ব্যাঙ্কে কারও অ্যাকাউন্ট নেই। কিন্তু বাড়ি বাড়ি চলে এল এটিএম কার্ড। এহ বাহ্য, সেই এটিএম কার্ড নতুন নয়। প্রথম এটিএম কার্ডের মেয়াদ ফুরোনোর পর নতুন যে এটিএম কার্ড ইস্যু করা হয়, সেই কার্ডই এসেছে পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষের কালনা গ্রামে। একটি, দু’টি নয়, কয়েকশো এটিএম কার্ড নিয়েই এখন রাতের ঘুম উ়ড়েছে গ্রামবাসীর। তাঁরা ভাবছেন, অ্যাকাউন্টই নেই, তা হলে প্রথম মেয়াদে এটিএম ব্যবহার করল কে!
ঘটনার সূত্রপাত পাঁচ, ছ’মাস আগে। একটি ক্যুরিয়ার সংস্থার প্রতিনিধি ব্যাগ ভর্তি এটিএম কার্ড নিয়ে কালনা গ্রামে হাজির হন। কিন্তু কার্ড ভরা খামের উপর গ্রাহকের নাম-ঠিকানা মিললেও ফোন নম্বর মিলছিল না। ক্যুরিয়র সংস্থার প্রতিনিধি খামের উপর যে মোবাইল নম্বর ছিল সেই নম্বরে ফোন করলেও কাউকে পাচ্ছিলেন না। বাধ্য হয়ে একে-ওকে জিজ্ঞেস করেন। দেখা যায়, গ্রামবাসীদের নামেই এসেছে ব্যাগ ভর্তি এটিএম কার্ড। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের বর্ধমান শহরের কার্জন গেটের পাশে সিটি টাওয়ার শাখা থেকে কার্ডগুলি ইস্যু করা হয়েছে।
গ্রামের বাসিন্দা রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বলা হয়, আমাদের নাকি অ্যাকাউন্ট আছে ওই ব্যাঙ্কে! তাই গ্রাহকদের নামে এটিএম কার্ড এসেছে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হল, এটি প্রথম কার্ড নয়। প্রথম বার এটিএম কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বার যে এটিএম কার্ড ইস্যু হয়, তাই এসেছে!’’ গ্রামবাসীদের স্পষ্ট দাবি, তাঁরা কোনও দিনই ওই বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় কোনও অ্যাকাউন্ট খোলেননি। না চাইতেই পাওয়া এটিএম কার্ড ফেরাতে ওই বেসরকারি ব্যাঙ্কের সিটি টাওয়ার শাখাতে হাজির হন কয়েক জন গ্রামবাসী। গ্রামবাসী শেখ মতিউর রহমান বলেন, ‘‘আমরা কয়েক জন মিলে ব্যাঙ্কের শাখায় গেলে প্রথমে কর্তৃপক্ষ কোনও পাত্তাই দেননি। পরে আরও বেশি লোক নিয়ে ব্যাঙ্কে যাই। তখন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার জানান, আমাদের নামে নাকি এখানে অ্যাকাউন্ট আছে! তাই এটিএম কার্ড গিয়েছে বাড়িতে।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী বলেন, ‘‘আরও জানতে পারি, গত কয়েক বছরে এক এক জনের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোটা টাকার লেনদেন হয়েছে। অথচ আমরা গ্রামের মানুষ পুরোপুরি অন্ধকারে।’’
অ্যাকাউন্ট যে তাঁদেরই, তা বোঝাতে ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে পাসবুকে তাঁদের ছবিও দেখানো হয়। যা দেখে চমকে যান গ্রামবাসীরা। মতিউর বলে চলেন, ‘‘সে-ও এক অদ্ভুত! কেউ মাঠে একশো দিনের কাজ করছেন, কেউ বাড়িতে রান্না করছেন, আবার কেউ গোয়ালে কাজ করছেন— সেই অবস্থার ছবি দিয়ে ব্যাঙ্কে নাকি আমরা অ্যাকাউন্ট খুলেছি!’’ গ্রামবাসীরা এর পর প্রশাসনের কাছে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানান। তবে তাতে এখনও পর্যন্ত কোনও কাজ হয়নি বলে দাবি তাঁদের। পাঁচ মাস ধরে তদন্তই কেবল চলছে!
বিরোধীদের অভিযোগ, গোটা ঘটনায় শাসকদলের নেতারা জড়িত। তাঁরাই এই কারসাজি করছেন। বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চন্দ্র বলেন, ‘‘দক্ষিণ দামোদর এলাকায় যেমন প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপাদন হয়, তেমনই এখানে বহু সংখ্যক রাইসমিলও রয়েছে। এক শ্রেণির অসাধু রাইসমিল মালিক স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশ করে গ্রামের মানুষের নামে অবৈধ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। সঠিক তদন্ত হলেই আসল রহস্য ফাঁস হবে।’’ একই দাবি সিপিএম নেতা বিনোদ ঘোষেরও। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল নেতারা এই ঘটনায় জড়িত। সঠিক তদন্তের দাবি জানিয়েছি। তা হলেই সব বেরিয়ে আসবে।’’
খণ্ডঘোষ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি তথা জেলা পরিষদের অধ্যক্ষ অপার্থিব ইসলাম বলেন, ‘‘এই ধরনের কোনও ঘটনার কথা জানা নেই। যদি কিছু হয়ে থাকে তা হলে তদন্তের মাধ্যমে তা প্রকাশ্যে আসবে।’’ জেলা পরিষদের সভাধিপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার বলেন, ‘‘অভিযোগ জমা পড়েছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।’’