মেম-সাহেবদের আলিশান সময় ঝিলিক দেবে বোটানিক্যালে! লড়ে যাচ্ছেন স্থপতি দম্পতি

সবই এক সময়ে কোম্পানির সম্পত্তি ছিল। তার পর কোম্পানির সূর্যাস্ত হয় আর সরকার বাহাদুর সব সম্পত্তি নিয়ে নেয়। ইংরেজ সরকার চলে যাওয়ার পরেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাবেক সম্পত্তিগুলি ছিল। বেশির ভাগই বাড়ি। যে হেতু কলকাতা থেকেই এ দেশে কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়, তাই বিলিতি কায়দার সে সব বাড়ি বেশি ছিল দেশের এ প্রান্তেই। কোম্পানির সাহেবরা এসে থাকবেন, দফতর সামলাবেন বলে কম বাড়ি তো তৈরি হয়নি!

১৯১১ সালে রাজধানী সরে যায় নয়াদিল্লিতে। গুরুত্ব ফিকে হতে থাকে কলকাতার। ’৪৭-এর পর এই বাড়িগুলির যত্নআত্তিতে ভাটা পড়ে। শুধু কলকাতায় নয়। দেশের প্রায় সর্বত্র।

কোম্পানি আমলের বহু বাড়িই এখন পুরো ভেঙেচুরে গিয়েছে। কলকাতায় সে সব বাড়ি দেখভাল করার বিশেষ চল নেই। রক্ষণাবেক্ষণ শুধু কয়েকটিরই হয়, যেগুলির এখনও ব্যবহার রয়েছে। যেমন রাজভবন, আলিপুরের কাছে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের বাড়িটি বা ন্যাশনাল লাইব্রেরি। কিন্তু আরও অনেক বাড়িই ছিল। সেগুলি ছিল তুলনায় সাধারণ। সরকারি কাজের জন্য নয়। তাই ততটা নজরও দেওয়া হয়নি। তবে সে সব বাড়িও পুরনো কলকাতার ঐতিহ্য-মাখা। জমকালো অতীতের রেশ আছে তাতে, এখনও সাহেব-মেমদের সে সময়ের জীবনের ঝলক দেখা যায়। হাওড়ার শিবপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনের অন্তর্গত রক্সবরা হাউস তেমনই একটি বাড়ি। হুগলি নদীর ধারে এই বাংলোর চেহারা কিন্তু সে কালে ছিল বেশ রাজকীয়। এক ধারে নদীর বিস্তার, আর অন্য দিকে রকমারি গাছগাছালিতে ঘেরা প্রাঙ্গণ। তার মধ্যে ঘোরানো সিঁড়ি, গাড়িবারান্দার তিনতলা বাংলো। কিন্তু কালের নিয়মেই তার জেল্লা মলিন হয়ে গিয়েছে।

Kolkata based architects working to restore the ruins of the colonial Roxburgh House

বোটানিক্যাল গার্ডেন তৈরি হয়েছিল পলাশির যুদ্ধের ৩০ বছর পরে। ১৭৮৭-তে। ১৭৯৩ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম রক্সবরা এই বাগানের দায়িত্বে আসেন। তাঁর হাতেই আরও বড় হয়ে ওঠে আজকের ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বটানিক গার্ডেন’। আর গার্ডেনের ভিতরে রক্সবরা সাহেবের বাসভবনটি পরিচিত হয় রক্সবরা হাউস নামে। কিন্তু সময়ের কাঠিন্যে সেই রক্সবরা হাউসের পরিণতিও আর পাঁচটি ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের মতো হয়। গার্ডেনের দেখভাল হলেও যিনি সেই বাগানটি দেখাশোনা করে বাড়িয়ে তুলেছিলেন, তাঁর বাড়িটির হাল এখন লঝ্‌ঝড়ে।

অথচ কলকাতা থেকে মাত্র আধ ঘণ্টার দূরত্ব। শিবপুরে হুগলি নদীর হাওয়া খেতে খেতে রক্সবরা হাউসের ব্যালকনিতে বসে বিলাসযাপন করা খুব কষ্টসাধ্য বিষয় নয়। শুধু যদি হয় বাড়িটির দেখভাল। সেটিই হয়ে ওঠেনি। দেশ জুড়ে হেরিটেজ পর্যটন নিয়ে হইচই হলেও কলকাতায় সে হাওয়া এখনও খানিকটা কম। শ্যামবাজার চত্বরের ক্যালকাটা বাংলো, দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজবাড়ি বাওয়ালি, হুগলির ইটাচুনা রাজবাড়ি নিয়ে যে মাতামাতি হয় না, তা নয়। তবে ইংরেজ আমলের অনেক বাড়িই আছে এ শহরের নানা প্রান্তে। সে সব নিয়ে এখনও তেমন ভাবনাচিন্তা হয় না।

সে সময়ে সাহেবদের জীবন ছিল একেবারেই অন্য রকম। সকালের জলখাবার, বিকেলের চা, সন্ধ্যার পার্টি— সব নিয়েই ঘটাপেটা। বাড়িও হত তেমন। চা-ঘর, সান্ধ্য আড্ডার বৈঠকখানার আদবকায়দাই ছিল আলাদা। মেম-সাহেবদের আলিশান জীবনের সামান্য কিছু চিহ্নমাত্রই এখন রয়ে গিয়েছে রক্সবরা হাউসের পেঁচানো সিঁড়ি, কারুকাজ করা দরজা-জানলায়। কিন্তু যত্নে সংরক্ষণ করলে এ বাড়িতে ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে হোটেল, সবই হতে পারে। এ বার সে কাজে হাত দিয়েছেন কলকাতার এক স্থপতি-যুগল। সঙ্গে আছে স্কটল্যান্ডের এক সংস্থাও।

Kolkata based architects working to restore the ruins of the colonial Roxburgh House

বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে অবশ্য এখনও স্পষ্ট ধারণা নেই সংরক্ষকদের। পুরনো বাড়িকে নতুন রূপ দিলে, নানা ভাবেই তা ব্যবহার করা যায়। দুনিয়া জুড়ে যখন পর্যটনকেন্দ্র তৈরির ঝোঁক বাড়ছে, তার মধ্যে কলকাতা ও আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন ঐতিহাসিক সময়ে সযত্নে তৈরি স্থাপত্যের সংরক্ষণ যে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করতে পারে, তা বুঝতে পারছেন কেউ কেউ। সে ভাবনা নিয়েই রক্সবরা হাউস সংরক্ষণের কাজে হাত দিয়েছেন স্থপতি নীলিনা দেব লাল ও তাঁর সংস্থা ‘আলেয়া অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট্‌স’। সঙ্গে আছে এডিনবরার সংস্থা ‘সিম্পসন অ্যান্ড ব্রাউন আর্কিটেক্টস’।

তবে হেরিটেজ সংস্কার বা সংরক্ষণ করলেই তো হল না। তার ব্যবহারও প্রয়োজন। কলকাতার টাউন হল যেমন সরকারের উদ্যোগে বেশ কয়েক বছর আগে সংস্কার করা হয়। ঘটা করে গড়া হয় কমিটি। কিন্তু তার ব্যবহার নিয়ে স্পষ্ট ধারণা যে ছিল না সে সময়ে, তা পরবর্তী কালে টের পাওয়া গেল। নিয়মিত কোনও ব্যবহার নেই টাউন হলের। সংরক্ষণ কমিটিতে ছিলেন শিল্পী গণেশ পাইন। ঘনিষ্ঠ মহলে নিজেই বলেছিলেন, এখন টাউন হলের ঠিক কী ব্যবহার হওয়া উচিত, তা তাঁর গোচরে নেই। অথচ ব্যবহারের কথা পরিকল্পনা না-করে সংরক্ষণ করলে, কিছু দিনেই সেই বাড়ির প্রতি আগ্রহ হারাতে পারেন নাগরিকেরা। ফলে আদতে সে কাজ তেমন ভাবে কাজে লাগে না। আনন্দবাজার অনলাইনকে নীলিনা জানান, আপাতত রক্সবরা হাউসের কিছু অংশ সংরক্ষণ করে সেখানে ক্যাফে, শিশুদের খেলাধুলোর জায়গা করার ভাবনা আছে। সঙ্গে নদীতে লঞ্চ পরিষেবা চালু করতে চান তাঁরা। পরে বাকি কাজের পরিকল্পনা করবেন।

নীলিনাও জানেন, নিয়মিত ব্যবহারের মতো করে সংরক্ষণ না করা গেলে, সে বাড়ি কারও কাজে লাগবে না। ফলে ঠিক অবস্থায় তা থাকবেও না। বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রাঙ্গণে আরও দু’টি বাড়ি আছে। ‘ওল্ড হারবেরিয়াম লাইব্রেরি’ এবং ‘ওল্ড সিড স্টোর’। পরে ধীরে ধীরে হাত দেওয়া হবে সেই দু’টিতে। এই সংগঠনের বিশ্বাস, এ ধরনের সংরক্ষণের কাজ ভাল ভাবে হলে আগামী দিনে এই সব স্থাপত্যই বাণিজ্যকে কিছুটা কলকাতামুখী করবে।

বাণিজ্য বাড়াতে আরও কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গ প্রয়োজন বলেও মনে করেন নীলিনা। এখনও সবটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা স্পষ্ট নয়। তবে ইচ্ছা, যদি কোনও বড় হোটেল সংস্থা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়, তা হলে এখানে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে কোনও একটি বাড়িতে। কনফারেন্স রুমও করার ইচ্ছা নীলিনার। তিনি বলেন, ‘‘খুব নামী হোটেল ছাড়া এ শহরে কনফারেন্সের ভাল জায়গা তৈরি হয়নি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে এই বাড়িগুলিতে কয়েকটি কনফারেন্স হল করার ইচ্ছা আছে। তবে অর্থের জোগান যেমন পাব, ভাবনা সে ভাবে এগোবে।’’

Kolkata based architects working to restore the ruins of the colonial Roxburgh House

এখন দেশ জুড়ে হেরিটেজ পর্যটনের হাওয়া। ইতিহাস ফিরে দেখার ইচ্ছা যেমন আছে, তার চেয়েও বেশি আছে রাজা-রানিদের বাড়িতে এক-আধ দিন রাজকীয় মেজাজে ছুটি কাটানোর প্রবণতা। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লির আশপাশে বেশ কিছু পুরনো কেল্লা কিংবা রাজবাড়ি পরিণত হয়েছে হোটেল। রমরমিয়ে চলছেও। রাজস্থানে চিতোর কেল্লা থেকে নীমরানা কেল্লা, গুজরাতের আমদাবাদে দ্য হাউস অফ এমজি— রাজা-মহারাজা, মেম-সাহেবদের এমন সব বাড়িতে দু’-একটি দিন কাটানোর জন্য অনেকেই নানা প্রান্ত থেকে ছুটে যান। এক-দু’দিনের রাজকীয় যাপনে আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। কলকাতা শহর ও আশপাশের অঞ্চলে বহু পুরনো বাড়ি আছে। কয়েকটি নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে, তবে সাহেবদের আমলের আরও বহু বাড়ি আছে, যা এখনও বিশেষ নজরে পড়েনি।

Kolkata based architects working to restore the ruins of the colonial Roxburgh House

২০১০ সাল থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের বাড়ি সংস্কার ও সংরক্ষণের কথা ভাবছেন নীলিনারা। তবে কাজটি বড়, নিয়মেরও অনেক ধাপ আছে। সব মিলে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড়ায়। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার সায় দিলে তাঁরা নামেন অর্থের সন্ধানে। নীলিনা বলেন, ‘‘বিপুল খরচের কাজ এটি। বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে আমরা কাজটি করে চলেছি।’’ সবটা শেষ হয়ে গেলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের চেহারা বদলে যাবে। নদীতে ফেরি চলাচলের ব্যবস্থা করার ভাবনাও আছে তাঁদের। সরকার পাশে আছে, তাই স্থপতির আশা, সে সবও হয়ে যাবে। নীলিনাদের সঙ্গে আছে বিলেতের ‘কমনওয়েলথ হেরিটেজ ফোরাম’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড মিউজ়িয়াম ফান্ডস ইন্ডিয়া’। দেশ ও বিদেশ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন আরও কেউ কেউ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.