২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে বলিষ্ঠ
সিদ্ধান্তগুলি। নিয়েছিল তার মধ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার উদ্যোগ
অন্যতম। এই উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। আনা হয় যা
লোকসভায় বিরোধিতার জন্য। সরকার বিলটিকে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটিতে
পাঠাতে বাধ্য হয়। তিন বছর বাদে ২০১৯ এর জানুয়ারি মাসে বিলটিকে ফের
নতুনভাবে আনা হয় কিন্তু লোকসভা ভোট এসে যাওয়াতে ফের বাধা আসে। ২০১৯-এ
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এনডিএ ফিরে আসার পর বিলটিকে ফের নিয়ে আসা হয়
এবং সেটি লোকসভায় পাশ করে রাজ্যসভায় পাশ করা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষায়।
রাজ্যসভায় পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে সারা দেশে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি
হবে বিশেষত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে যেখানে অনুপ্রবেশের সমস্যা রয়েছে।এখন
সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা NRC
(National Registrar of Citizen)-র কী প্রয়োজন? এর উত্তরে বলতে হয় একটি
পরিবারের কর্তাকে যেমন হিসাব রাখতে হয় পরিবারে কজন আছেন, কজনের রান্নার
ব্যবস্থা করতে হবে ঠিক তেমনই একটি রাষ্ট্রপ্রধানকে হিসাব রাখতে হয় তার
দেশে কতজন নাগরিক রয়েছে যাতে যে সরকারি সুযোগ সুবিধা অনুদান পাঠানো হয়
সেটি দেশের নাগরিক ছাড়া বাইরের কেউ মানে অনুপ্রবেশকারীরা ভাগ না বসায়,
রুটি রুজি ছিনিয়ে না নেয়। দুনিয়ার নিয়ম হলো সুখী ও সম্পন্ন প্রতিবেশীর
ঘরে, দুঃখী ও দরিদ্র প্রতিবেশীরা ভিড় জমায়। এই ভিড় যখন কাম্য হয়না তখন
বেড়া দিতে হয়। ব্যারিকেড বসাতে হয় যাতে আটকে দেওয়া যায় এই অবাঞ্ছিতদের
ভিড়। দেশকে রক্ষা করা যায় ধর্মশালা হয়ে যাওয়ার হাত থেকে। জাতীয়
নাগরিকপঞ্জিও সরকারের হাতে থাকলে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা যায় ও
বিতাড়ন করা যায়। পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশে এই ব্যবস্থা আছে। তাই জাতীয়
নাগরিকপঞ্জি গঠন একটি সময়ের দাবি।
এখন প্রশ্ন হলো অনুপ্রবেশকারী কাদের
বলব? রাষ্ট্রসঙ্রে উদ্বাস্তু বিষয়ক কমিটির এব্যাপারে পরিষ্কার নির্দেশিকা
রয়েছে। তারা বলছে ধর্মীয় নিপীড়নের কারনে যদি কোনো ব্যক্তি একদেশ থেকে
অন্যদেশে চলে আসতে বাধ্য হয় তাদেরকে অনুপ্রবেশকারী বলা যাবে না। তাদেরকে
শরণার্থী আখ্যা দিতে হবে। যেমনটা সব অমুসলমান মানে হিন্দু, বৌদ্ধ,
খ্রিস্টান, শিখ, জৈন ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান,
আফগানিস্তান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। আর এই সমস্ত ইসলামিক দেশ থেকে
যেসমস্ত মুসলমান বেআইনিভাবে ভারতবর্ষে এসেছে শুধুমাত্র ব্যবসা বাণিজ্য করার
জন্য এদেশের সম্পত্তি ব্যবহার করে সুখে থাকবে বলে—তাদেরকে বলা হচ্ছে
অনুপ্রবেশকারী। ভারতীয় জনতা পার্টি খুব পরিষ্কার করে বলছে যে তারা
শরণার্থীদের। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেবে কিন্তু
অনুপ্রবেশকারীদের দেবে না।
এমন অনেকের মনে প্রশ্ন হলো সব মুসলমান কি
অনুপ্রবেশকারী ? উত্তরটা অবশ্যই না। যেসমস্ত মুসলমান বাংলাদেশ তৈরি হবার
আগে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে এদেশে এসেছেন তাদের ভারতীয় মুসলমান
বলে গণ্য করা হবে এবং তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হবে। বিজেপি
ছাড়া ভারতবর্ষের বেশিরভাগ অনান্য রাজনৈতিক দল মুসলমান ভোটের লোভে বলছে
ধর্মের ভিত্তিতে শুধুমাত্র অমুসলমানরাই এদেশের নাগরিকত্ব পাবে এমন আইন তারা
করতে দেবেনা।তার অর্থ এই দাঁড়ায় বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে যেই আসবে তারাই
ভারতের নাগরিকত্ব পাবে। মুসলমানদেরও অধিকার থাকবে বাংলাদেশ ছেড়ে এখানে
এসে নাগরিক হওয়ার। এই অধিকার যদি সেসব দেশের মুসলমানরা না পায় তাহলে
হিন্দুরাও পাবে না। এখন যারা এই যুক্তি দিচ্ছেন তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন
১৯৪৭ সালে মুসলিম লিগের দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ধর্মের ভিত্তিতে
দেশভাগ হয়েছিল—তাহলে সেখানকার মুসলমানদের এদেশে আসাটা কি বৈধ যখন তাদের
নিজেদের দেশ রয়েছে? ওইসব দেশের যারা অমুসলমান রয়েছে যারা অত্যাচারিত,
ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া ভারতের ঐতিহ্য। যুগ যুগ ধরে
ভারতবর্ষে নিপীড়িতদের আশ্রয় দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। তাই বিজেপি
শরণার্থীদের আশ্রয় দেবে কিন্তু অনুপ্রবেশকারীকে কখনই না।
এখন প্রশ্ন
হলো, ভারতবর্ষে এই অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কত? এর উত্তরে বলতে হয় ভারতে
অনুপ্রবেশ হয় যে দেশগুলি থেকে তার মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও আছে মায়ানমার,
আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান। মায়ানমার থেকে আগত বার্মিজরা মূলত আছে
মিজোরামে। এদের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। এছাড়া ওই দেশ থেকে আগত পঞ্চাশ
হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান ধরলে সংখ্যাটা মোট দাঁড়ায় দেড় লক্ষ। এছাড়া
আফগানিস্তান থেকে প্রায় ১৫০০০ এবং পাকিস্তান থেকে প্রায় ৭০০০
অনুপ্রবেশকারী এদেশে রয়েছে। এই তিনদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে
মাথাব্যথার কারণ নেই যেটা আছে বাংলাদেশিদের নিয়ে। ১৯৯৮ সালে কেন্দ্রীয়
স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী যেটা ১ কোটি ৮০ লক্ষ যা বর্তমানে ৩
কোটি পৌঁছালেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
বলাবাহুল্য এই অনুপ্রবেশের ফলে
ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে জনবিন্যাসে পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫১ সালে ভারতবর্ষে
যেখানে অমুসলমান ছিল ৯০% এবং মুসলমান ছিল ১০%, সেখানে ২০১১তে এসে
দাঁড়িয়েছে অমুলমান ৮৫% এবং মুসলমান ১৫%। মুসলমানদের মধ্যে শিশুজন্মের হার
বেশি বলেই যে এদেশে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনটা কিন্তু নয় তার
প্রমাণ পরের তথ্যগুলি থেকে পাওয়া যাবে। ২০১১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী
পাকিস্তানে শেষ দশ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৬% এবং বাংলাদেশে ১৪% অথচ
ভারতে মুসলমান বৃদ্ধির হার প্রায় ২৫%। শতকরা ৭০ ভাগ মুসলমান দেশে জনসংখ্যা
বৃদ্ধির হার ভারতে মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকেও কম। এটা কী করে
সম্ভব? সম্ভব হচ্ছে এই কারণেই যে সেদেশ থেকে হিন্দুরা তো আসছেই মুসলমানরাও
আসছে। তাই ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা এমন উচ্চ হারে বৃদ্ধি। এরপরও কি
অনুপ্রবেশ সমস্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে?
এবার আসি অসমের এনআরসি
প্রসঙ্গে। অসমের এনআরসি ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ এবং তার পরবর্তী
সংশোধনীর উপর নির্ভর করে হয়নি। এটি হয়েছে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও ‘অগপ’এ-র মধ্যে এক চুক্তি অনুযায়ী ও সুপ্রিম
কোর্টের নির্দেশে। এটি সংসদে তৈরি করা কোনো আইন নয় যে সারা ভারতে
প্রযোজ্য হবে। সুতরাং যারা অসম চুক্তির ভিত্তিবর্ষ পশ্চিমবঙ্গে প্রযোজ্য
হবে ধরে নিয়ে শোরগোল তুলছেন তারা জেনে শুনেই এনআরসি যাতে না হয় তার জন্য
মিথ্যাচার করছেন। অসম চুক্তি অনুযায়ী ভিত্তিবর্ষ ও তারিখ ২৪/৩/১৯৭১ নয়।
১.১.১৯৬৬। এই চুক্তি অনুযায়ী যারা ১.১.১৯৬৬ এর আগে অসমে এসেছেন। তারা
নাগরিকপঞ্জিতে নথিভুক্ত হবেন। যারা ১.১.১৯৬৬ থেকে ২৫.৩.১৯৭৭ এর মধ্যে
এসেছেন তারা প্রাথমিকভাবে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ গেলেও দশ বছর পর এন আর সি-র
অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং ২৪.৩.১৯৭১ এর পর যারা এসেছেন তাদেরকে বিতাড়ন করা
হবে। এটাকে ভিত্তি ধরে ১.১.১৯৬৬ থেকে ২৪.৩.১৯৭১ পর্যন্ত মোট প্রায় ৭৫
হাজার জনকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের মধ্যে একজনও বাঙ্গালি নেই।
অতএব বাঙ্গালিদের জন্য out of date কার্যকর হচ্ছে ২৪.৩.১৯৭১ থেকে। এই
তারিখের আগে যারা এসেছেন তারা। নাগরিকপঞ্জির অন্তর্ভুক্ত হবেন এর পরে এলে
হবেন না। তবে এই নাগরিকপঞ্জি অনুযায়ী প্রায় ৭ লক্ষ হিন্দুর নাম বাদ চলে
গেছে তাই বিজেপি অসমের এই এন আর সি এর বিপক্ষে। বিজেপির বক্তব্য সারা দেশে
যে নিয়মে এনআরসি হবে অসমেও সেই নিয়মে হবে। তাই অসমে আবার এনআরসি হবে এবং
তা হবে সারা দেশের সঙ্গে একসাথে।
এবার আসি সেই প্রসঙ্গে কারা পাবেন
ভারতের নাগরিকত্ব। ভারতের নাগরিকত্ব আইন তৈরি হয় ১৯৫৫ সালে। তারপর ।
তিনবার সেটির সংশোধন হয়। সর্বশেষ হয়। ২০০৩ সালে। পুরানো নাগরিকত্ব আইন
অনুযায়ী ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না, যদিও থাকা
উচিত ছিল। সেই কারণে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসে এই সমস্যার মূলে
আঘাত করেন অর্থাৎ নাগরিকত্ব সংশোধনী Story of Citizen Amendment Bill
(CAB) নিয়ে আসেন। এই বিলটি ২০১৯ সালে নতুনভাবে নিয়ে আসার পর যা বলা হয়
সেটি হলো—
(১) পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে মুসলমানরা Cut of date 24/3/1971 এর পরে আসলে নাগরিকত্ব পাবেন না।
(২) ওই তিন দেশ থেকে আগত সমস্ত শরণার্থী Cut of date 31/12/2014 এর আগে এদেশে আসলে নাগরিকত্ব পাবেন।
(৩) ওই তিন দেশ থেকে আগত শরণার্থী যারা ভারতে এক বছর ধরে বসবাস করছেন তারা নাগরিকত্ব পাবেন।
সবশেষে
বলতে হয় অনেক ঘাম রক্ত ঝরানোর পর বাম-ঐস্লামিক গোষ্ঠীর চক্রান্ত বানচাল
করে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি যে পশ্চিমবঙ্গ আমাদের উপহার দিয়েছেন তা যেন
বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের থেকে ছিনিয়ে না নেয়। হিন্দু
বাঙ্গালিদের এই বাসভূমি যেন সাময়িক লাভ ও লোভের রাজনীতি, ধর্ম নিরপেক্ষতার
নামে ধর্মীয় তোষণের জন্য হাতছাড়া না হয়ে যায়। এখনও যদি আমরা সতর্ক না
হই আমরা আমাদের উত্তরপুরুষদের কাছে কৈফিয়ত দিতে পারব না। এই ভয়ংকর
পরিণামের হাত থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র এনআরসি। একজনও হিন্দু, একজনও
এদেশের অমুসলমান, একজন ভারতীয়কে ভারত ছেড়ে যেতে হবে না। এই আশ্বাস
নরেন্দ্র মোদীর, এই অঙ্গীকার ভারতীয় জনতা পার্টির। গুজবে কান দেবেন না।
প্ররোচনাতে বিভ্রান্ত হবেন না। দেশবিরোধী শক্তি বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে
অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের এই অপচেষ্টাকে রুখে দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ তথা
গোটা ভারতবর্ষে এনআরসি চালু হোক এই আমাদের সকল দেশপ্রেমিকের দাবি।
ড. সুদীপ ঘোষ
2019-11-08