২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কলকাতার দমদমের এক জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন মোদীজি। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে দিদির খবরদারি আর হম্বিতম্বি দেখে প্রধানমন্ত্রী তখন তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন। দিদির ভাবভঙ্গি এমন যেন বাংলা নিয়ে তিনি ছাড়া আর কেউ কিছু বলার অধিকারী নয়। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী দিদি ও তাঁর ভাইপোকে সাবধান করে বলেছিলেন তাঁরা যেন বাংলাকে তাঁদের ব্যক্তিগত জায়গীর না ভেবে নেন। দেশের পরিবারতান্ত্রিক দলগুলি কখনো ক্ষমতায় এলেই সে রাজ্যে হোক বা কেন্দ্রে ক্ষমতার অংশীদার হতে পারলেও দেশের জল জঙ্গল ঘর বাড়ি সবই তার এমন একটা বোধ কাজ করতে শুরু করে। নামে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জাঠ সরদার চরণ সিং সংসদের মুখোমুখি না হলেও, তাঁর পুত্র অজিত সিং বাবার দিল্লিতে ক্ষমতার সুবাদে কিছুদিন বসবাস করা বিশাল বাড়িটি জাদুঘর করার নাম করে হাতিয়ে নেয়ার খুব মতলব করেছিলেন। কিন্তু মোদী সরকার এসেই তাঁকে বাড়ি ছাড়া করে। কাশ্মীরের জায়গীরদার আব্দুল্লা মুফতিরা সব আইন পাস করিয়ে সারা জীবনের জন্যে প্রাসাদোপম সব অট্টালিকা হাতিয়ে বসে ছিল। ৩৭০ ধারা উঠে যাওয়ায় সব বেআইনি মালিকানা কেড়ে নেওয়া হবে। এর মধ্যে কংগ্রেস নেতা গোলাম নবীও বাড়ি করে নিয়েছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লির গান্ধী সুলতানি আমলের তো জন্মগত অধিকার বলেই তাঁরা মনে করেন। বিষয়টা হঠাৎই সামনে এসে গেছে। দিল্লির মহামান্য নেহেরু লাইব্রেরির পরিচালনপর্ষদ থেকে মল্লিকার্জুন খাড়্গে, জয়রাম রমেশ ও কর্ণ সিং এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী, অমিত শাহ, রাজনাথ সিং তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে দিল্লির ক্ষমতাভগি মহলে গেল গেল রব উঠেছে। স্বাভাবিক নিয়মে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলই তার মনমতো প্রতিনিধি রাখে। ক্ষমতাভোগে অভ্যস্ত তাঁরা ভুলে গেছেন এক সময় কী ভাবে অত্যন্ত কদর্যভাবে ১৯৭২-এ দিল্লি আইআইটি থেকে ড. সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর মতো পণ্ডিতকে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে অভিনেতা অনুপম খেরকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এঁদের তো মেয়াদ সমাপ্ত। এটি তো পৈতৃক অধিকার নয়।
সোরগোল হচ্ছে নেহরুবাদী সংস্কৃতি নাকি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তা হলে সংরক্ষণটি কেমন হচ্ছিল? ২০০৯-এর জুন মাসে গান্ধীবাড়ির পোষিত ইতিহাসবিদ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’ পুস্তকে নেহেরুকে টঙে তোলা রামচন্দ্র গুহ জাদুঘরের কর্তাদের হতাশ করে লিখছেন এখানে বৌদ্ধিক চর্চা লাটে উঠেছে। ১০.৯ কোটি টাকা খরচ করার আদেশ এসেছে। খরচা হয়েও চলেছে কিন্ত সংস্থার লক্ষ্যের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য আছে বলে মনে হয় না। তবে সেমিনার কক্ষে যুব কংগ্রেস দলের মিটিং ও হৈ হল্লা প্রায়শই হয়। সমাজবিজ্ঞানী শ্রী রতন শারদা এই প্রসঙ্গে বলেছেন বর্তমান গান্ধী পরিবার আদতে দিল্লি ও আশপাশের মূল্যবান বহু ভূসম্পত্তির সর্ব বৃহৎ বেনামদার। নজর করলেই দেখা যাবে ন্যাশনাল হেরাল্ড থেকে নেহেরু প্ল্যানেটোরিয়াম, ইন্দিরা গান্ধী সেন্টার অফ এক্সিলেন্স রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন এঁরা সর্বপ্রাপ্ত। এনডিএ সরকার দেশের উৎকর্ষের প্রতিষ্ঠানগুলির এইভাবে বকলমে পারিবারিক সম্পত্তি হয়ে ওঠা আটকাতে ওই জায়গাতেই একটি নতুন সংগ্রহালয় গড়ে দেশের পূর্বতন সকল প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতি ও জীবন বৃত্তান্ত সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তাইতেই পরিবার ও তার প্রসাদ ভিক্ষার্থীরা ক্ষেপে উঠেছে । তাদের অন্যায় ক্ষমতা ভোগ বন্ধ হয়ে যাবে। রাহুল গান্ধী ২০১৯-এর নির্বাচনী ভাষণে বলেছিলেন ক্ষমতায় এলেই সব জায়গা থেকে আরএসএসের লোকদের তাড়াবেন। ঠিকই তিনি পরিবারের বাইরে কাউকে ক্ষমতা দিতে রাজি নন। দেখলেন না অতো নাটকের পরও বাইরের কেউ কংগ্রেস সভাপতি হতে পারল না। স্রেফ পরিবারের রোষে পড়ার ভয়ে। কিন্তু দল পারিবারিক সম্পত্তি হলেও জাতীয় সম্পত্তিগুলির বাটোয়ারা রুখতেই হবে। সেই প্রক্রিয়া চলছে। ও সব উত্তরাধিকার সংরক্ষণের নামে জাতির সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার দিন শেষ। আরএসএসের জাতীয়তাবাদীরাই দায়িত্ব নেবে। দেশের ভার তাদের হাতেই মানুষ দিয়েছে, পরিবারের হাতে নয়। ভুলো মৎ।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়