শুনানি শেষ, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে রাতের ৪৭ মিনিট, কী কী হল ডিরেক্টর মামলায়?

ডিরেক্টর মামলায় রাত পর্যন্ত আদালতে থাকবেন বলে জানিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই মতো বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ৭ মিনিটে তাঁর এজলাসে শুনানি শুরু হয়। চলে ৪৭ মিনিট। এই মামলার তদন্তভার ইডির হাতে দিয়েছিলেন বিচারপতি। দুই সংস্থার পাঁচ ডিরেক্টরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেছিলেন। এজলাসে বসে প্রথমেই সেই জিজ্ঞাসাবাদের খোঁজ নেন তিনি।

মামলাকারীদের তরফে আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বিচারপতিকে জানান, রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব চলেছে। ইডির আইনজীবী ধীরজ ত্রিবেদীকে ডাকেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি তখনও এজলাসে পৌঁছননি। আইনজীবী চট্টোপাধ্যায় জানান, ইডির আইনজীবীকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি শীঘ্রই আসছেন।

মামলাকারীদের আইনজীবী আরও জানান, যে দুই সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের সম্পর্কে ইন্টারনেটে বিস্তারিত খোঁজ করেছিলেন তিনি। দেখা গিয়েছে, একই ঠিকানায় ন’টি সংস্থা রয়েছে।

ডেল্টা লিমিটেড এবং ওলিসা রিয়্যালিটি প্রাইভেট লিমিটেড নামক দুই সংস্থার বিরুদ্ধে কয়েক জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আদালতে মামলা করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, সংস্থার তরফে তাঁদের প্রাপ্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেওয়া হচ্ছে না। ওই মামলাতেই দুই সংস্থার পাঁচ জন ডিরেক্টরকে তলব করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার তাঁরা আদালতে হাজির হয়েছিলেন। বিচারপতি তাঁদের সংস্থা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেন। কিন্তু তাঁরা কোনও প্রশ্নেরই উপযুক্ত জবাব দিতে পারেননি।

বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, দুই সংস্থা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না এই পাঁচ ডিরেক্টর। সংস্থার আয়-ব্যয়, কার্যপ্রণালী সম্পর্কে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি তাঁরা। জুট মিলের সুপারভাইজ়ার থেকে তাঁরা ডিরেক্টর হয়েছেন। বিচারপতির নির্দেশ, হাই কোর্টের শেরিফের অফিসেই ওই ডিরেক্টরদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। এই সংস্থার সঙ্গে পাট শিল্পের ‘বড় বড় মাথা’ যুক্ত আছেন বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন বিচারপতি। বলেন, ‘‘ওঁরা আমার বদলিও করে দিতে পারেন। কিন্তু আমি এ সব বরদাস্ত করব না।’’

সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)-কে ওই পাঁচ ডিরেক্টরকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সে সময়েই জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে তিনি রাত ১০টা পর্যন্ত আদালতে থাকবেন। রাতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে আইনজীবীদের সওয়াল পর্ব এবং বিচারপতির বক্তব্য নীচে তুলে ধরা হল।

মামলাকারীদের আইনজীবীকে বিচারপতি: আপনার মক্কেল পিএফের কত টাকা পাননি?

আইনজীবী চট্টোপাধ্যায়: একটিতে ২ লক্ষ ১১ হাজার। অন্যটিতে ২ লক্ষ ৬৪ হাজার।

বিচারপতি: একটি কোম্পানি তো প্রায় কোটি টাকা বাকি রেখেছে।

এজলাসে আসেন ইডির আইনজীবী ধীরজ।

ইডির আইনজীবী: ইডি এখনও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেনি।

বিচারপতি: কেন? এফআইআর দায়ের করা হয়নি বলে?

ইডির আইনজীবী: কোনও শিডিউল অফেন্স-এর ক্ষেত্রে ইডি তদন্ত শুরু করতে পারে।

বিচারপতি: এসএফআইও জিজ্ঞাসাবাদ করে কী পেয়েছে? সংক্ষেপে বলুন। শুক্রবার বিকেল ৩টেয় বিস্তারিত রিপোর্ট দেবেন।

এসএফআইও: আমার জানাতে পেরেছি সুনীল ঝুনঝুনওয়ালা নামে এক ব্যক্তি এই সংস্থার সঙ্গে জড়িত। এই পাঁচ জনের কেউ সংস্থার আসল ডিরেক্টর নন। এদের ১০ হাজার টাকা দিয়ে ডিরেক্টর করে দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি: পিএফ কর্তৃপক্ষের কেউ ভার্চুয়াল মাধ্যমে রয়েছেন?

শেরিফের দফতর থেকে ওই পাঁচ ‘নকল’ ডিরেক্টরকে এজলাসে নিয়ে আসতে বলেন বিচারপতি। শুনানি চলাকালীন এক এসএফআইও আধিকারিককে ভর্ৎসনাও করেন তিনি। বলেন, ‘‘আপনি কে? কেন এই কোর্টকে পরামর্শ দিচ্ছেন। নিজের কাজ করুন। পরামর্শ দিতে হলে ডিভিশন বেঞ্চ আর সুপ্রিম কোর্টকে দিন।’’

বিচারপতি: ওই দুই সংস্থার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা উচিত। কেন এফআইআর দায়ের করা যাবে না ব্যাখ্যা দিন। কোম্পানির আইন কী বলছে?

এসএফআইও আইনজীবী: ওই আইন পড়ে দেখলাম, এফআইআর করা যায়।

বিচারপতি: তা হলে কেন বললেন এফআইআর দায়ের করা যায় না? কাদের দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করানো হয়েছে?

এসএফআইও অফিসারকে বিচারপতি: এফআইআর দায়ের কে করে?

ওই অফিসার: কোনও ব্যক্তি করেন।

বিচারপতি: কিছুই জানেন না দেখছি। পিছনের আসনে গিয়ে বসুন।

বিচারপতি: অভিযোগ যে কেউ করতে পারেন। কিন্তু এফআইআর পুলিশ করে।

বিচারপতি: কোম্পানি আইনের ধারা ৪৪৭ অনুযায়ী কোনও অপরাধ হয়েছে কি না তা খুঁজে বার করুন।

এসএফআইও: ঠিক আছে ধর্মাবতার। আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করব।

বিচারপতি: শুক্রবার বিকেল ৩টেয় রিপোর্ট দিন। কী কী অপরাধ হয়েছে, তার আগে খুঁজে বার করুন।

বিচারপতি: এসএফআইও নিজেদের মর্যাদা বজায় রেখে কাজ করে যান। ব্যর্থ হবেন না।

রাত ১০টা ৫৪ মিনিটে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে ডিরেক্টর মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। এফআইআর দায়ের হলে দ্রুত তদন্ত শুরু করতে হবে বলে ইডিকে জানান বিচারপতি। ওই পাঁচ ডিরেক্টরের মোবাইল ফোন ফেরত দিতে বলেন। শুক্রবার বিকেল ৩টেয় এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।

পাঁচ ডিরেক্টরকে এখনই গ্রেফতার করা যাবে না বলে আগেই জানিয়েছিলেন বিচারপতি। কোনও ভাবে যেন তাঁদের সম্মানহানি না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে বলেছিলেন। শুনানি শেষে ওই পাঁচ জনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের উপর কেউ অত্যাচার করেছে? কেউ দুর্ব্যবহার করেছেন?’’ প্রত্যেকেই উত্তরে ‘না’ বলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.