এখানে কিছু পরিবারের বাস ছিল। তাঁরা জমি ছাড়তে চাননি। অভিযোগ, জোর করে জায়গা-জমি লিখিয়ে নিয়ে, মারধর করে তাঁদের গ্রামছাড়া করা হয়।

পোলট্রির উল্টো দিকেই শিবপ্রসাদের মদের দোকান। সংলগ্ন প্রায় ৩-৪ একর জমিতে মাছ চাষ করেন তিনি। এই জমিও গ্রামের লোককে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করেছিলেন বলে অভিযোগ। জেলিয়াখালি পঞ্চায়েতের ভাঙা তুষখালি মৌজায় প্রায় ৭০০ বিঘা জমি লিজ়ে নিয়ে শিবপ্রসাদ মাছের চাষ করেন। বছর তিনেক ধরে চলছে সেই কারবার। বহু মানুষকে লিজ়ের টাকা দেননি, টাকা চাইলে উল্টে মারধর করতেন বলে জানাচ্ছেন অনেকে।

জমি দখলের আরও কৌশলের কথাও শোনা যাচ্ছে এখন। স্থানীয় এক মহিলা বলেন, “আমাদের তিন বিঘা ধানিজমি ছিল। মাছ চাষের জন্য দিতে চাইনি। জমির পাকা ধান কেটে নেয় শিবুর লোকজন।” জমি দিতে অনিচ্ছুক অনেকের জমিতে নদীর নোনা জল ঢুকিয়ে চাষ বন্ধ করে দেওয়া হত। বাধ্য হয়ে অনেকে চাষের জমি মাছের ফলনের জন্য ছেড়ে দিতেন সামান্য দামে। যদিও সেই টাকাও নাকি অনেকে পাননি!

সন্দেশখালি-২ ব্লক অফিস ও থানার সামনে একটি জলাভূমি ভরাট করার অভিযোগ আছে শিবুর বিরুদ্ধে। মালিককে সামান্য কয়েক হাজার টাকা হাতে ধরিয়েছিলেন। শিবুর দাপটে কেউ মুখ খোলেননি সেই সময়ে। ওই জমি ভরাট করে দরমার বেড়া দিয়ে স্কুল তৈরি হচ্ছে। গ্রামের এক মহিলার কথায়, “স্কুল তৈরি তো বাহানা। আসলে জায়গাটা নজরে পড়েছে শিবুর, তাই যে ভাবে হোক দখলে রাখতেই এমন কাজ।”

এই জায়গাতেই রাস্তার উল্টো দিকে একটি জলাশয়ের পাশে খাস জমিতে কিছু জনের বাস ছিল বহু বছর ধরে। জমি কেড়ে নিয়ে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক বৃদ্ধা জানালেন, শিবপ্রসাদ বছর দেড়েক আগে হুমকি দিয়ে জমি ছেড়ে শহরে গিয়ে থাকতে বলেন। পরে বহু কাকুতি-মিনতির দরুন সরু একফালি অংশে একখানা ঘর করে দেন। বৃদ্ধা বলেন, “কত ফলের গাছ লাগিয়েছিলাম। শিবু সব চোখের সামনে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল।”

এলাকার এক প্রবীণ ব্যক্তির কথায়, “সন্দেশখালিতে এসে যে দিকে তাকাবেন, সে দিকেই শিবুর কিছু না কিছু জমি চোখে পড়বে! কত লোকের যে চোখের জল আর হা-হুতাশ মিশে আছে তাতে, তা বলার নয়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.