জনপ্রিয় ছড়াটা শুনেছেন নিশ্চয়ই কিন্তু জানেন কি এর পেছনের গল্পটা ? সত্যিই কি জাপানীরা বোমা ফেলেছিল এ রাজ্যে…. কলকাতা শহরে….?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমাদের দেশের সরাসরি কোন যোগ ছিলোনা এটাতো সবাই জানেন। কিন্তু কলকাতা ও কল্যানী শহরে মার্কিন সেনারা সেসময় ঘাঁটি বানিয়েছিল। এখান থেকেই জাপানের শত্রু চিনকে যুদ্ধের রসদ দিয়ে সাহায্য করার পরিকল্পনা করেছিল আমেরিকা। তাছাড়া বৃটিশ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর তো ছিলই। অবধারিত ভাবে তাই জাপানের নজর পড়েছিল কলকাতার ওপরে।

সেই নজর থেকে কলকাতাকে বাঁচাতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে কালো রং করা হয়েছিল। এ ছাড়াও আরও অনেক কিছুই করতে হয়েছিল বৃটিশদের। সেই সময়েই চালু হওয়া হাওড়া ব্রীজের উপরেও বিমান হামলা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এশিয়ার প্রথম ক্যান্টিলিভার সেতু। হাওড়া ব্রীজকে বিমান হানা থেকে বাঁচাতে গঙ্গার উপরে নৌকা থেকে ওড়ানো হত বিশাল বিশাল হিলিয়াম গ্যাস ভর্তি বেলুন, বা ব্যারেজ বেলুন। ঘুড়ির মতো উপরে উড়িয়ে দিয়ে দড়ির সাহায্যে সংযোগ রাখা হতো নীচ থেকে। এসব বেলুনের জন্য বেশি নীচের দিকে নেমে কোনও বিমানের পক্ষে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। কলকাতার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাড়িকে বাঁচাতে এই বেলুনের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল সেই সময়ে। তৈরি হয়েছিল সেনাবাহিনীর বিশেষ বেলুন স্কোয়াড্রন।

সম্ভাব্য আক্রমণের লক্ষ্য ছিলো রেড রোডও। মিত্রবাহিনীর বিমানের জরুরি ওঠানামার জন্য শুধু বিমানবন্দর যথেষ্ট ছিল না। তাই রেড রোডকেও সেই সময় ব্যবহার করা হতো রানওয়ে হিসাবে। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত বিভিন্ন যুদ্ধবিমানকে। শুধু কলকাতা নয় বাইরের অনেক জেলাতেও জঙ্গলের মধ্যে গোপন রানওয়ে বানানো হয়েছিল। বাংলার বিভিন্ন শহরে এমন পরিত্যক্ত রানওয়ে আজও দেখতে পাওয়া যায়।

এত কিছুর পরেও কিন্তু আটকানো যায়নি বিমান হামলা। #২০শে_ডিসেম্বর ১৯৪২, সময় রাত বারোটার আশেপাশে। শীতের কলকাতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গোঁ গোঁ করতে করতে কলকাতার আকাশে ধেয়ে এলো ইম্পেরিয়াল আর্মি জাপানীজ এয়ারফোর্সের তিনটি বোমারু বিমান। লক্ষ্য ছিলো খিদিরপুর বন্দর ও হাওড়া ব্রীজকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া, যাতে কলকাতার সাথে দেশের অন্য অংশের সামরিক দিক দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যায়। পুরোপুরি সফল না হলেও ক্ষয়ক্ষতি মন্দ হয়নি। খিদিরপুরের বন্দর এলাকা তছনছ করে দিয়েছিল জাপানি বোমা। প্রাণ গিয়েছিল বেয়াল্লিশ জন মানুষের। পরবর্তী সময়ে ডালহৌসি, মানিকতলা, টালা, হাতিবাগান ইত্যাদি এলাকাও কেঁপেছে জাপানি বোমার অভিঘাতে। সেই দিন থেকে শুরু করে পরের কয়েকটা মাস মহানগরীর ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়।

কলকাতা বাসীর জীবনে নেমে এসেছিল ঘোর বিপর্যয়। সন্ধ্যা হলেই জারি করা হতো Black Out. রাস্তায় আলো জ্বলতো না, ঘরের আলো ঢাকা পড়তো কালো টুপিতে। ভৌতিক অন্ধকারে ডুবে গেল আনন্দনগরী। তার ওপর দলে দলে মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করলো। বিশ তারিখ ছাড়া আর একবারই বোমা পড়েছিল কলকাতায়। ফসকা গেরো রুখতেই ইংরেজ প্রশাসনকে সেদিন বজ্র আঁটুনির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।

ঘটনার সাক্ষী ২০১৮ সালে খিদিরপুর ডকের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া একটি বিশাল না- ফাটা বোমা। এছাড়া মানিকতলা পুলিশ মিউজিয়ামে এমন একটি বোমার খোলস আজও সংরক্ষিত আছে। ডিসেম্বর চলে যেতে যেতে উস্কে দিয়ে গেল আশি বছর আগে এক পুরানো ডিসেম্বরের স্মৃতি। আর এখন তো আমরা বোমা বারুদের স্তুপের ওপর বসে আছি !
কলমে ✍????©️ স্বপন সেন ????

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.