শ্রী রামের আদর্শে রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়া আর মার্ক্সবাদীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে ভাঙা-গড়ার তত্ত্ব সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তা। একদিকে কর্তব্য, ন্যায়পরায়ণতা, ত্যাগ ইত্যাদি ভারতীয় আদর্শকে সামনে রেখে শ্রদ্ধা-ভক্তির মাধ্যমে সমাজ জাগরণ আর অন্যদিকে অর্থকে কেন্দ্র করে সমাজে কড়াই গন্ডাই হিসাব বুঝে নেওয়ার অধিকারের দাবিতে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজের পুনর্গঠনের তত্ত্ব।
একদিকে সহস্রবছর ব্যাপি ভারতীয় সমাজে, ভারতীয় মননে রামভক্তির মাধ্যমে জাগরণের বাস্তবিক উদাহরণ আর অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে কমিউনিজমের রক্তাক্ত ইতিহাস আর তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তবের দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এই বিরোধ প্রকট হবার কারণ ভারতীয় সভ্যতাই এখন পৃথিবীর একমাত্র সভ্যতা যেখানে শত শত বৈদেশিক আক্রমণ সত্ত্বেও আপন আদর্শের অনুশীলন ও শ্রদ্ধার কেন্দ্রগুলিকে রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের নিরন্তর ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাস থেকেই ভারতবর্ষ প্রেরণা নিয়ে আপন রাষ্ট্রের সংস্কার ও শক্তিকেন্দ্রগুলিকে রক্ষা করার নতুন ইতিহাস রচনা করেছে।অযোধ্যায় রামজন্মভূমিতে রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণ তার অন্যতম উদাহরণ। কিন্তু ভারত যদি নিজের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলিকে এইভাবেই আচরণে অভ্যাসে আঁকড়ে থাকে তাহলে বিদেশীয় তত্ত্বের জন্য মাটি তৈরির কাজ বাধা পায়।তাই ভারতের মনোভূমিতে বিদেশীয় তত্ত্বের জায়গা পাকা করতে কখনো রামের ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় কখনো রামজন্মভূমিতে বিতর্কিত কাঠামোর নীচে রামমন্দিরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে নিয়ে মিথ্যা তথ্য পরিবেশিত হয় বিচারকের সামনে।
রামজন্মভূমি আন্দোলনে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিল
বিতর্কিত ঢাঁচাটি মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছিল কি না। ১৯৭৮ সালে ডঃ ব্রজবাসী লালের তত্ত্বাবধানে প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে ডঃ কে কে মুহম্মদ বাবরি মসজিদের দেওয়ালে মন্দিরের স্তম্ভের খোঁজ পান।
একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর হিন্দু মন্দিরের গঠনশৈলীর মতো কালো ব্যাসল্ট শিলার এই স্তম্ভগুলির নীচের দিকে হিন্দুরীতি অনুসারে আটটি শুভঙ্করী চিহ্ন অর্থাৎ ‘অষ্টমঙ্গলা’র একটি প্রতীক পূর্ণকলস অঙ্কিত ছিল।১৯৯২ সালে বিতর্কিত ঢাঁচার অবলুপ্তির আগে এইরকম ১৪ টি স্তম্ভ ছিল। সেই সময় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া সেখানে প্রায় দু’মাস ধরে সার্ভে চালায়। মসজিদের পিছনদিকে খননের পর ইঁটের তৈরি ভীত দেখা যায় যার ওপর স্তম্ভগুলির নির্মাণ হয়েছিল।১৯৯০ সালে যখন রামজন্মভূমি আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে, ডঃ কে কে মুহম্মদ বাবরি মসজিদের নীচে মন্দিরের অস্তিত্বের কথা বলেন।এই সময় থেকেই রোমিলা থাপার, বিপিন চন্দ্রের মতো কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা রামায়ণের ঐতিহাসিকতা, বাবরি মসজিদের নীচে রামমন্দিরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে।ডি এন ঝা, ইরফান হাবিব, প্রোফেসর আর এস শর্মা, সুরজ ভান এই দলে যুক্ত হয়। একমাত্র সুরজ ভান প্রত্নতাত্ত্বিক আর বাকিরা ঐতিহাসিক হিসেবে পরিচিত। বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির বিভিন্ন বৈঠকে সেই সময় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিক্যাল রিসার্চের চেয়ারম্যান ইরফান হাবিব সভাপতিত্ব করতেন।কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকদের এই দল বিভিন্ন সংবাদপত্র আর পত্রিকায় মসজিদের নীচে মন্দিরের অস্তিত্বের বিপক্ষে লিখতে থাকে। ফলে বিভ্রান্তি আরো বেড়ে সত্যকে স্বীকার করে রফার সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে থাকে। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে জে এন ইউ এর সেন্টার ফর হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজ থেকে প্রকাশিত ‘Babri Masjid – Ramjanmabhumi Dispute – An Analysis by Twenty-Five Historians’ এর মাধ্যমে রোমিলা থাপার, বিপিন চন্দ্রের মতো কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা এই বিতর্কে প্রথম যোগ দেয়।সেই সময় এইসব ঐতিহাসিকরা বলতে থাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে রামের পূজা হতো না।
কিন্তু ঐতিহাসিক প্রমাণ ঠিক এর বিপরীত।কৌশাম্বির খননকার্যে দ্বিতীয় শতাব্দীর টেরাকোটার রাবণের সীতাহরণের মূর্তি পাওয়া যায়।কাশ্মীরের ধ্বংসাবশেষ থেকে তৃতীয় শতাব্দীর সীতারাম অঙ্কিত সীল পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে শ্রীরামকথার বিভিন্ন অংশকে চিত্রিত করে মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে যার মধ্যে পঞ্চম শতকে ওয়ার্ধায় দ্বিতীয় প্রভরাসেনার নির্মিত মন্দিরটি উল্লেখযোগ্য।চতুর্থ শতাব্দীতে মহাকবি কালিদাসের রঘুবংশম-এ রাম আর হরিকে সমার্থক বলা হয়েছে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০৩ সালে খননকার্যের পর মন্দিরের চূড়ার বৃত্তীয় অংশ ‘আমলক’ ; আর বিগ্ৰহকে অভিষিক্ত করার পর জল নির্গমনের ‘মকর প্রণালি’ পাওয়া যায়। খননকার্যের সময় উপস্থিত ১৩১ জনের মধ্যে ৫২ জন মুসলিমকে রাখা হয় । শুধু তাই নয়; বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির সুরজ ভান, সুপ্রিয়া বর্মা, জয়া মেনন ঐ দলের মধ্যে ছিলেন।
২০১২ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট আর ২০১৯ এর নভেম্বরে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে পার্সিয়া, উর্দু, সংস্কৃতে লেখা ঐতিহাসিক তথ্যের বিশ্লেষণ হয়েছে। এসেছে ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব,জীববিদ্যা, পুরাণ এবং জাতকের কথার প্রসঙ্গ। নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ হিসেবে যে সমস্ত তথাকথিত ‘বিখ্যাত’ ঐতিহাসিকরা সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের দাবির পক্ষে ছিলেন তারা আদালতের সামনে খননের আগে আর পরে দুবারই নিজেদের খ্যাতির প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের জাস্টিস আগরওয়াল এই সমস্ত বিশেষজ্ঞদের দাবির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন।
সুপ্রিয়া বর্মা এ এস আই-এর খননকার্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন কিন্তু পরে আদালতে স্বীকার করেন মাটির নীচের পরিস্থিতি জানতে যে ‘রাডার সার্ভে’ হয়েছিল যার জন্য আদালত খননকার্যের নির্দেশ দেয় তা তিনি পড়ে দেখেন নি। খননের সময় উপস্থিত না থাকলেও শ্রীমতী বর্মা ও জয়া মেনন দাবি করেন খননকার্যে পাওয়া স্তম্ভগুলি বাইরে থেকে এনে রাখা হয়েছিল।
সুভীরা জয়সওয়াল স্বীকার করেন বিতর্কিত বাবরি মসজিদ সম্পর্কে যে রিপোর্ট তিনি দিয়েছিলেন তা খবরের কাগজ আর নিজের ইতিহাস বিভাগের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের এক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি করা। শ্রীমতী জয়সওয়াল স্পষ্ট করে বলেন, তিনি যে বয়ান দিয়েছেন তা তার নিজস্ব ‘মত’ ।
নিজস্ব ‘মত’ কে ‘ইতিহাস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া ঐতিহাসিক এই দেশের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ রামজন্মভূমি কেস।
প্রত্নতাত্ত্বিক শিরিন রত্নাগর স্বীকার করেন তার প্রত্মতত্ত্বের বিষয়ে কোনো ‘ফিল্ড এক্সপিরিয়েন্স’ অর্থাৎ বাস্তবিক কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
বাবরি মসজিদের পক্ষের অন্য এক সাক্ষী– প্রফেসর ডি মন্ডল ; যার বইয়ের ভূমিকা শিরিন লিখেছিলেন, তার আদালতে সাক্ষ্যদান আরো বেশি আশ্চর্যজনক। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ইতিহাস , সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রোফেসর ডি মন্ডলের ‘অযোধ্যা : আর্কিওলজি আফটার ডেমোলিশন’ বইটি লিখেছেন অযোধ্যার বাস্তবিক পরিস্থিতি স্বচক্ষে না দেখেই। এমনকি তিনি স্বীকার করেন বাবর সম্পর্কে তার জ্ঞান শুধুমাত্র এইটুকু যে, বাবর এক ষোড়শ শতাব্দীর মোঘল সম্রাট। আদালত ডি মন্ডলের জ্ঞানের অন্তঃসারশূন্যতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে কোনো দ্বিধা করেন নি আর সাক্ষী হিসেবে তার বৈধতাকে কোর্ট বাতিল করেন –the entire opinion of this witness is short of the requirement under Section -15 of the Evidence Act 1872 lo qu.ilify as an Expert … (page 3655 para 3629).
এলাহাবাদ কোর্ট মন্তব্য করে শুধুমাত্র ডঃ ব্রজবাসী লালের রিপোর্ট আর ছবি দেখেই আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছেন প্রফেসর মন্ডল কিন্তু নিজে থেকে সেই বিষয়ে আরো বেশি অধ্যয়নের প্রয়োজন মনে করেন নি। প্রফেসর মন্ডলের সেই বইটি এক বিখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা থেকে এখনো প্রকাশ হচ্ছে আর অনলাইনে পাওয়া যায়।
প্রফেসর মন্ডল কোর্টে বলেন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির লাল কার্ডের ধারক আর তার কোনোরকম ধর্মীয় বিশ্বাস নেই।
প্রফেসর মন্ডল তার বইয়ের ভূমিকায় রোমিলা থাপারের করা এই বক্তব্যের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস সর্বপ্রথমে রামজন্মভূমির জায়গায় বাবরি মসজিদের অবস্থানের প্রসঙ্গ তোলে।বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘রামজন্মভূমি আন্দোলন’ অযোধ্যার রামমন্দির নিয়ে বিতর্কের শুরু হিসেবে দেখিয়ে কয়েকশো বছরের ইতিহাসকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।১৮৫৫ সালে আওয়াধের নবাব ও ইংরেজ আধিকারিক জেমস আউট্রামের মধ্যে যে চিঠির আদান প্রদান হয় সেখানে হনুমানগারি আর জন্মস্থানের জন্য দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষের উল্লেখ পাওয়া যায়।সুলতানি আমল , মোঘল আমলে মন্দির ধ্বংসের উদাহরণের অভাব নেই কারণ মূর্তিপূজা সেইসব শাসকদের উপাসনা পদ্ধতিতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আর মূর্তিপূজকরা তাদের কাছে অপরাধী।রামজন্মভূমির প্রতি হিন্দুদের শ্রদ্ধায় কোনোকালেই ভাটা পড়ে নি আর রামজন্মভূমিকে উদ্ধারের বিভিন্নরকম চেষ্টাও চলতে থাকে।
চারজন কমিউনিস্ট ঐতিহাসিক আর এস শর্মা, এম আথার আলি , ডি এন ঝা ও সুরজ ভানের লিখিত ‘হিস্টোরিয়ানস রিপোর্ট টু দা নেশন’ ১৯৯১ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় এই আশায় যে সরকার যেনো এইসমস্ত ঐতিহাসিকদের বিচারের প্রক্রিয়ার অংশ করে যাতে ইতিহাসের বিষয়ে সঠিক তথ্য তারা তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু হয়েছিল ঠিক উল্টো আর বিচার প্রক্রিয়া দিনের পর দিন এনাদের জন্য বিলম্বিত হয়েছে। পরবর্তীকালে সুরজ ভান স্বীকার করতে বাধ্য হন যে ,বি বি লালের খননের রিপোর্ট না পড়েই মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে তড়িঘড়ি রাষ্ট্রের উদ্দ্যেশ্যে ঐতিহাসিকদের ঐ দল রিপোর্ট তৈরি করে। দেশকে বিপথে চালিত করার এইরকম দুঃসাহস কোথা থেকে পেলেন এনারা ?
আর এক মসজিদ পক্ষের সাক্ষী শিরিন মুসাভির প্রথমে বলেছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর আগে রামের জন্মস্থান নিয়ে কোনো কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল না কিন্তু জেরার সময় স্বীকার করেন যে শিখ সাহিত্যে গুরু নানকের অযোধ্যায় রামের জন্মস্থান দর্শন ও পবিত্র সরযূ নদীতে স্নানের উল্লেখ পাওয়া যায়।সুপ্রীম কোর্ট গুরু নানকের রামমন্দির দর্শনকে হিন্দুদের রামজন্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধার প্রমাণ হিসেবে মত দেয়।১৮৫৭ সালে নিহাঙ্গ শিখদের একটি দল রামজন্মভূমিতে পূজা দেয় — এই সত্যটিও কোর্টে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বামপন্থী ঐতিহাসিকদের ডিগবাজি খাওয়া কেস চলাকালীন সবসময়ই চলতে থাকে।এলাহাবাদ হাইকোর্ট বাবরি মসজিদের পক্ষে থাকা তথাকথিত ‘বিশেষজ্ঞ’ ঐতিহাসিকদের কোর্ট ও কোর্টের বাইরে করা এই মিথ্যাচারে স্তম্ভিত হয়ে যায়।কেউ বলেছেন মসজিদের বিশেষত্ব নিয়ে কিছু জানেন না, কেউ বলেছেন বাবরি মসজিদ সম্পর্কে কোনো অধ্যয়নই করেন নি। এইসব ঐতিহাসিকরা যেভাবে কোর্টকে বিভ্রান্ত করেছেন তা নিজেই একটা ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি করেছে। এনাদের সত্য প্রকাশে সদিচ্ছা তো ছিলই না বরং ঘটনাপ্রবাহ এনাদের দুরভিসন্ধি স্পষ্ট করে দেয়।
তাহলে কি সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিতর্কের অবসান হোক, তারা চান নি ? তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আনুগত্য কি ঐতিহাসিক হিসেবে তাদের কর্তব্য,ন্যায়পরায়ণতাকেও উপেক্ষা করতে বাধ্য করেছিল ?
কখনো শিববেদীকে মুসলিমদের কবর বলা কখনো রামজন্মভূমি থেকে পাওয়া শিলালিপি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা, প্রত্নতাত্ত্বিক রিপোর্টকে অযৌক্তিক আক্রমণ এইভাবেই বামপন্থী ঐতিহাসিকদের মিথ্যাচার চলতে থাকে।তারা হয়তো ভেবেছিলেন বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতে থাকবে কিন্তু রামজন্মভূমির ক্ষেত্রে যে হয়নি তা আজ প্রমাণিত।প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মীনাক্ষী জৈন তাঁর ‘The Battle for Ram: Case of the Temple at Ayodhya’ বইতে রামমন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরির বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণ দিয়েছেন।১৮৫৬ সালে প্রকাশিত ,মিরজা জান তার ‘হাদিকাহ-ই-সুহাদা’য় পার্সিয়ায় লেখা তথ্যসূত্র উল্লেখ করে বাবরের মন্দির ধ্বংসের কথা বলেন।১৯১৯ সালে প্রকাশিত উর্দুয় লেখা ‘তারিখ-ই-আওয়াধ’ এ বলা হয় ‘জন্মস্থান’ এর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে বাবর মসজিদ নির্মাণ করে।আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফজল অযোধ্যাকে পবিত্র স্থান বলে উল্লেখ করে।অস্ট্রিয়ার জেসুইট টিফেনহেলার ১৭৬৬ থেকে ১৭৭১ সালে আওয়াধে ভ্রমণ করেন । তিনি বাবরের দ্বারা বিষ্ণুর অবতার রামের মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয় রামজন্মভূমিতে হিন্দুদের একটি ‘বেদী’ কে পূজার ঘটনা ও সেই স্থানে রামনবমীতে হিন্দুদের আগমনের ঘটনার উল্লেখ করেন।
জার্মান ভারততত্ত্ববিদ এ্যান্টন ফুয়েরার, যিনি লক্ষ্ণৌ মিউজিয়ামের কিউরেটর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেয়ার ছিলেন ; লিখেছেন ‘The old temple of Ramachandra at Janmasthanam must have been a very fine one, for many of its columns have been used by the Musalmans in the construction of Babar’s masjid.’ অর্থাৎ ১৮৮৯ সালে মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরির বিষয়ে বিদেশী পর্যটক ও আধিকারিকরা স্পষ্ট করে বলেছেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্ট্যাটিসটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রধান এডওয়ার্ড থর্নটন ১৮৫৮ সালে গেজেটে মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরির কথা বলেন।১৮২২ সালে তৎকালীন ফৈজাবাদ কোর্টের এক আধিকারিক হাফিজুল্লাহ কোর্টকে দেওয়া তথ্যে বাবরের মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরির উল্লেখ পাওয়া যায়।
কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা বর্তমান অযোধ্যাকে, প্রাচীন তথা বাল্মিকী রামায়ণের অযোধ্যা হিসেবে মানতেও দ্বিধা করেন। কিন্তু বিভিন্ন জৈন সাহিত্যে বর্তমান অযোধ্যাকে রামজন্মভূমি অযোধ্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সহস্র বছর ব্যাপী শ্রী রামের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রেখে বিচারের অপেক্ষায় থাকা সাধারণ ভারতবাসীর প্রশ্নকে কবিগুরুর ভাষায় বলা যায় —- ‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা’। না, ধুলায় হারিয়ে যায় নি বরং সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বমহিমায়, অযোধ্যায় এখন প্রাণ প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় ‘রামলালার’ নির্মীয়মাণ গগনচুম্বী মন্দির। রামজন্মভূমির রায়, রামমন্দির পুনরুদ্ধারের অনাবিল আনন্দের মধ্যে ভারতবাসীকে ভাবতে বাধ্য করেছে ভারতের ইতিহাসকে কমিউনিস্টদের দুষ্টচক্র থেকে উদ্ধার করলেই দেশরক্ষা সম্ভব।
তথ্যসূত্র :
ভারতবর্ষের ইতিহাস — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
The battle for Rama , Case of the Temple at Ayodhya —- Meenakshi Jain
An Indian I am — K .K . Muhammed
পিন্টু সান্যাল