টিপু সুলতান দেশপ্রেমিক নন মোটেই

২০ নভেম্বর ১৭৫০ সালে বর্তমান ব্যাঙ্গালোরে টিপু সুলতান (দেবানাহুল্লী) জন্মগ্রহণ করেন। মহীশূরের প্রাচীন। হিন্দু ওহিয়ার রাজবংশকে সরিয়ে হায়দার আলি ১৭৬০ সালে শ্রীরঙ্গপত্তনমকে রাজধানী করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এই হায়দার আলি ও ফাতিমা ফকরউন্নিশাহ-র পুত্র ফতেহ আলি ইতিহাসে টিপু সুলতান নামে পরিচিত হন। স্থানীয় সুফি সন্ত টিপু মস্তান আওলিয়ার নাম অনুকরণে তার প্রচলিত নাম হয় টিপু সুলতান। টিপুর পিতা হায়দার আলি যে সময় মহীশূরের সিংহাসনে বসেন সেই সময় ইংরেজরা সবেমাত্র পলাশীর যুদ্ধ জয় করে ভারতে। সাম্রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ ভারতে ফরাসি ও ইংরেজদের মধ্যে ভারতীয় উপনিবেশ দখলে জোর সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। এই ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বে দক্ষিণ ভারতের ভারতীয় রাজবংশগুলি প্রায় প্রত্যেকেই ফরাসি শক্তিকে নতুবা ইংরেজশক্তিকে তাদের সমর্থন জানিয়েছিল।
হায়দার আলির সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই মহীশূর সাম্রাজ্যের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ শুরু হয়েছিল এবং সেই বিরোধ উত্তরাধিকার সূত্রে টিপু সুলতানও পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ইংরেজরা সারা ভারতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় ও ভারতবর্ষকে তাদের উপনিবেশ বানাতে সফল হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকেই বা বলা যেতে পারে অষ্টাদশ শতকের শেষ লগ্ন থেকে ব্রিটিশদের অত্যাচার ও শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষকে বিদেশি শাসনমুক্ত করার যে প্রচেষ্টা আরম্ভ হয়েছিল টিপু সুলতানের ব্রিটিশ-বিরোধী যুদ্ধ কি তারই অংশ ছিল? মহীশূরের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধিতা বিভিন্ন কারণে গড়ে ওঠে। হায়দার কর্তৃক মহীশূরের ক্ষমতা দখলে আরেক বিদেশি শক্তি ফরাসিদের বিশেষ অবদান ছিল। শুধু তাই নয় ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে তিনি ফরাসিদের সমর্থন করেন। স্বভাবতই ইংরেজরা হায়দার বিরোধী হয়ে ওঠে।
যদিও পরবর্তীকালে (১৭৬৬) ইংরেজরা ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠলে হায়দার ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে নানান চেষ্টা চালান। কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হননি। ১৭৬৭ সালে শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ। মাদ্রাজের সন্ধির (১৭৬৯ খ্রি:) মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান হলেও পুনরায় ১৭৮০ সালে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ চলাকালীন ১৭৮২ সালে হায়দারের অকস্মাৎ মৃত্যু হলে হায়দার পুত্র টিপু যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তারপর ১৭৯০ ও ১৭৯১ সালে আরো দুটি ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ হয়েছিল টিপুর নেতৃত্বে। যুদ্ধক্ষেত্রেই টিপু সুলতানের মৃত্যু হয়।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার অক্ষুন্ন রাখার জন্য বিরোধী শক্তি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়া টিপু ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ আখ্যা পাওয়ার যোগ্য কি? তিনি আর কোনো উদাহরণ রেখে গিয়েছিলেন? কর্ণাটক সরকার টিপু সুলতানের ২২৬তম জন্ম বার্ষিকী উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিলেও কেন কর্ণাটক-কেরল সীমান্তবর্তী (কুর্গ) বা কোডগু অঞ্চলের মানুষেরা টিপুর এত বিরোধী ? তারা কোনো মতেই টিপুকে দক্ষিণ ভারতের বা কন্নড় নায়ক মানতে রাজি নন। কথা হলো দেশপ্রেমিক হতে গেলে নিজের দেশকে ভালোবাসা অত্যন্ত জরুরি। দেশ অর্থাৎ স্বদেশ, মাতৃভূমি এবং এই মাতৃভূমির প্রত্যেকটি মানুষের মঙ্গলকামনা, হিতসাধন সর্বোপরি বিদেশি শক্তির উচ্ছেদ সাধন করে ‘স্বরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেশপ্রেমিক বা স্বাধীনতা সংগ্রমী হতে গেলে এগুলি অপরিহার্য।
টিপু সুলতান বর্তমান কর্ণাটক ও কেরলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাম্রাজ্যবিস্তার করেছিলেন। টিপুর শাসনকালে এই অঞ্চলে তার রাজ্যবাসীর অধিকাংশই ছিল হিন্দু। খ্রিস্টানরাও এই অঞ্চলে বসবাস করতেন। টিপু তার শাসনকার্য চলানোয় ইসলমিক ধর্মান্ধতার ঊর্বে উঠতে পারেননি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসক হিসেবে নয় ইসলামের প্রসারের জন্যই তিনি কর্ণাটক ও কেরলের নানা অঞ্চল জয় করেন। ১৯২৩ সালে বিখ্যাত ঐতিহাসিক কে. এম. পানির ভাষা পোসিনি’ পত্রিকায় টিপু সুলতানের সমসাময়িক নানা ঘটনার বিশ্লেষণ করে 6121636991 (Tipu Sultan : Villain or Hero. Edited by Sita Ram Goel). ১৭৮৮ সালের ২২ মার্চ তিনি আবদুল কাদিরকে চিঠি লিখে জানান যে ১২০০০ এরও বেশি হিন্দুকে ইসলামে ধর্মান্তকরণ করা হয়েছে। এই খবরটি বেশি করে ছড়িয়ে দিতে হবে যাতে করে অন্যান্য হিন্দুরাও নিজে থেকে ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি বার বার সতর্ক করছেন যে একটিও নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ যেন বাদ না যায়। ওই বছরই ১৪ ডিসেম্বর কালিকটে অবস্থিত তার সেনাধ্যক্ষকে চিঠি লিখে নির্দেশ দেন যে মির হুসেন আলি ও আরও ২ জনকে তিনি পাঠাচ্ছেন। তাদের সাহায্যে কালিকটের একটি হিন্দুও যেন বেঁচে না থাকে। এমনকী তিনি এমন নির্দেশও দিয়েছেন যে ২০ বছরের কম যাদের বয়স তাদের বন্দি করে রাখতে। এবার অন্তত ৫০০ হিন্দুকে যেন গাছের উপর থেকে ফেলে মারা হয়। নিজ রাজ্যে হিন্দুদের এমন গণহত্যা সংঘটিত করার পর উৎসাহী টিপু ১৭৯০ সালে (১৮ জানুয়ারি) আব্দুল দুলাইকে চিঠিতে কালিকটে তার জিহাদ সফল হওয়ার সংবাদ দিয়ে বলেছেন যে কালিকটে আর একটি হিন্দুও বেঁচে নেই। উল্লেখযোগ্য যে এই তথ্যগুলি যখন প্রকাশ হয়েছিল তখন কিন্তু টিপুকে ‘দেশপ্রেমিক বলা যেতে পারে কিনা এই ধরনের কোনো বির্তকের সূত্রপাত হয়নি।
টিপুর চরম হিন্দু বিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতার উদাহরণ পাওয়া যায় তার কোডাগু বা বর্তমান কর্ণাটকের কুর্গ জেলা অভিযানে। কিছু ঐতিহাসিক দাবি করেছেন যে তিনি ৪০ হাজার কুর্গবাসীকে হত্যা করেছেন। অসংখ্য হিন্দু মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন। ‘হয় ইসলাম না হয় মৃত্যু’– এই নীতিতে গোটা কুর্গবাসীকে মৃত্যুমুখে নামিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানকার খ্রিস্টান প্রজাদেরও ছাড়েননি। ১৯৮০ সালে মহীশূর থেকে প্রকাশিত আই. এম. মুথানা’র লেখা ‘Tipu Sultan XRayed’ গ্রন্থটিতে তিনি টিপুর এই গণহত্যার বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ-সহ বিবরণ দিয়েছেন।
টিপুর সমসাময়িক বিদেশি পর্যটক যারা শ্রীরঙ্গপত্তন এবং মহীশূরে ভ্রমণ করেছিলেন ও টিপুর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তারাও টিপুর বর্বরতার বর্ণনা করে গেছেন। পর্তুগিজ পর্যটক বার্থোলোমেউ যিনি ১৭৯০ সালে টিপুর সফরে সঙ্গী ছিলেন তিনি লিখছেন যে, “টিপু সুলতান যাচ্ছেন, তার পেছনে প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যদল রয়েছে। কালিকটের বেশিরভাগ মানুষকেই ফঁসিতে। ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে মায়েদের ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারপর মায়েদের গলায় বাচ্চাদের ফাঁস দিয়ে বেঁধে ফাসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও বর্ণনা দিয়েছেন যে, কীভাবে হিন্দু ও খ্রিস্টান প্রজাদের হাতির পায়ের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মন্দির ও চার্চগুলিকে পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
ফ্রাঙ্কোইস ফিডেল নামক একজন ফরাসি সৈন্য যিনি মরিশাস থেকে মহীশূর এসেছিলেন টিপুর পক্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তাঁর লেখা কিছু তথ্য ১৯৮৮ সালে প্যারিসে পাওয়া যায়। সেই সৈন্য লিখেছেন যে ম্যাঙ্গালোর অধিকার করার পর টিপু নিরপরাধ ব্রাহ্মণদের কাটা মাথা রাস্তা। দিয়ে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেন যাতে বাকি হিন্দুরা ভয় পায়। কোঝিকোড়ের ২০০০ ব্রাহ্মণ হিন্দুকে তিনি হত্যা করেন।
এছাড়া দক্ষিণ ভারতের বহু ঐতিহাসিক টিপুর স্বৈরাচারিতার বহু উদাহরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এহেন ধর্মবিদ্বেষী, অত্যাচারী, স্বৈরাচারী শাসককে ‘দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? অবশ্যই টিপু সুলতান অত্যন্ত আধুনিকতার সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। রকেট টেকনোলজি উদ্ভাবন করা থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে নতুন নতুন বিধি ব্যবস্থা সবই টিপু সুলতান করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনোমতেই ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। একজন শাসক যদি নিজের প্রজাগণকে নির্মমভাবে হত্যা করেন তাদের ধর্ম ইসলাম নয় বলে, তাহলে আর যাইহোক কোনো নিরিখেই তাকে দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দেওয়া যায় না। তিনি নিজের রাজ্যেই জেহাদের ডাক দিয়ে হাজার হাজার হিন্দু প্রজাকে হত্যা করেন। ‘জেহাদ’কে বা হিন্দুপ্রধান কন্নড় রাজ্যকে ইসলামি রাজ্যে পরিণত করাকে কি স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যেতে পারে? টিপুর এই চরিত্রের সঙ্গে কিন্তু দেশপ্রেম, দেশভক্তি, ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে জাতির উন্নতি কোনো কিছুরই মিল পাওয়া যায় না। তাই টিপুর শাসনাধীন অঞ্চলের মানুষরাই তাকে কোনোভাবে ‘কন্নড় নায়ক’মানতে রাজি নন। টিপুর চোখে ছিল শুধু ইসলাম প্রসারের লক্ষ্য। তাই তার সাম্রাজ্যের শেষের দিকে কন্নড়ের মতো উন্নত ভাষাকে সরিয়ে বিদেশি ফার্সি ভাষাকে সরকারি ভাষা করে দেন। মহীশূর সাম্রাজ্যের নানা ঐতিহ্যপূর্ণ শহরের প্রাচীন হিন্দু নাম পাল্টে আরবি নাম রাখেন যেমন— ম্যাঙ্গালোরের নাম পাল্টে করেন জালালাবাদ, মহীশূরকে নাজারাবাদ, জিন্দিগুলকে খালিফাবাদ, রত্নাগিরিকে মুসতফাবাদ, কোঝিকোড়কে নাম পাল্টে করেন ইসলামাবাদ। টিপুর মতো ধর্মীয় উন্মাদ শাসককে দেশপ্রেমিক আখ্যা দেওয়া নির্লজ্জ তুষ্টীকরণের রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই হয়তো তৎকালীন বিশ্বখ্যাত কবিরা শিবাজী, রাণাপ্রতাপ এমনকী দক্ষিণ ভারতের কৃষ্ণদেব রায়ের মহানুভবতা নিয়ে কাব্য, কবিতা বা উপন্যাস রচনা করলেও টিপুসুলতানের ‘দেশপ্রেম’নিয়ে কেউ কলম ধরেননি।
পারুল মণ্ডল সিংহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.