নরেন্দ্র মোদী সরকার জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ সংবিধান মেনে বৈধ পদ্ধতিতেই করেছিল বলে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সেই সঙ্গে জানিয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই জম্মু-কাশ্মীরে করতে হবে ভোট। দ্রুত ফেরাতে হবে রাজ্যের মর্যাদা। পাশাপাশি বিচারপতি সঞ্জয় কিষেণ কউল আলাদা রায়ে জানিয়েছেন, জম্মু-কাশ্মীরবাসী প্রজন্মের পরে প্রজন্ম যন্ত্রণা বইছেন। তাই অন্তত ১৯৮০-র দশক থেকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-বহির্ভূত শক্তির হাতে হওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করতে সত্যানুসন্ধানী কমিশন গড়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরবাসীর বড় অংশের মতে, লুপ্ত অনুচ্ছেদ ছিল তাঁদের ক্ষমতায়নের অন্যতম হাতিয়ার। ফলে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না তাঁরা। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সত্যানুসন্ধানী কমিশন নিয়েও বিশেষ আশাবাদী হতে পারছেন না অনেকে।
গোলমালের আশঙ্কায় জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাড়িয়েছিল কেন্দ্র তথা জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন। আজ সকাল থেকেই দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতির বাসভবনের দরজা ছিল বন্ধ। তাঁদের বাসভবনে মোতায়েন ছিল বিপুল বাহিনী। পরে ওমর ও মেহবুবা দাবি করেন, তাঁদের গৃহবন্দি করা হয়েছিল। বিকেলে গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্তি পান তাঁরা। এ দিন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার খবর মেলেনি। শান্তইছিল উপত্যকা।
রায় ঘোষণার পরে সমাজমাধ্যমে ওমরের বক্তব্য, ‘‘আমি হতাশ হয়েছি। কিন্তু ভেঙে পড়িনি। আমাদের লড়াই চলবে। ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ লোপ করতে বিজেপির কয়েক দশক সময় লেগেছে। আমরাও দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য তৈরি।’’ কবি ফৈজ়ের কবিতা উদ্ধৃত করে ওমর লিখেছেন, ‘‘আমার হৃদয় অসহায়, কিন্তু আশা মরেনি। কারণ, দুঃখের সন্ধ্যা বড় দীর্ঘ। কিন্তু এটা কেবল একটি সন্ধ্যাই।’’ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সমালোচনা করেছেন। আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত কনফারেন্সের নেতা মিরওয়াইজ় উমর ফারুকের বক্তব্য, ‘‘যাঁরা দেশভাগের সময়ে জম্মু-কাশ্মীরের ভারতভুক্তিতে সাহায্য করেছিলেন ও ভারতীয় নেতৃত্বের কথা বিশ্বাস করেছিলেন তাঁরা তো প্রতারিত বোধ করবেনই। ১৯৪৭ সালের জম্মু-কাশ্মীর সংঘর্ষবিরতি রেখায় বিভক্ত হয়েই আছে। এই মানবিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।’’
বিশেষ মর্যাদা লোপের পরে কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীরে বাসিন্দার মর্যাদা, জমি অধিগ্রহণ ও সরকারি চাকরি পাওয়ার আইনে বড় পরিবর্তন এনেছে সরকার। বর্তমানে কোনও ব্যক্তি ১৫ বছর জম্মু-কাশ্মীরে থাকলে ‘ডোমিসাইল’ শংসাপত্র পেতে পারেন। তার ভিত্তিতে তিনি জমি কিনতে পারেন। পেতে পারেন সরকারি চাকরিও। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আহমেদ ওয়ানির বক্তব্য, ‘‘এখন সব স্পষ্ট হয়ে গেল। চাকরি ও জমির সুরক্ষা আর নেই। ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে জম্মু-কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা স্থির করে জমি ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে সেই সুরক্ষাকবচ রইল না।’’ পাশাপাশি এ দিনের রায়ে জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা ও লোকসভা কেন্দ্রের সীমা পুনর্বিন্যাস কমিশন গঠনকেও সমর্থন করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ওয়ানি-সহ অনেকেরই ধারণা, জম্মুতে আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে ভবিষ্যতে সেখান থেকেই মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের ছক কষেছে বিজেপি।
আর সত্যানুসন্ধানী কমিশন? কাশ্মীরের মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী পারভেজ় ইমরোজ়ের মতে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকায় ফেরার ব্যবস্থা করতেই এই কমিশন তৈরি করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমাদের রাজ্য মানবাধিকার কমিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অভিযোগ জানানোর মঞ্চই নেই। হাজার হাজার অভিযোগ ঝুলে রয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, রাজৌরিতে যুবককে খুন করেও রক্ষা পেয়েছেন সেনা অফিসার। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক শামিমের মতে, ‘‘ধীরে ধীরে উপত্যকায় সামরিকীকরণ বেড়েছে। কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই বেআইনি ভাবে আটক করছে বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, বাড়িঘর ধ্বংসের মতো অভিযোগ উঠলেও কোনও পদক্ষেপ করা হচ্ছে না।’’
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, বিশেষ মর্যাদা লোপের পরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী-সহ হাজার হাজার কাশ্মীরিকে আটক করা হয়েছিল। আটক হওয়া সাধারণ কাশ্মীরিদের অনেকেরই আর খোঁজ মেলেনি। এখনও প্রতি দিন যুবক-যুবতীদের আটক করে বাহিনী।
তবে গুলাম নবি আজ়াদ ও জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মহারাজ হরি সিংহের ছেলে ও কংগ্রেস নেতা করণ সিংহ মনে করেন পছন্দ না হলেও সুপ্রিম কোর্টের রায় মানতে হবে। উপত্যকার রাজনীতিকদের কর্ণের পরামর্শ, ‘‘বরং আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করুন।’’