আদালতের নির্দেশ সকলেরই মান্য করে চলা উচিত। পুলিশ প্রশাসনেরও দায়িত্ব আছে। পাশাপাশি মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগে যাতে আঘাত না লাগে, তা দেখার দায়িত্ব। যেমন প্রসাসনের, আদালতের ওপরও সেই দায়িত্ব বর্তায় বই কী! ছট পুজোর দিনে রবীন্দ্র সরােবরের তালা ভেঙে পুণ্যার্থীরা তাদের ধর্মীয় রীতি পালন করতে গিয়েছিলেন, তাঁরা আদালতের নির্দেশ জানতেন কী জানতেন না, তার থেকেও বড়াে প্রশ্ন এঁদের সজাগ করার দায়িত্ব তাে প্রশাসনের, তারা কী করছিলেন? সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার, রীতির কিছু বাহ্যিক পরিবর্তনের উদারতা হিন্দুসমাজের আছে। দুর্গাপুজোতেও এখন গঙ্গায় কেবল প্রতিমাই নিরঞ্জন হয়, পুজোর উপকরণ ডাঙ্গায় ফেলা হয়। হিন্দুধর্মে পরিবেশ-ভাবনা ও সচেতনতার নজির আছে। তাই জলদূষণ এড়াতে ডাঙ্গাতেই কুশ ফেলা রীতি, জলে নয়। আসলে এসব নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে রাজনীতির।
সােশ্যাল মিডিয়ায় টুকরাে টুকরাে মন্তব্য শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কেউ একে পরিবেশের ধর্ষণ বলে তুলনা টানছেন, আবার ‘পক্ষ’রা বলছে বিহারিদের বাঙ্গলা থেকে তাড়াতে হবে। কেউ বা এতে বিজেপির চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছে। আবার আরেকদল বিজ্ঞান’-এর নামে ধুয়াে তুলছে সূর্য পুজোটুজো আবার কী! বন্ধ করাে এসব। ফলে এখন যে পরিস্থিতির দিকে পশ্চিমবঙ্গ চলেছে তাতে ভাষাভিত্তিক জাতিদাঙ্গা অচিরেই বাঁধবে এবং তা রুখতে না পারলে সর্বনাশ অনিবার্য। স্বাধীনতার পর থেকে একটা ব্যাপার ভারতীয়দের গা সওয়া হয়ে গেছে। নানা ভাবে, জাতপাতকে ভিত্তি করে হিন্দু সমাজকে টুকরাে করা এবং এই বিভাজন নীতি নিয়ে (যাকে পরিভাষায়) ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’পলিসি বলা যায়) মনের সুখে ভারতভূমিতে লুঠপাঠ করাে, বৈদেশিক শক্তির ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করাে। মােদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই ষড়যন্ত্রীদের অস্ত্র ভোতা হয়েছে, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতাে সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে জনজাতি মানুষকে একত্রিত করে, বিভিন্ন ভাষাভাষী, জাত-বর্ণের সমাহারে ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজের ছবিটা তুলে ধরার কাজটা করে চলেছে, রাজনৈতিক বিরােধিতা তাদের কঠোর সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিলেও পিছুপা তারা হননি।
মােদী-অমিত শাহের নেতৃত্বে অন্তত রাজনৈতিক উত্থান সমগ্র হিন্দু সমাজ দেখিয়েছিল বহু মুসলমান তাদের আরব-সস্তৃত ‘ধর্মীয় পরিচয়কে আস্তাকুঁড়ে ফেলে, উপাসনা-পদ্ধতির স্বতন্ত্রতা উপেক্ষা করে বৃহত্তর হিন্দু-সমাজের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল—খণ্ডিতনয় এক ঐক্যবদ্ধ চেহারার ভারত প্রকাশ পেয়েছে। এক দেশ, এক বিধান, এক নিশান, এক প্রধান— অতীতের গৌরবশালী ভারতবর্ষ আবার বর্তমান সময়ে এক জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের উপক্রম করেছে, আরবীয় সংস্কৃতির দালালরা তারা। যে দলভুক্তই হােন না কেন, তৃণমূল কিংবা সিপিএম বা কংগ্রেস, এর ফলে তারা জ্বলবেই। তাই জাতপাতের খেলা বন্ধ হতে এখন ভাষাভিত্তিক ও সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজনের নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বােনা হয়েছে।
এই বিভাজন নতুন নয়। স্বাধীনতার পর যেমন জাতপাতকে কেন্দ্র করে বিভাজনের রাজনীতি হয়েছিল। এবার বিভাজনের নতুন অস্ত্র প্রাদেশিকতা। প্রাদেশিকতার ইন্ধন স্বাধীনতার পরও দেশবাসী দেখেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বুকে যে প্রাদেশিকতার। ইন্ধন চলছে তাতে বৃহত্তর বাংলাদেশের ষড়যন্ত্র চলছে। ‘৪৭-এ দেশভাগের সময় অখণ্ড বঙ্গের ধুয়াে তুলেছিল ইসলামিক সাম্প্রদায়িকরা, তাতে যােগ দিয়েছিল বিপথ চালিত কিছু হিন্দু-নেতা ও বলা বাহুল্য কমিউনিস্টরা। আজ আবার সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ছট পুজাকে কেন্দ্র করে বিহারি খেদাও অর্থাৎ বিহারের মানুষকে এরাজ্য থেকে তাড়ানাের ডাক দেওয়া হয়েছে। বাঙ্গালি হিন্দুদের বােঝানাে হচ্ছে। মুসলমানরাই তাদের প্রকৃত বন্ধু, তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম। যে সম্প্রদায়টি আসলে পরধর্মবিদ্বেষী, পরমত অসহিষ্ণু, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে যারা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে কাফের বলে ডাকে তাদের ভ্রাতৃচেতনা মুসলমানের মুরগি বাৎসল্যের সমান।
তাই বাঙ্গালি হিন্দুকে তাদের স্বার্থ উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশে হিন্দুদের কী শােচনীয় পরিস্থিতি তা খেয়াল রাখতে হবে। ‘৪৭-এ শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন, বাঙ্গালি হিন্দুদের মান বেঁচেছিল, আজ এই পরিস্থিতিতে তার অভাব পূরণ করার দায়িত্বভার নিতে হবে। তাই সচেতনতা আপনা থেকেই গড়ে তুলতে হবে। নইলে বিপদ কিন্তু দরজায় কড়া নাড়ছে।
বিশ্বামিত্র-র কলম
2019-11-08