মা মনসার পুজো করছেন ? করুন, আপত্তি নেই, খাঁটি বাঙালি সংস্কৃতি। খালি মনে রাখবেন সাপে কাটলে মা মনসা কিন্তু বেহুলার প্রার্থনায় আজকাল আর সাড়া দেন না। লখিন্দর এর ভেলা ভেসেই যাবে অবেলায়। যাতে না ভেসে যায় সে জন্য যমের অরুচি ডাক্তারগুলো কি বলে শুনবেন নাকি ? সাপে কাটা নিয়ে দু’চার কথা ?

১# সাপ নিয়ে অতিকথন ও বাস্তব:
সাপ মানুষের মতো সামাজিক প্রাণী নয়। সুতরাং সাপের যুগল বা জোড়া একটি অতিকথন।
গরুর বাঁট থেকে দুধ খাওয়ার মত সাপের মুখের গঠন নেই।
দুধ বা দুগ্ধ জাত পদার্থ সাপের খাদ্য নয়। দুধকলা দিয়ে কালসাপ কেন কোনো সাপই পোষা যাবে না।
সাপের স্মৃতি শক্তি খুবই দুর্বল। সাপের প্রতিহিংসা নেবার সব গল্পই অতিকথন।
সাপ মোটেই হিংস্র নয়। একাকী, নির্জনে থাকতে ভালোবাসে।
হটাৎ মানুষের মুখোমুখি হলে মানুষ যেমন পালাতে চায়, সাপও তেমনি ভয় পেয়ে পালাতে চায়। তাড়া করে করে কামড়ানোর ঘটনা বিরল থেকে বিরলতম দু একটি প্রজাতির সাপের স্বভাব।

২# কামড় এড়ানোর উপায়
যে কোনো সাপের সামনা সামনি পরে গেলে, একদম স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকুন । যেহেতু সাপের দৃষ্টি ও ঘ্রান শক্তি অতি ক্ষীন, আপনার ‘অবস্থান’ বুঝতে না পারলে এমনিই চলে যাবে ।
সাপের তীব্রতম অনুভুতির স্থান তার পেটের ‘সাদা’ অংশ , আপনি ছুটলে মাটির কম্পন থেকে সাপ আপনার ‘অবস্থান’ বুঝে নেবে ।
যে অঞ্চলে সাপের আধিক্য , সেখানে চলাচলের সময় হাতে লাঠি জাতীয় কিছু রাখুন,এবং সেটি মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে হাঁটুন ,সাপ তার স্বাভাবিক জৈব প্রবৃত্তি বশে,পালিয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে সাপ অত্যন্ত ভীতু, আত্মরক্ষার তাগিদ ছাড়া সে কামড়ায় না ।
দুটি একই প্রজাতির সাপকে পাশাপাশি দেখলে এড়িয়ে চলুন। সম্ভবতঃ পুরুষ ও স্ত্রী , যৌন মিলনের তাগিদে কাছাকাছি ( সাপ স্বভাবত একা থাকতে পছন্দ করে ) এই অবস্থায় তাদের প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করা শক্ত।

৩# সাপ কামড়ালে স্হানীয় লক্ষণ:
দংশন চিহ্ন থাকতে পারে। আদৌ নাও থাকতে পারে। একটি বা দুটি দাঁতের দাগ থাকতে পারে। ছড়ে যাওয়ার দাগ থাকতে পারে। ওই দাগ দেখে বোঝা অসম্ভব যে কি ধরণের সাপে কামড় দিয়েছে।
দংশন স্থানে ফোলা ও ব্যথা থাকবে। ফোলা টি আকার আয়তনে বাড়তে থাকবে।

৪# অন্যান্য লক্ষণ:
চোখ ঢুলু ঢুলু বা শিবনেত্র, চোখে ঝাপসা দেখা, কথা জড়িয়ে আসা। রুগী আচ্ছন্ন হতে থাকলে তার সাথে অনবরত কথা বলে তাকে জাগিয়ে রাখতে হবে।
গলা ব্যথা।
পেটে ব্যথা
শরীরের নানা জায়গা থেকে রক্ত ক্ষরণ

৫# ক্ষত স্থানের পরিচর্যা:
ক্ষতস্থানে বরফ ঘষবেন না। ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেবেন না।
ক্ষতস্থানটিকে চেরা-কাটা করবেন না, তাতে শিরা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ওভাবে বিষ বের হয় না।
ক্ষতস্থান থেকে চুষে বা পাম্প করে রক্ত বের করার করবেন না। ওতে লাভ নেই।
ক্ষত স্থানে কোনও রকম কেমিক্যাল, চুন ইত্যাদি লাগাবেন না। এতে রোগ নির্ণয়ে অসুবিধে হয়।
মুরগীর পায়ু, বিষ পাথর ইত্যাদি আদ্যন্ত বোগাস।

৬# অন্যান্য পরিচর্যা:
শান্ত থাকতে হবে। দৌড়ানো বা সাইকেল চালানো বারণ। এসবে বিষ আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।
হাঁটাচলা যথা সম্ভব কম। যে হাতে বা পায়ে দংশন হয়েছে সেই অঙ্গটিকে স্প্লিন্ট ব্যবহার করে তার নাড়াচাড়া বন্ধ রাখতে হবে যেমনটি করা হয় হাত পা ভেঙে গেলে।
কোনো অবস্থাতেই শক্ত বাঁধন বা ট্যুরনিকেট বা তাগা ব্যবহার করবেন না। এভাবে বিষ ছড়ানো আটকানো যায় না। বরঞ্চ রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে মারাত্নক ক্ষতি, যেমন গ্যাংগ্রিন হতে পারে। চুড়ি, বলা, আংটি খুলে রাখবেন।
রুগীকে আশ্বস্ত করতে হবে। আমাদের দেশের ৭০% সাপ বিষহীন। কামড়ের সময় সাপের বিষ থলিতে পূর্ন মাত্রায় বিষ নাও থাকতে পারে। ছোবল দিলেই বিষ ঢালবে এমনটা নয়।
রুগীকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ খাওয়াবেন না। দংশনের পর মদ খাবেন না।

৭# নির্দিষ্ট চিকিৎসা:
রুগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব (১০০ মিনিট) এর মধ্যে শয্যা বিশিষ্ট কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ঝাড়ফুঁক, বিষ পাথর, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি চিকিৎসার শরণাপন্ন হবেন না। ওসব করে কোনো ফল পাওয়া যায় না। মূল্যবান সময়ের অপচয় হয় যার ফলে মৃত্যু হতে পারে।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে সাপে কাটা রোগীর শারীরিক লক্ষণ দেখে কি জাতীয় বিষ ঢুকেছে বা আদৌ ঢুকেছে কিনা তা স্থির করা হয়। তাই সাপ, জ্যান্ত বা মৃত, ধরে আনলে বা মোবাইলে ছবি তুলে আনলে সেটা চিকিৎসকের কোনো কাজে লাগে না।। মনে রাখবেন চিকিৎসক তার শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ, তিনি সর্প বিশারদ নন। সাপের ফনা দেখে বিষ আছে কি নেই চেনা যায় না। অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখতে হয়।

৮# সব সরকারি হাসপাতালে সাপের বিষ এর প্রতিষেধক বা এন্টি স্নেক ভেনাম সিরাম বিনে পয়সায় পাওয়া যায়।
রুগী জটিল হলে ভেন্টিলেটর বা ডায়ালিসিস এর প্রয়োজন হয় যে গুলি কেবলমাত্র বাছাই করা হাসপাতালে পাওয়া যায়।

৯# ব্যবস্থাপনা:
সাপের বিষ এর প্রতিষেধক (এন্টি স্নেক ভেনাম। সিরাম) তৈরী হয় দক্ষিণ ভারতে। সেগুলি আজকাল কিছু ক্ষেত্রে বাংলার সাপের বিষ এর বিরুদ্ধে কাজ করছে না। বাংলায় ওই প্রতিষেধক তৈরির কাজ শুরু করা আশু প্রয়োজন।
গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ হাসপাতালে সাপের কামড়ের চিকিৎসার প্রাথমিক ওষুধগুলির সরবরাহ সুনিশ্চিত করা আশু প্রয়োজন।
জেলা স্তরের পাশাপাশি মহকুমা স্তরেও ডায়ালিসিস এর ব্যবস্হা করাও আশু প্রয়োজন।

১০# প্রচার:
সরকার, অসরকারী সংগঠন, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ যুক্তিবাদী মানুষ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে প্রচারের জন্য। সাপের কামড়ে ২০২৩ সালে কেউ বিনাচিকিৎসায় বা ভুল চিকিৎসায় মারা যাবেন এটা মানা যাবে না।

বেলা অবেলায় অবহেলায় বেহুলার ভেলা ভাসাতে দেবেন না কিছুতেই।

(ছবি: Bratin Sarkar)

সমুদ্র সেনগুপ্তের কলমে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.