সন্তকথাঅন্নদা ঠাকুর: দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা।

[মাতৃসাধক অন্নদা ঠাকুর গণেশ দেউস্করের লেখা ‘ঝান্সীর রাণী’ বইটি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। আদ্যামায়ের পূজা যেমন করেছেন, মাতৃজাতির প্রতিও ছিল চিরকালীন সম্মান। অবলা, অত্যাচারিতা, নিপীড়িতা, পতিতা, রক্ষিতা মেয়েদের প্রতি ছিল অপার করুণা এবং স্নেহ। তাদের দুঃখ ঘোচানোর জন্য সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। কাশীতে থাকাকালীন প্রায় ১৮-১৯ জন দরিদ্র কন্যার বিবাহের ব্যবস্থা করেন। পণ প্রথার বিরোধী তিনি। তাঁর মতে স্বাধীনতা হারিয়ে হিন্দু যেদিন পাঠানের পদানত হল, আর্যাবর্তে সেদিন থেকে নিরাকারের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হল। সেই সময় থেকেই আমাদের অধঃপতন শুরু।]

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে আদ্যামায়ের উপাসক অন্নদা ঠাকুর চাক্ষুষ দেখেন নি কোনোদিন (১৮৮৬ সালে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে), কিন্তু ভাবরাজ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের পরম ভক্ত ছিলেন তিনি এবং সর্বদা স্বপ্নাদেশের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। স্বপ্নেই তাঁর দীক্ষালাভ ঘটে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষভাগে, আনুমানিক নয়ের দশকের শুরুতে কার্তিকের এক কৃষ্ণাসপ্তমী তিথিতে বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার নদীনালা বেষ্টিত এক গ্রামে দরিদ্র এবং ধর্মপ্রাণ পরিবারে অন্নদাচরণ ভট্টাচার্য বা অন্নদা ঠাকুরের জন্ম। পিতা অভয়াচরণ ভট্টাচার্য এবং মাতা তিলোত্তমা দেবী। অন্নদার তিন ভাই এবং দুই বোন। তিনি ছিলেন পিতামাতার মধ্যম সন্তান। জানা যায় তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম শ্যাম এবং বোনেদের নাম যথাক্রমে নীরদা ও প্রিয়দা। তাঁর পিতামহ ছিলেন পুণ্যশ্লোক, সদাশিব, দাতা এবং পরোপকারী। তাদের গ্রামের বাড়ির পিছনে ছিল ছোটো নদী, আরও দক্ষিণে গিয়ে তা বড় নদীতে পড়েছে। গৃহ পরিসরে ছিল নানান গাছপালা, তুলসীমঞ্চ, কলাগাছ, তেঁতুলগাছ ইত্যাদি, সাজানো গোছানো গৃহস্থালি; বাড়ির সম্মুখে পূর্ব দিকে একটি পুকুর। অন্নদার মা মঙ্গলচণ্ডীর ভক্ত ছিলেন। বাড়িতেই ছিল দশভুজা ঘর।

মা স্বপ্নে নানান ওষুধ পেতেন এবং তা দিয়ে পাড়া-পড়শিদের নানান দুর্ঘটনা ও রোগসমস্যায় তিনি তাদের সাধ্যমতো চিকিৎসা করতেন। জানা যায় দেড় বছর বয়সে অন্নদা কঠিন রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং দৈব ওষুধে নিরাময় ঘটে। ৫-৬ বছর বয়সে তিনি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেন, তাঁর প্রথম পাঠ্য বই ছিল ‘বর্ণবোধ’। ১৩-১৪ বছর বয়সে তিনি চট্টগ্রামের কাছে কক্সবাজারের সাগরে সামপানে চড়ে যাবার সময় একটি চলন্ত স্টিমারের উপুর্যুপরি তরঙ্গে এবং তুফানে প্রায় নৌকাডুবির মতো অবস্থা ঘটে এবং দৈবক্রমে তিনি তা থেকে রক্ষা পান। অন্নদার বাড়ি থেকে ৭-৮ ক্রোশ দূরে হাওলা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি কালাচাঁদ ঠাকুর যেখানে হত্যা দিয়ে অপুত্রা সন্তানলাভ করতেন বলে খ্যাতি ছিল।

আনুমানিক ২০ বছর বয়সে কাশীধাম থেকে কলকাতায় এলেন অর্থকরী বিদ্যাভ্যাসের জন্য। ইচ্ছে কবিরাজ হবেন। মা তিলোত্তমার আশীর্বাদ ও অনুমতি মিললো। কিন্তু কলকাতার প্রায় ৫০ জন কবিরাজের কাছে যাতায়াত করেও পড়ার কোনো সুবিধা হল না। অবশেষে কুমারটুলির নিবাসী কবিরাজ হেমরত্ন সেন এবং বিডন স্ট্রিটের কবিরাজ বিরজাচরণ কবিরত্নের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে বৃত্তি পরীক্ষায় বসলেন এবং তাতে উত্তীর্ণ হওয়ায় আর্থিক সাশ্রয় ঘটলো, তাঁর পক্ষে অধ্যায়ন সম্ভব হল, কাউকে খোসামোদ করতে হল না। ঝামাপুকুরে মহারাজ দিগম্বর মিত্রের দাতব্য চিকিৎসালয়ের উপরিতলে স্থাপিত নবনির্মিত আয়ুর্বেদিক কলেজে তিনি ভর্তি হলেন। সেই গৃহে বিনামূল্যে স্থানলাভ হল এবং বৃত্তির টাকায় ফ্রী বোর্ডিংয়ে দুইবেলা খাবার বন্দোবস্তও হল। এখানে দেড় বছর অবস্থান করলেন, পরে পটলডাঙ্গায় কবিরাজ শরচ্চন্দ্র সাংখ্যতীর্থের বাড়িতে বছর খানেক ছিলেন।

এরপর তিনি ১০০ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটে তাঁর বন্ধু যতীন্দ্র নাথ বসু ও তাঁর ভাই শচীনের আগ্রহে তাদের গৃহ সিদ্ধেশ্বর-ভবনে থেকে স্ব পাক ভক্ষণ করে আরও ২/৩ বছর কাটান এবং এরমধ্যে তাঁর আয়ুর্বেদিক ডিগ্রি লাভ হয়। তখন তাঁর বয়স প্রায় ২৫ বছর। আয়ুর্বেদ পড়তে পড়তে তাঁর মা ভীষণ রোগাক্রান্ত হলেন, সেই সময় রোগশয্যায় মাতৃআজ্ঞায় জন্মমাস চতুর্থ রবিতে অন্নদার বিবাহ সম্পন্ন হয়, তখন অন্নদার বয়স প্রায় ২২-২৩ এবং সহধর্মিণী মণিকুন্তলা দেবীর বয়স ১৪-১৫ বছর। মণিকুন্তলাদেবী পরে দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সঙ্ঘজননী রূপে পূজিতা হয়েছিলেন। আয়ুর্বেদ পড়াকালীন তিনি কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট ধরে চলতে গিয়ে এক সন্ধ্যায় চারটি মেয়ের মাথায় করে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া কালীমূর্তি দর্শন করে এবং তার স্বরূপ উপলব্ধি করে ভাবোন্মাদ হলেন, তখন তিনি যতীন-শচীনদের গৃহে অবস্থান করছেন। সেই সময় ৮-১০ দিন বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হলে তিনি সেই পরিবারের অকুণ্ঠ সেবাযত্ন পেয়েছিলেন। পরে তাঁর পিতা খবর পেয়ে মাসাধিক কালের জন্য চট্টগ্রাম নিয়ে যান। তখন গৃহে আগত বহু সান্নিধ্য লাভ করেন। এরপর স্বাভাবিক হয়ে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন৷ আয়ুর্বেদ পড়াকালীনই ভাবোন্মাদ অবস্থার পূর্বে তিনি ১৯১৩ সালে কলকাতায় ডি. এল. রায়ের সঙ্গে দেখা করে পণপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী (নাটক ও গান) প্রদর্শন করেন ও বলিষ্ঠ মতামত ব্যক্ত করেন। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তখন ‘ভীষ্ম’ নাটক লিখছেন। তিনি কথা দেন, এরপর পণপ্রথা নিবারণ সম্বন্ধে একটি নাটক লিখবেন৷ কিন্তু তার কিছু পরেই তিনি অকাল প্রয়াত হন।

কবিরাজ আগেই হয়েছেন। এবার শুরু হল কবিরাজি ব্যবসায়ের উদ্যোগ। বন্ধুপিতা সিদ্ধেশ্বর বসু ৫-৬ টি গুরুত্বপূর্ণ আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির জন্য দুই হাজার টাকা দিলেন এবং সহকারী হিসাবে মধ্যমপুত্র যতীন্দ্রনাথ বসুকে জুড়ে দিলেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল ওয়ার্কসের কর্মধার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হল। তিনি ও তাঁর ম্যানেজার পরামর্শে ও সহায়তায় ওষুধ তৈরির যাবতীয় বন্দোবস্ত হল। কারখানা ও করণের নাম দিলেন পিতার নামে, ‘অভয়া সুধা কার্যালয়’। বিজ্ঞাপনের জন্য প্রচুর হ্যাণ্ডবিল ছাপানো হল। অফিসে আলো, আসবাব, আলমারি এলো। লোকজন, এজেন্ট, ক্যানভাসার, বড় বড় প্ল্যাকার্ড সবই হল৷ কিন্তু কোথায় কী!

অন্নদার আয়ুর্বেদ ব্যবসা শুরু হল না। তিনি এক বসন্তী পূজার মধ্যে স্বপ্নাদেশ পেলেন রামনবমীর দিন কলকাতার ইডেন গার্ডেনে একটি পাকুড় ও নারকেল গাছের সংযোগ স্থলের তলায় পুকুরের ভেতর থেকে আদ্যামায়ের মূর্তি উদ্ধার করতে হবে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, পুলিশি ধরপাকড় এড়িয়ে তা উদ্ধার করা হল। শচীনের বাড়িতে সন্তর্পণে রাখা হল। কলকাতার মানুষের ভীড় উপচে পড়ছে। হিতবাদী, বেঙ্গলী প্রভৃতি পত্রিকায় আদ্যামায়ের প্রতিমূর্তিসহ ঘটনা সংবাদ হিসাবে প্রকাশিত হল। সেদিন রাতেই মায়ের ফের স্বপ্নদেশ হয় বিজয়া দশমীর দিন মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে। ভক্তদের মধ্যে হল প্রবল দোলাচল। অবশেষে আদেশ মতো পঞ্চানন ঘোষ লেনের ফটোগ্রাফার বলাই মিত্রকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে রাখা হল। এই ছবির আদলেই পরে আদ্যাপীঠ মন্দিরের জন্য আদ্যা মায়ের মূর্তি নির্মিত হয়।

এরপর অন্নদা ঠাকুর মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সংগ্রহে নানান প্রয়াস করলেন। এমনকি কেন্দুবিল্বের ব্রাহ্মণসভায় গেলেন, গেলেন কাশীধামে। পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে কাশীতে মন্দির নির্মাণ পরিকল্পনা বন্ধ হল৷ এদিকে চিকিৎসালয় স্থাপনের জন্য প্রদত্ত টাকার যোগানদাতা সিদ্ধেশ্বর বসুর সঙ্গে তর্কবিতর্ক হলে, তিনি তাদের বাড়ি ছেড়ে ১৫ নম্বর বৃন্দাবন মল্লিক লেনে ভূপেন বাবুর মেসের একতলার ঠাণ্ডা ঘরে চলে এলেন। চলতে থাকলো তাঁর ‘স্বপ্নজীবন’, শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বারেবারে স্বপ্নযোগ ও তাঁর নির্দেশ পালন। অন্নদা ঠাকুরের লেখা গ্রন্থ ‘স্বপ্নজীবন’-এ সেই অলৌকিক জীবনের কথা সরলভাবে এবং বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাতে সাধুজীবনের বহু অপ্রকাশ্য গুহ্য রহস্য তিনি প্রকাচ করেছেন। পাশাপাশি তা ভক্তজীবনে ভগবানের অপূর্ব লীলার পরিচায়ক। স্বপ্নাবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে যে কথোপকথন হয় তা ‘রামকৃষ্ণ মনঃশিক্ষা’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।

১৩২৫ বঙ্গাব্দ বা ১৯১৮-১৯ সাল নাগাদ তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে স্বপ্নে সন্ন্যাস দীক্ষা পান বলে জানা যায়। এরপর তিনি এক বছর পিতৃ-মাতৃ সেবা করেন; পরের একবছর সস্ত্রীক সাধনা। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের পৌষ সংক্রান্তির দিন সমাপ্ত হল সেই সাধনা। উৎযাপিত হল পুরশ্চরণ ব্রত, যা আদ্যাপীঠের প্রথম সিদ্ধোৎসব।

মন্দির নির্মাণের আদেশপ্রাপ্তি হয় এক ঝুলন পূর্ণিমার দিন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে বা ১৯২৬-২৭ সালে আদিষ্ট মন্দির নির্মাণের জন্য তিনি জমি ক্রয় করে আদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও তাঁর অনুগামী ও ভক্তবৃন্দের হাত ধরে আদ্যামায়ের বিগ্রহ উদ্ধারের পর সলতে পাকানো হতে থাকে আদ্যাপীঠ গড়ের ওঠার পর্ব। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ বা ১৯২৮ সালে মাঘীপূর্ণিমার দিন মন্দিরের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তার একবছর পর ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে তিনি পুরীধামে দেহরক্ষা করেন। পরে ১৩৪০ বঙ্গাব্দে মন্দির নির্মাণ কার্য আরম্ভ হয়। সাত দফায় সকল কাজ সমাপ্ত হয় ১৩৭৩ বঙ্গাব্দের মকর সংক্রান্তিতে ১৯৬৭ সালে। আদ্যাপীঠের আদিষ্ট মন্দিরে দেবী কালিকা আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে পূজিতা হলেন। মন্দিরের অন্তর্ভাগে ওঙ্কারের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় দেবী আদ্যার মূর্তি, পদতলে শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানরত মূর্তি, দেবীর শীর্ষে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি স্থাপিত, অর্থাৎ নিচ থেকে শুরু করে গুরু, জ্ঞান ও কর্ম এবং প্রেম। আদ্যাপীঠ মঠের অবস্থান প্রায় ২৭ বিঘা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। মন্দিরের আনুষঙ্গিক কাজ রয়েছে আদর্শ জননী ও আদর্শ গৃহিণী নির্মাণের জন্য বালিকা আশ্রম প্রতিষ্ঠা, বালকদের ব্রহ্মচর্যাশ্রম হিসাবে বালকাশ্রম প্রতিষ্ঠা, বাণপ্রস্থাশ্রম ও দাতব্যচিকিৎসালয় পরিচালনা।

কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.