লোকনায়ক শ্রীরামপর্ব-৩ / দিঃ ১৫ জানুয়ারী ২০২৪।

শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ ঋষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গে হেঁটে চলেছেন। তারা গঙ্গা নদী পার হয়ে দক্ষিণ তীরে আসে। আবার শুরু হয় অভিবাসন। এখন পথে আসে এক ভয়ানক জঙ্গল, যেখানে সিংহ, বাঘ, হাতির মতো প্রাণী বিচরণ করছে। কিন্তু এই বনের কিছু জায়গায় মানুষের বসবাসের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। কোথাও ছিল ভাঙা প্রাসাদ, কোথাও জঙ্গলে ঘেরা, কোথাও ভাঙা ও উপড়ে যাওয়া পথ, আবার কোথাও নির্জন স্তম্ভ…

এই সব দেখে শ্রীরাম ঋষি বিশ্বামিত্রকে জিজ্ঞেস করেন, “মুনিবর, এ সব কী? ঘন জঙ্গল এবং মানুষের বসবাসের অবশিষ্টাংশ…” বিশ্বামিত্র ব্যাখ্যা করেন, “নরশ্রেষ্ঠ, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এখানে দুটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল – মালাদ এবং কারুশ। বলা যায় যে এই জনপদগুলি দেবতাদের প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছিল। তারা সম্পদ ও শস্যে সমৃদ্ধ ছিল। তারা ছিল সমৃদ্ধশালী।

কিন্তু কয়েক বছর আগে এখানে সন্ত্রাসের ছায়া পড়তে শুরু করে। ‘তটক বা তাড়কা’ নামে এক রাক্ষসী মহিলা যক্ষিণী রূপে এসেছিলেন। তিনি সুন্দা নামে এক রাক্ষসের স্ত্রী। মারিচ, দুষ্ট রাবণের অনুচারি, এই তাড়কার পুত্র।

বলং নাগসহস্রস্য ধারয়ন্তি তদা হ্যভূত্।
তাটকা নাম ভদ্রম্ তে ভার্যা সুন্দস্য ধীমৎ ॥২৬॥
মারিচো রাক্ষসঃ পুত্রো যশ্যাশ্শক্রপরাক্রমঃ।
বৃত্তবাহুর্মহাবীর্যো বিপুলাস্য তনুর্মহান ॥২৭॥
(বালকান্ড/চবতুর্বিংশতি সর্গ)

“এই তাড়কা এই দুই জনপদে আতঙ্কের তান্ডব মাতিয়ে রেখেছে। এখান থেকে মানুষ পালিয়ে অন্য স্থানে আশ্রয় নেয়। কয়েকদিনের মধ্যেই এই সমৃদ্ধশালী অঞ্চলটি ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে আর কোনো মানুষের বসতি নেই। ঘন গাছপালা সম্পূর্ণ এলাকা জুড়ে ফুটে উঠেছে এবং অনেক হিংস্র প্রাণী এখানে বাস করে।”

“এই অঞ্চলের ধ্বংসকারী তাড়কা এখন ছয় ক্রোশ দূরে ‘তাটকা বনে’ বাস করে। হে রাজকুমার, আমার অনুমতি নিয়ে তুমি এই দুষ্ট মহিলাকে হত্যা করে এই আনন্দময় দেশে সন্ত্রাসের কারণে আজ কেউ সাহস করে আসে না। সেজন্য এই দেশকে আবার ভয়মুক্ত কর।”

স্ববাহুবলমাশ্রিত্য জহীমাং দুষ্টচারিণীম্।
মন্নিযোগাদিমং দেশং কুরু নিস্কণ্টকং পুনঃ ॥৩১॥
(বালকান্ড/চতুর্বিংশতি সর্গ)

ঋষি বিশ্বামিত্রের কথায় যেন শ্রীরামের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা শুরু হয়েছে। এই দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে মনে মনে বদ্ধপরিকর শ্রীরাম!

শ্রীরাম ঋষি বিশ্বামিত্রকে আশ্বস্ত করে বলেন, “প্রভু, অযোধ্যায় আমার পিতা মহামনা মহারাজ দশরথ আপনাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমার পিতা আমাকে আপনার প্রতিটি আদেশ পালন করতে বলেছেন। তাই, আমি আজ্ঞানুসারে গো, ব্রাহ্মণ ও দেশের কল্যাণে আমি আপনার মতো অনন্য ও প্রভাবশালী মহাত্মার আদেশ সম্পূর্ণরূপে পালন করব।”

গোব্রাহ্মণহিতার্থয় দেশস্যাস্য সুখায় চ।
তব চৈবাপ্রমেয়স্য বচনম্ কর্তুমুদ্যতঃ ॥৫॥
(বালকান্ড/ষড়বিংশতিঃ সর্গ)

‘তাটকা বনে’ পৌঁছানোর সাথে সাথে শ্রীরাম তাঁর ধনুকের গুনায় ভীষণ টঙ্কার দিয়ে রাক্ষসী তাড়কাকে আহ্বান করলেন। ক্রোধান্বিত হয়ে তাড়কা এগিয়ে এলেন। সেই রাক্ষসের দিকে তাকিয়ে শ্রীরাম তার ভাই লক্ষ্মণকে বললেন, “লক্ষ্মণ, এই যক্ষিণীর দিকে তাকিয়ে দেখ, এই যক্ষিণী‌ কতটা ভয়াল ও ভয়ঙ্কর।”

এদিকে তাড়কা ধুয়াধার ধুলোর আড়াল থেকে শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে আক্রমণ করে। ধুলোর আড়ালে, রাক্ষস বড় বড় পাথর দিয়ে শ্রী রাম ও লক্ষ্মণকে আক্রমণ করতে শুরু করে।

কিন্তু ধনুর্ধারী শ্রীরাম তাঁর ধনুকের তীর বর্ষণে সেই সমস্ত পাথর শুধু ভেঙ্গে দেন, তাঁর অভ্রান্ত তীরের আঘাতে সেই অসুরের উভয় হাতও কেটে ফেলেছিলেন। যখন তাড়কার বাহু কেটে গেল, তখন সে আরও ভয়ানক স্বরে গর্জন করতে লাগল।

কিন্তু তিনি ছিলেন যক্ষিণী। অতএব, তিনি তার রূপ পরিবর্তন করে মায়াবী রূপ নিয়ে শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে মোহিত করতে থাকেন। তা দেখে শ্রীরাম দেরি না করে একটি শব্দভেদি বাণ নিক্ষেপ করলেন। এই বাণ তাড়কার বুকে লেগে যায় এবং সে পড়ে মারা গেল।

ঋষি বিশ্বামিত্র ও অন্যান্য ঋষিগণ শ্রীরামের এই পরাক্রম দেখে অভিভূত হলেন। শ্রীরাম অনায়াসে বহু বছরের সন্ত্রাস ধ্বংস করে দিলেন। এই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বামিত্র শ্রীরামকে দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান দেন, এছাড়াও অনেক অস্ত্র ধ্বংস করার পদ্ধতি শিখিয়ে ছিলেন।

ঋষি বিশ্বামিত্র শ্রীরাম ও লক্ষ্মণকে তাঁর সিদ্ধাশ্রমে নিয়ে আসেন। এটি একটি পবিত্র স্থান, দেবাধিদেব শ্রীবিষ্ণুর তপোস্থলী। বামন অবতারের আগে শ্রীবিষ্ণু এই স্থানে তপস্যা করেছিলেন। এটি পবিত্র ভূমি।

বিশ্বামিত্র শ্রীরামকে বলেন, “এই আশ্রমেই আমার যজ্ঞে বিঘ্নকারী অসুররা আসে। হে পুরুষ সিংহ, তোমাকে এখানেই সেই দূরাচারীদের বধ করতে হবে।”

এতমাশ্রমমায়ান্তি রাক্ষসা বিঘ্নকারিণঃ।
অত্রৈব পুরুষব্যঘ্র হন্তব্যা দুষ্টচারিণঃ ॥২৩॥
(বালকান্ড/উনবিংশতি সর্গ)

ঋষি বিশ্বামিত্র এবং অন্যান্য ঋষিগণ শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণের উপস্থিতিতে আশ্বস্ত হয়ে মহান আচার অনুষ্ঠান শুরু করে দেন। পাঁচ দিন নির্বিঘ্নে কেটে যায়। ষষ্ঠীর দিন, দেবী দ্বারা পরিবেষ্টিত যজ্ঞবেদি প্রজ্জ্বলিত হয়। যজ্ঞের অগ্নিশিখা মধ্য গগন ছুঁয়েছে। এ যেন দানবদের জন্য একটি সংকেত মাত্র।

ভয়ঙ্কর চিৎকার ও গর্জনে মারিচ ও সুবাহু তাদের সৈন্যবাহিনীসহ যজ্ঞমণ্ডপের দিকে ছুটে আসে। ভয়ঙ্কর চেহারার রাক্ষসদের পুরো বাহিনী তাদের সাথে আছে। আজ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই অত্যাশ্চর্য যুবক। বেশ শান্ত স্বভাবী, মুখোবয়বে এক সৌম দীপ্ত অনুরাগ। দুজনেই ধনুর্ধারী। হাত দিয়ে টেনে ধরে রেখেছে ধনুকের গুনা, আবার খাপ থেকে তীর বার করে ধনুরগুনায় সংযুক্ত করে রাখেন।

যজ্ঞবেদীকে অপবিত্র করার জন্য কলসে রক্ত নিয়ে এসে অপবিত্র করার চেষ্টা করলেই এই দুই তীরন্দাজ রাজপুত্র শুরু তীরের প্রবল বৃষ্টি। এই সময় তাদের সেই কলসের রক্ত রাক্ষসদের দেহে ছিটিয়ে পড়ে।

শ্রীরাম এই রাক্ষসদের সেনাপতি মারিচকে মানবাস্ত্র দিয়ে গভীর আঘাত দেন। এই মানবাস্ত্রের প্রভাব এতই ব্যাপক যে মারিচ একশত যোজন পিছিয়ে গিয়ে সাগরে ছিটকে পড়ে যান।

স তেন পরমাস্ত্রেণ মানবেন সমিতঃ।
সম্পূর্নম্ যোজনশতং ক্ষিপ্তস্সাগর সম্পলবে ॥১৭॥
বিচেতনং বিঘুর্ণন্তম্ শীতেষু বলতাদিতম্।
নিরস্তং দৃশ্য মারিচং রামো লক্ষ্মণমব্রবীৎ ॥১৮॥
(বালকান্ড/ত্রিংশতি সর্গ)

এখানে লক্ষ্মণও তাঁর আগ্নেয়াস্ত্র সুবাহুর বুকে ছুঁড়ে মারে, ভীত সুবাহু সেখানেই মারা যায়।

শ্রীরাম ও লক্ষ্মণের বিদ্যুৎ গতিতে আসা তীরের বৃষ্টির কারণে মারিচ-সুবাহুর অবশিষ্ট সেনাও নিহত হয়। সিদ্ধাশ্রমের পুরো এলাকা অসুরমুক্ত হতো। সন্ত্রাস থেকে মুক্ত..!

ঋষি,মুনি ও মহর্ষিগণ অত্যন্ত আনন্দিত। সন্ত্রাসের এই পৈশাচিক শক্তি তাদের সকলের জীবনকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছিল। এই সমস্ত ঋষিরা, জ্ঞান অর্জনের কথা বাদ দিয়ে, এমনকি তাদের প্রতিদিনের যজ্ঞ করতেও অক্ষম পড়েছিলেন।

এখন তাঁরা সমস্ত নির্ভরযোগ্যতার সাথে যাগ-যজ্ঞ, আচারাদি করতে পারবেন।

এবার ঋষি বিশ্বামিত্রের অন্য কিছু মনে আসে। তিনি এই দুই রাজকুমারকে মিথিলায় নিয়ে যেতে চাইলেন। রাজা জনক মিথিলায় একটি ধর্মীয় যজ্ঞ করবেন বলে ঠিক হয়েছে এবং জনক রাজকন্যা সীতার স্বয়ম্বর আয়োজন করা হবে বলে জেনেছেন। বিশ্বামিত্রের বিশ্বাস, এই অনুষ্ঠানে শ্রীরামের উপস্থিত থাকা আবশ্যক।
বিশ্বামিত্র ও অন্যান্য ঋষিদের নিয়ে মিথিলার দিকে রওনা হয়েছেন সঙ্গে লক্ষ্মণ ও শ্রীরাম ..!

  • প্রশান্ত পোল
    (ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.