কালচক্রের গতি দ্রুত ঘুরে চলেছে। ঘুরতে ঘুরতে ফিরে যাচ্ছে পেছনের দিকে। পেছনে! অনেক পিছনে! ইতিহাসের পৃষ্ঠা আমাদের নিয়ে যায় ত্রেতাযুগে। হাজার হাজার বছর আগে কথা..!
এই ত্রেতাযুগে একটি বিশাল ভূমি যা আর্যাবর্ত নামে পরিচিত। এটি মানব সংস্কৃতির একটি উন্নত ক্ষেত্র। এটি একটি সম্বৃদ্ধ দেশ। যে সমাজ উদাত্ত এবং মহৎ মানবিক আবেগে অনুপ্রাণিত। যেখানে জ্ঞানের তৃষ্ণা আহরণ করে অধ্যয়নরত ছাত্র। নতুন নতুন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এমন উন্নত ঋষি সংস্কৃতি সমাজে প্রভাব পড়েছে। যাগ-যজ্ঞের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল এবং সমাজজীবন উভয় ক্ষেত্রেই শুদ্ধিকরণের একটি অবিরাম প্রক্রিয়া চলেছে। দেবাধিদেব পৃথিবীর বুকে অবস্থিত এই আর্যাবর্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। এ বিষয়ে তাঁরা অগ্রসর হতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী।
এই আর্যাবর্তে সরযূ নদীর তীরে ‘কোশল’ নামে বিখ্যাত এক সমৃদ্ধ, ধন-সম্পদ, সুখ ও আনন্দে অবস্থিত একটি বড় জনপদ।
কোসলো নাম মুদিতঃ স্ফিতো জনপদো মহান।
নিবিষ্টঃ সর্যুতিরে প্রভুতধনধান্যবান ॥৫॥
(বাল্মীকি রামায়ণ / বালকাণ্ড / পঞ্চম সর্গ)
এই জনপদের রাজধানী অযোধ্যা আর্যাবর্ত বা বিশ্ব জুড়ে বিখ্যাত। অযোধ্যা, যেখানে কোলাহল নেই, হিংসা- দ্বেষ বা যুদ্ধ নেই। শ্রেষ্ঠ নগরী, স্বয়ং মনু মহারাজ নিজেই জনবসতি স্থাপিত করেছিলেন।
অযোধ্যা নাম নগরী তত্রাসীল্লোকবিশ্রুতা।
মনুনা মানবেন্দ্রেণ য়া পুরী নির্মিতা স্বয়ম্ ॥৬॥
(বালকান্ড/পঞ্চম সর্গ)
এই নগরী অতি বিশাল, মহান। এটি বার যোজন (অর্থাৎ ১৫০ কিলোমিটার) দীর্ঘ এবং তিন যোজন (অর্থাৎ ৩৮ কিলোমিটার) প্রস্থ। এই শহরে প্রশস্ত রাজমার্গ বা পথ। লতা-পাতা, গাছ, ফল ও ফুলে শোভিত শহর। এই শহরের চারপাশে একটি গভীর পরিখা খনন করা রয়েছে। রয়েছে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এ শহরের মানুষ ভীষণ উদ্যমী, শিল্প প্রেমী। নাচ, গান, সঙ্গীত ও কলায় পারদর্শী। সকল নাগরিকই ধার্মিক, আত্মনিয়ন্ত্রিত, সুখী-সংযমী এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী।
পরাক্রমশালী রাজা দশরথ কোশল জনপদে শাসন করছেন, যার রাজধানী হিসাবে এমন একটি পবিত্র এবং সমৃদ্ধ নগরী রয়েছে। আকাশে বা সমস্ত নক্ষত্রলোকে চাঁদ যেমন স্নিগ্ধ করে তোলে, তেমনি রাজা দশরথও শীতল সুখদ প্রজাপালন করেন।
তাং পুরীং স মহাতেজা রাজা দশরথো মহান্।
শশাস শমিতামিত্রো নক্ষত্রাণিভ চন্দ্রমাঃ ॥২৭॥
(বালকান্ড/ষষ্ঠ সর্গ)
চন্দ্রপ্রতাপী রাজা দশরথ তাঁর অষ্টপ্রধান আমত্যগণ জনকল্যাণমূলক রাজ্য পরিচালনা করেছেন। তাঁর আটজন মন্ত্রীই উচ্চ গুণাবলী ও বিশুদ্ধ চিন্তায় পরিপূর্ণ। এই মন্ত্রীরা হলেন- ধৃষ্টি, জয়ন্ত, বিজয়, সৌরাষ্ট্র, রাষ্ট্রবর্ধন, অকোপ, ধর্মপাল এবং সুমন্ত্র। এঁদের মধ্যে সুমন্ত্র একজন বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী এবং রাজ্যের আর্থিক গতিবিধি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখেছেন।
মন্ত্রীগণ সকলে দেশের স্বার্থে এক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ। তাঁরা সবাই বিনয়ী, অস্ত্রশস্ত্র বিদ্যা জ্ঞানী, শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী। এছাড়াও ব্রহ্মঋষি সুযজ্ঞ, জাবালি, কাশ্যপ, গৌতম, দীর্ঘায়ু, মার্কণ্ডেয় ও কাত্যায়ন রাজা দশরথের শ্রেষ্ঠ পরামর্শ দাতাদের নিয়েই কোশলকে শাসন করেছেন গুণী রাজা দশরথ।
ইদ্রিশৈস্তৈরামত্যৈশ্চ রাজা দশর্থোऽনঘঃ।
উপান্নো গুণোপেতৈরন্বশাসদ্ বসুন্ধরাম্ ॥২০॥
(বালকান্ড/ বিংশতি সর্গ)
কিন্তু…
অযোধ্যা নগরী তো নিরাপদ রয়েছে কিন্তু অযোধ্যার বাইরে শুধু কোশল জনপদই নয়, সমগ্র আর্যাবর্তে ভয়ের কালো ছায়া নেমে এসেছে। সৃজন শক্তি ভয়ে আড়ষ্ট। মুনী,ঋষি ও ব্রহ্মঋষিদের পক্ষে যজ্ঞ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। অসুর শক্তি শুভ কাজ বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য ভীত থাকে।
এই সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দু সুদূর দক্ষিণে সিংহল দ্বীপ অর্থাৎ লঙ্কার অধিপতি রাজা রাবণ। পুলস্ত্য মুনির মতো একজন বিদ্বান ঋষির নাতি এবং বেদ পণ্ডিত বিশ্রব পুত্র। শিবের পরম ভক্ত। কিন্তু একজন অন্যায়, রাগী ও প্রতারক রাজা। যিনি সজ্জন শক্তিকে যন্ত্রণা দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করেন।
রাবণ আর্যাবর্ত জুড়ে একজন দানবীয় উৎপীড়ক রূপে পরিচিত হয়েছেন। সমস্ত দানবীয় বা পৈশাচিক প্রবণতার ফলে সাধারণ নাগরিকগণের অর্থ সম্পদ লুট করে, জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সমগ্র আর্যাবর্তের সৌম্য সজ্জন শক্তি রাবণের এই রাক্ষসি প্রবৃত্তির কারণে প্রচন্ড যন্ত্রনায় ভয়ভীতি হয়েছিল।
বিশ্ব সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর ভগবানের কাছে সজ্জন ব্যক্তিরা প্রার্থনা করছেন ‘যে রাবণ নামক দানব তোমার আশীর্বাদ পেয়ে তার শক্তি দিয়ে আমাদেরকে কঠিন যন্ত্রণা দিচ্ছে, কষ্ট দিয়ে চলেছে। একে পরাজিত করার ক্ষমতা আমাদের নেই। “সৃষ্টিকর্তা”, আপনি নিজেই কিছু উপায় করুন।’
ভগবংস্ত্বৎপ্রসাদেন রাবণো নম রাক্ষসঃ।
সর্বান্ নো বাধতে বীর্য্যচ্ছাসিতুং তং ন শক্নুমঃ ॥৬॥
(বালকান্ড/পঞ্চদশ সর্গ)
স্বর্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা পরম পিতা এই প্রার্থনা শ্রবণ করছেন। পৃথিবীর পুণ্যভূমি আর্যাবর্তে দশ দিকে রাবণের সৃষ্ট সর্বনাশও তিনি প্রত্যক্ষ করছেন। একভাবে সরাসরি রাবণের সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষ অনুভব করে দেখেছেন যে সজ্জন শক্তির সমস্যা হচ্ছে।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে মহাবিশ্বের স্রষ্টা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে আর্যাবর্তের নাগরিকদের নির্ভয়ে বসবাসের জন্য রাবণের ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু এই ধ্বংস কোন অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে ঘটবে না, এটা পরমেশ্বরই স্থির করেছেন। নরসিংহ অবতারে অলৌকিক ঘটনা আবশ্যক ছিল, কারণ হিরণ্যকশিপুতে এমন অসুর শক্তির সৃষ্টি হয়েছিল, যা কোনো সাধারণ মানুষের দ্বারা ধ্বংস করা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু এবার নয়।
এবার কোন অলৌকিক ঘটনা। এবারও যদি আমরা অলৌকিকভাবে রাবণকে ধ্বংস করি, তাহলে সজ্জন শক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। যখনই সমাজে পৈশাচিক প্রবণতা দেখা দেবে, তখনই এই কোমল শক্তি পরমেশ্বরের কোনো অবতারের জন্য অপেক্ষা করবে। সে সরাসরি যুদ্ধ করবে না।
এটা কোনভাবেই উচিত নয়।
এই কোমল সজ্জন শক্তির আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে হবে। তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি করতে হবে যে, সব ভালো শক্তি একত্রিত ও সংগঠিত হলে যে কোনো শক্তিশালী পৈশাচিক শক্তিকে পরাজিত করতে পারে। এতে মাধ্যম হয়ে উঠবে পরমেশ্বরের অংশগুলো। কিন্তু সৌম্য শক্তি সব লড়াই করবে।
ঈশ্বর অবশ্যই অবতার রূপে আসবেন কিন্তু কোন অলৌকিক ঘটনা ছাড়াই। তারা শুধুমাত্র সংগঠিত ভদ্র শক্তির মধ্যে দেবত্ব অবতরনের কাজ করবে। এর জন্য তিনি মাধ্যম হয়ে উঠবেন, আর্যাবর্তের পবিত্র নগরী অযোধ্যার চন্দ্রপ্রতাপী রাজা দশরথের পুত্রের রূপে।*
শ্রীরাম..!
- প্রশান্ত পোল
(ক্রমশঃ)