প্রথম পর্ব
রামমন্দির পুনর্নির্মাণ শুধু ভারতের নয় বিশ্ব ইতিহাসের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।রামমন্দিরের পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজ জাগরণের অর্থাৎ ‘রামমন্দির আন্দোলন’ এর প্রয়োজন হয়েছিল তেমনি ভারতবর্ষের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসের দীর্ঘতম লড়াইয়ে রামমন্দিরের প্রতি হিন্দুদের আস্থা ও ঐতিহাসিকতার প্রমাণ হওয়ার প্রয়োজন ছিল।এই দুই দিকেই মন্দিরের বিপক্ষে থাকা কমিউনিস্ট ঐতিহাসিক, সাংবাদিককে বৌদ্ধিক লড়াইয়ে হার স্বীকার করতে হয়েছে। একদিকে সমাজকে বিভ্রান্ত করতে সংবাদপত্র, পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শ্রী রামের গুরুত্ব কে লঘু করা আর তার সাথে বিচারাধীন মামলাকে মিথ্যা ইতিহাসের ঘুরপাকে আবদ্ধ রাখতে কমিউনিস্টদের চেষ্টার খামতি ছিল না।
মন্দির শুধু উপাসনার কেন্দ্র নয় , ভারতীয় ইতিহাসের, ভারতীয় সমাজের মনস্তত্ত্বের চিত্রণ।
রামমন্দির ধ্বংস করা শুধু ভারতীয় তথা পৃথিবীর প্রাচীনতম উপাসনার উপর আঘাত নয় ভারতীয় ইতিহাসের উপর আঘাত। রাম আর রামজন্মভূমিতে রামমন্দিরের অস্তিত্বের প্রতি যারা সমাজে সংশয় তৈরি করতে চেয়েছে তারা ভারতের শুভচিন্তক হতে পারে না।
রাম, ভারতবর্ষের ধর্মের বাস্তবিক রূপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রক্ষ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রামকথা শুনিয়েই শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষাদান শুরু করেছিলেন
বিশ্বকবির কথায় —
“রামায়ণ সেই অখণ্ড-অমৃত-পিপাসুদেরই চিরপরিচয় বহন করিতেছে। ইহাতে যে সৌভ্রাত্র, যে সত্যপরতা, যে পাতিব্রত্য, যে প্রভুভক্তি বর্ণিত হইয়াছে, তাহার প্রতি যদি সরল শ্রদ্ধা ও অন্তরের ভক্তি রক্ষা করিতে পারি তবে আমাদের কারখানাঘরের বাতায়ন-মধ্যে মহাসমুদ্রের নির্মল বায়ু প্রবেশের পথ পাইবে।” [রামায়ণ, প্রাচীন সাহিত্য]
রামকে যদি কাল্পনিক বলা হয় তাহলে শুধু ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্বকে আঘাত করা নয় ; সত্য রক্ষার্থে মানবের ত্যাগের সীমা, অশুভকে পরাস্ত করতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সামাজিক জাগরণের উচ্চতম নিদর্শনের বাস্তবিকতাকে অস্বীকার করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজতাত্ত্বিকরা যে আদর্শ সমাজের ও সুরাজের কথা কল্পনা করেছিলেন, ‘রামরাজ্যের’ মাধ্যমে ভারতবর্ষেই তার বাস্তবায়ন হয়েছে। ‘রামরাজ্য’ বাস্তবিক হলে সাম্যবাদের অসাড় তত্ত্ব গেলানো কঠিন হয়ে যায়।
রামকথা হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজের প্রত্যেক অংশে গার্হস্থ্য জীবনের যে মূল্যবোধ শিখিয়েছে যার ফলে ভারতীয় সমাজ সত্যবাদীতা, ন্যায়পরায়ণতার অভ্যাস করাকে রামভক্তির সমার্থক মনে করেছে ; সেই অভ্যাস থেকে সমাজকে সরিয়ে দিয়ে ইউরোপীয় বস্তুবাদী চিন্তা ও অভ্যাস দিয়ে ভারতীয় মনোভূমিতে আঘাত করার প্রয়াস হয়েছে।
সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে মর্যাদার সীমাকে চিহ্নিত করে যার জীবনী তিনিই ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ । সেই মর্যাদা না থাকলে পাশবিক প্রবৃত্তির বশে প্রাণীর বংশবিস্তার হতে পারে কিন্তু সভ্যতার সৃষ্টি হয় না। ভারতীয় পরিবারকেও যারা শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব দিয়ে বিভাজনের স্বপ্ন এখনো দেখছে তাদের কাছে রামমন্দিরের পুনর্নির্মাণ আপন তত্ত্বকে চুরমার হতে দেখা।
মন্দিরের ওপরে অত্যাচারী বিদেশী শাসকের নির্মাণ ভারতীয় মনে দাসত্ব গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা।
অস্ত্রের আঘাত দেহকে ধ্বংস করেছে কিন্তু রামের প্রতি ভক্তি নয়।ভক্তির বলে যে মনোবল জন্মায় তা থেকেই ভক্তির কেন্দ্র উদ্ধারের শক্তি জন্মায়।
সন্ত কবি তুলসীদাস মধ্যযুগে ভক্তিকে বাঁচিয়েছিলেন।শ্রী রামকে কাল্পনিক বলে ভক্তি থেকে সরিয়ে সমাজকে বিভক্ত করার অপচেষ্টাও দেখিয়েছে একটা গোষ্ঠী। শ্রী রাম বাঙালির দেবতা না বিহারীর দেবতা, ভক্তির দেবতা না যুদ্ধের দেবতা এই নিয়ে অযৌক্তিক আলোচনা করে সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতীয় মানসে অবিশ্বাস আর সন্দেহ ভরে দেওয়ার চেষ্টা নতুন নয়।
ভারতের অনন্যতা তাঁর পরিবার ব্যবস্থায় আর পরিবার ব্যবস্থার কেন্দ্রে দাম্পত্য জীবন। সীতারাম জুটি দাম্পত্য জীবনকে ধর্মের শিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই দাম্পত্য জীবনের বাধা, রাবণকে পরাজিত করেই পরিবারের রক্ষা সম্ভব।পরিবার, সমাজের একক।
পরিবার বাঁচলে সমাজ বাঁচবে।যারা সমাজকেও সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেছে তারা ভারতীয় সমাজকে বুঝতে ব্যর্থ।ধর্মের বন্ধনকে ছিন্ন করে তারা যেমন ভারতীয় সমাজকে ভাঙতে চেষ্টা করছে আবার সমাজের আধার ভারতীয় পরিবারের আদর্শ কর্তা রামকে ভুলিয়ে দিয়ে ভারতের বৈশিষ্ট্যের মূলে আঘাত করতে চায়।মার্ক্সবাদের দৃষ্টিতে পরিবারেও শোষক-শোষিতের সম্পর্ক দেখতে পায় কমিউনিজমের সমর্থকরা।
পরিবার, রাষ্ট্র তাদের কাছে শোষণের যন্ত্র।রামমন্দির নির্মাণ ভারতীয় পরিবার ও রাষ্ট্রের ধারণাকে পুষ্ট করে বলেই তা ‘রাষ্ট্রমন্দির’।
ইতিহাসকে বিকৃত করে আর সমাজের আদর্শকে ভুলিয়ে দিয়েই ভারতের মনোভূমিতে বিদেশি মতবাদের ঢাঁচা নির্মাণের সম্ভাবনা দেখেছিল শ্রেণী সংগ্রামের সমর্থকগণ আর সমাজের মন থেকে অর্থকেন্দ্রিক দর্শনের ঢাঁচাকে গুড়িয়ে দিতেই রামমন্দিরের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন ছিল।পিতৃসত্য রক্ষার্থে ভাইকে রাজসিংহাসন দিয়ে চোদ্দ বছর বনবাসে যাওয়া শ্রী রাম, তাদের কাছে কাল্পনিক মনে হবে যারা পৃথিবীর ইতিহাসকে অর্থ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছে।
ভারতীয় ইতিহাস লিখনের পরম্পরা শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণ নয়, ঘটনাকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে সমাজের পক্ষে হিতকর ভঙ্গীতে উপস্থাপন।পশ্চিমী সভ্যতা শুধু ঘটনার বিবরণ চায়।তাই ইতিহাসের কাব্যরূপের বিভিন্ন রূপক-এ তারা বিভ্রান্ত। রামকথার মাধ্যমে ভারতবর্ষের ইতিহাস যেরকম জীবন্ত পৃথিবীর আর কোথাও তা কল্পনার অতীত।
যাদের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র রাজ্য দখল ছিল না , উদ্দেশ্য ছিল এদেশের ধর্ম-সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলা ; যাদের ধ্বংসলীলার চিহ্ন আজও বহন করে চলেছে মথুরা, কাশী,বৃন্দাবন তাদের নামে এদেশের রাজপথ,বাগান,শহর নামাঙ্কিত করার নামই কি ‘সেক্যুলারিজম’ (বিঃ দ্রঃ — সেক্যুলারিজম এর অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়)। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেই মোঘল , লোদি,তুঘলকদের মহান বানিয়েছে কারা ?
কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা বরাবর মোঘলদের কীর্তিকে মহান করে দেখিয়েছেন।
ইংরেজ আমলে, ইংরেজদের লেখা ভারতবর্ষের ভুল ইতিহাস দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করেছিলেন “ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্নকাহিনীমাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে-ছেলেয় ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, একদল যদি বা যায় কোথা হইতে আর-একদল উঠিয়া পড়ে–পাঠান-মোগল পর্তুগীজ-ফরাসী-ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে।”
তাহলে ইতিহাস লেখার দৃষ্টিকোণ কিরকম হওয়া উচিত ? কবিগুরু লুটেরাদের, বিদেশীদের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ভারতবর্ষের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত ইতিহাস চেয়েছেন…
“আমরা ভরতবর্ষের আগাছা-পরগাছা নহি; বহুশত শতাব্দীর মধ্য দিয়া আমাদের শতসহস্র শিকড় ভারতবর্ষের মর্মস্থান অধিকার করিয়া আছে। কিন্তু দুরদৃষ্টক্রমে এমন ইতিহাস আমাদিগকে পড়িতে হয় যে, ঠিক সেই কথাটাই আমাদের ছেলেরা ভুলিয়া যায়। মনে হয়, ভারতবর্ষের মধ্যে আমরা যেন কেহই না, আগন্তুকবর্গই যেন সব”।
যেসব কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরা শেখালেন মোঘলরাই এদেশে স্থাপত্য, শিল্প , চিত্রকলা,ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে; কবিগুরুর সেই কথাগুলো কি আজও তাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয় ?—-
“এরূপ অবস্থায় বিদেশকে স্বদেশের স্থানে বসাইতে আমাদের মনে দ্বিধামাত্র হয় না–ভারতবর্ষের অগৌরবে আমাদের প্রাণান্তকর লজ্জাবোধ হইতে পারে না। আমরা অনায়াসেই বলিয়া থাকি, পূর্বে আমাদের কিছুই ছিল না, এবং এখন আমাদিগকে অশনবসন আচারব্যবহার সমস্তই বিদেশীর কাছ হইতে ভিক্ষা করিয়া লইতে হইবে”।
ইতিহাসে বিদেশীদের বড় করে দেখলে স্বদেশের সঙ্গে যোগসূত্র দুর্বল হয়ে পড়ে আর তারপর ধীরে ধীরে রাষ্ট্রনীতির প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিদেশী তত্ত্বের জায়গা পাকা করতে সুবিধা হয় বলেই কি এইরকম অপচেষ্টা হয়েছে দশকের পর দশক? তারপর এই দেশের শিকড়ে প্রাণের রস সঞ্চার করেছিলেন যে সমস্ত মহাপুরুষ তাদের ভুলিয়ে দিয়ে কার্যালয়ে, বাড়িতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে , যুবকদের টি শার্টে বিদেশীয়দের ছবি জায়গা পায় স্বদেশী মহাপুরুষদের স্থানে।তখন স্বদেশের সবকিছুকেই বদলে ফেলে বিদেশের ছাঁচে তৈরি করতে চায় যুবক মন—- এই কি ইতিহাস কে ব্যবহার করে আধুনিক যুগে বিদেশীয় মতবাদের ক্ষমতায়নের ব্লু প্রিন্ট ?
‘ভারতবর্ষের পুণ্যমন্ত্রের পুঁথিটিকে একটি অপরূপ আরব্য উপন্যাস দিয়া মুড়িয়া’ যারা নকল ইতিহাস পাঠ্যক্রম রচনা করে ভারতবর্ষের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিকের উপাধি ধারণ করে লুটেরাদের নায়কের আসন দিয়ে দেশরক্ষায় প্রাণ বলিদান দেওয়া রাণা প্রতাপ , রানী দুর্গাবতী কে আড়ালেই রেখে দিলেন , তাদের কৃত্রিম জ্ঞান ‘এমন স্থানে কৃত্রিম আলোক ফেলে, যাহাতে আমাদের দেশের দিকটাই আমাদের চোখে অন্ধকার হইয়া যায়’ । ক্ষতি অনেক হয়েছে, বিশ্বকবির ভাষায় ‘ভারতবর্ষের সেই নিজের দিক হইতে ভারতবর্ষকে না দেখিয়া আমরা শিশুকাল হইতে তাহাকে খর্ব করিতেছি ও নিজে খর্ব হইতেছি’।
রামজন্মভূমি মামলার রায় কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকদের দ্বারা ভারতকে খর্ব করার অপচেষ্টার ‘শেষের শুরু’।দেশগঠনে ইতিহাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর ইতিহাসকে বিদেশীয় মতবাদের জন্য জায়গা করে দিতে, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণ করতে কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেই ষড়যন্ত্রকে সর্বসমক্ষে এনে দিয়েছে।
পিন্টু সান্যাল