জেহাদি তিতুমিরকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বানানোর কৃতিত্ব বাম-ইসলামিক ইতিহাসবিদদের

তিতুমিরের বাঁশের কেল্লার ও তার বীরত্বের গল্পগাথা বাম আমলে অবশ্য পাঠ্য ছিল, এখনও বোধহয় আছে। তবে বাম আমলে এর প্রভাবটা ছিল আরও মারাত্মক। শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষকদের ক্ষেপিয়ে তোলাটা ছিল সিপিএমের ক্ষমতা দখলের অন্যতম ছক। ভূমিরাজস্ব সংস্কারের নামে বর্গাদার উচ্ছেদ করে ক্ষেতমজুর, চাষির ক্ষমতায়ন আসলে ছিল পার্টির দখলদারি।। সত্যিই যদি বর্গাদার উচ্ছেদ করা যেত, নিরন্ন চাষি, ক্ষেতমজুরের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দেওয়া যেত, তাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষই লাভবান হতেন। কিন্তু এই ছলে পার্টির সর্বকতৃত্বময় হয়ে ওঠার ইতিহাস সবাই জানেন, নতুন করে বলার দরকার নেই। এই প্রসঙ্গে অবান্তরও, কিন্তু যাকে সামনে রেখে কৃষক-বিদ্রোহের ছক কষেছিল শাসক সিপিএম তাঁর নাম সৈয়দ মির নাসের আলি, যাকে ‘তিতুমির’ বলেই সবাই জানে। এই ‘হিরো’টিকে স্বাধীনতা-যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরতে আগমার্কা বাম-ঐতিহাসিকদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কেবল এটাইনয়, ১৮৩১ সালে বারাসতের কাছে নারকেলবেড়িয়ায় তিতুমিরের বাঁশের কেল্লায় ব্রিটিশ অবরোধ ও লড়াইকে ‘প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ’ বলেও দাগিয়ে দিয়েছিলেন তারা।
অথচ এর ছাব্বিশ বছরের মধ্যে ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদ দেখা যায়, যার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত থেকে তাদের শাসন ব্যবস্থা গোটাতে বাধ্য হয়, দীর্ঘদিন বাম-ঐতিহাসিকরা বিষয়টিকে ‘সিপাহি যুদ্ধে’র বেশি মর্যাদা দেয়নি। বীর সাভারকার সর্বপ্রথম এই তথাকথিত “সিপাহি যুদ্ধকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেন। হঠাৎ করে এই ২০১৯-এ এসে বামৈস্লামিক শক্তি আবিষ্কার করল এটা নাকি মার্কস সাহেবের কাজ। শেষ শয্যায় মার্কস যথার্থই বলেছিলেন :‘ধন্যবাদ ভগবান, আমি মার্কসবাদী নই।
এইসব ‘ভক্ত’ ঐতিহাসিকদের ভক্তির গল্পগাছা সরিয়ে রেখে প্রকৃত ইতিহাসটা জনসমক্ষে উঠে আসা উচিত। নইলে ব্রিটিশের গোলাম, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে বড়ো বিশ্বাসঘাতক কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া, স্বাধীন ভারতে চীন-পাকিস্তানের দালালি করা কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট)-ও ‘মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী’ হয়ে যাবে।
কোনও সন্দেহ নেই ১৮৩১ সালের ১৮ নভেম্বর তৎকালীন গভর্নর জেনারেল উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের নির্দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা নারকেলবেড়িয়ায় তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা অবরোধ করে। তার পরেরদিন ঘণ্টা তিনেক গুলির লড়াই হয়, কিছু সঙ্গী-সাথী নিয়ে তিতু মারা যায়। তার বাঁশের কেল্লা ব্রিটিশ সেনা দখল করে। তিতুর শ’খানেক লোক বন্দি হয়। এই অবধি ইতিহাসের পাঠ সাদা দৃষ্টিতে ঠিকই আছে। কিন্তু শয়তান মস্তিষ্ক, ধূর্ত বাম ঐতিহাসিকেরা ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াইয়ের সূত্র ধরে তিতুমিরকে ‘মহান স্বাধীনতা-সংগ্রামী বানিয়ে দিয়েছে। তিতুর সম্পর্কে সামান্য যে ঐতিহাসিক সূত্র পাওয়া যায় তা মূলত জন রাসেল কোলভিনের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে। কোলভিন ছিলেন ভারতে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্ট। তাছাড়া ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে লেফট্যানেন্ট গভর্নরও ছিলেন তিনি।
কোলভিন যদি কোনও ঐতিহাসিক হতেন তাহলে তার বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ করা চলত। কিন্তু একজন রাজকর্মচারী হিসাবে সমসাময়িক তথ্যের ভিত্তিতে তিনি তিতুর সম্পর্কে জেনেছিলেন, এখানে ঐতিহাসিক মত প্রকাশের সুযোগ নেই।তাই কোলভিনের রিপোর্টের সত্যতা আছেই। কোলভিন জানিয়েছেন, তিতুর জীবন শুরু হয়েছিল সামান্য এক কৃষক হিসেবে। এই অল্প আয়ে সন্তুষ্ট থাকার ইচ্ছা উচ্চাকাঙ্ক্ষী তিতুর ছিল না। সে একটা ডাকাতের দল গড়ে, লুটপাঠ চালাত। পাঠক, ‘স্বদেশি ডাকাত’যাঁরা দেশের উন্নতির জন্য, দশের উন্নয়নে তথাকথিত ‘ডাকাতি’করেছিল, এই ধারণা অনেক পরে এসেছিল, তিতুর সময় নয়। আর এই স্বদেশি ডাকাত’রা ছিলেন মা কালীর পূজারি হিন্দু। তিতুর লুঠপাঠ শুধুমাত্র তার বিত্তবাসনা মেটানোর জন্য।
এক সময় সে কলকাতায় আসে, কুস্তিগির হিসেবে তার নাম-ডাকও হয়। সে এক জমিদারের লেঠেল নিযুক্ত হয়। এদের কাজ ছিল ধমকিয়ে-ধামকিয়ে অন্যের জমির দখল নেওয়া। তিতু ছিল এই কাজে বিশেষ পারদর্শী। কিন্তু একবার এই কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে সে। ঠাই হয় কোম্পানির জেলে।। অপরাধ-প্রবণতায় আরও বড়ো ধরনের হাত পাকায় সে। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ‘তীর্থ’ করতে মক্কায় চলে যায় সে। সেখানে সৈয়দ আহমেদের শিষ্যত্ব নেয়, ভারতে ফিরে আসে একজন ইসলামিক ধর্মপ্রচারক হিসেবে।
মক্কার জল-হাওয়া তিতুমিরকে একজন এমন ধর্মপ্রাণ মুসলমান করে তুলেছিল, যাতে করে ভারতের বাউল-সন্ত-সুফি সাধনা থেকে সে অনেকদূর চলে যায়, চরম হিন্দু-বিদ্বেষী মুসলমান সাম্প্রদায়িক ওয়াহাবি আন্দোলনে নিজেকে দীক্ষিত করে। ইংরেজদের হাত থেকে মোগল সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধারই তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ওয়াহাবি আন্দোলনের জন্ম হয় আরবের রুক্ষ ভূমিতে এবং সৈয়দ আহমেদরাই বারেলভির হাত ধরে তা পদার্পণ করে ভারত-ভূমিতে। একথা স্পষ্ট বোঝা দরকার এই ওয়াহাবি আন্দোলনই নানা প্রক্রিয়ায় (যার মধ্যে অন্যতম খিলাফত আন্দোলন) শেষপর্যন্ত আরবের সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের একাত্ম করে এবং পাকিস্তান প্রসঙ্গের জন্ম দেয়। সেইদিক দিয়ে দেখলে আজকের নিরিখে তিতুমির ছিলেন একজন ধুরন্ধর জেহাদি, যাকে ‘দেশপ্রেমী’ বানানোর বামৈস্লামিক ষড়যন্ত্র আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
তিতুমিরের গুরু সৈয়দ আহমেদ অনেক কষ্ট করে ওয়াহাবি আন্দেলনের বিষ বৃক্ষটি পুঁতেছিলেন এবং এই জেহাদি সংগ্রামে তিতুমির ছিল তার প্রধান সেনানি। এই সৈয়দ আহমেদ রাই বারেলভির চিন্তাধারা যে আজকের দিনের ব্যাপক জেহাদের জন্মদাতা তা স্পষ্ট। তিনি মনে করতেন উত্তর ভারতে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব, দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে মারাঠা ও উত্তর-পশ্চিমে শিখ শক্তি এবং শ’খানেক হিন্দু নিয়ন্ত্রিত প্রিন্সলি স্টেট মুসলমানদের ধমকে লঘু করে দিচ্ছে, সুফি-বাউল প্রভাব বাড়াছে, আরবীয় সংস্কৃতি মোগল প্রভাব থেকে মুসলমানদের বিরত করে ‘স্বধর্মচ্যুত করছে। ফলে ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতে মোগল শাসনের প্রতিষ্ঠা।
ইংরেজ শাসন ও মুসলমান শাসন— উভয়েই ভারতকে লুঠ করতে সক্রিয় ছিল, এবং এই দুই বৈদেশিক শক্তি ভারতবর্ষের মূল অধিবাসী হিন্দুদের ধর্মনাশ, রাজ্যনাশ, সর্বনাশের মূলে ছিল। তাই তিতুমির বনাম ইংরেজ শক্তির লড়াই ছিল আদতে রাজায়। রাজায় যুদ্ধ এবং এর মাশুল গুনেছিল উলুখাগড়া হিন্দুরা। সৈয়দ আহমেদের বাণী ছিল : মুসলমান রাজ্য যখন কাফেররা দখল করে, তখন জেহাদ আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়, ইসলামিক উম্মাহদের কাছেও।
১৮২৭ সালে তিতুমির মক্কা থেকে বাঙ্গলায় ফিরে আসার পর ইসলামের বাণী প্রচারের নামে মুসলমানদের (যাদের প্রজন্ম এককালে হিন্দু ছিল, মোগল আমলে মুসলমান হয়ে প্রাণ বাঁচায়) জেহাদ তত্ত্বে দীক্ষিত করে এবং জনজাতি মানুষকেও ভয় দেখিয়ে লোভ দেখিয়ে মুসলমান বানানোর ছক কষে। এই মুসলমানত্ব প্রমাণের সর্বোৎকৃষ্টপন্থা হিসেবে তিতু বেছে নিয়েছিল হিন্দু মন্দিরগুলো আর তাদের সেবায়েত পুরোহিতদের। কালাপাহাড়ি মেজাজে তিতুর তাণ্ডবে চব্বিশ পরগনা, হুগলি প্রভৃতি জেলার অসংখ্য মন্দির ভাঙা পড়ে, কত যে পুরোহিত খুন হয় তার ইয়ত্তা নেই। এর সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি কিন্তু কোলভিনের মতো সরকারি আমলাদের রিপোর্টে তার আভাস পাওয়া যায়।
জেহাদি তিতুমির আধুনিক কালে বাম ঐতিহাসিকদের পাল্লায় পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেন বটে, তবে ইতিহাসের সত্য চাপা থাকে না। প্রতিবেশী বাংলাদেশ, ইসলামিক জেহাদের আঁতুড়ঘর, জামাত গোষ্ঠীর জন্মদাতা, যারা ইদানীং কালে পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দুনামধারী মুসলমানকে তাদের মুঠোয় নিয়ে এসেছে সেই মৌলবাদী দেশটির তিতুমির ভক্তির নমুনা শোনা দরকার।
১৯৭১ সালের ঢাকার জিন্না কলেজ, তিতুমিরের নামে নামাঙ্কিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের বছরে উত্তরপুরুষ ছেড়ে পূর্বপুরুষে তর্পণ আর কী! ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির একটি কক্ষ তিতুমিরের নামাঙ্কিত হয়। খুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি বন্দরও তিতুমিরের নামে। তিতুমিরকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার তার নামে একটি স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছে।
ফলে বিষয়টা আশা করি স্পষ্ট হচ্ছে এ বাঙ্গলার জামাত ‘পক্ষ’ যেমন এখন বাঙ্গালি সংস্কৃতির ওপর আরবীয় সংস্কৃতি চাপাতে চাইছে, ওপার বাংলায় সেই সার্থক প্রয়াস ‘বাঙ্গালি’ সেন্টিমেন্টের ধুয়ো তুলে বহু আগেই গৃহীত হয়েছে। বামৈস্লামিক ইতিহাসবিদদের এতে অবদান ইদানীংকালের জামাত ‘পক্ষে’র অনেক আগে।
অভিমন্যু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.