১৯৪৮ সালের জানুয়ারি। নতুন বছরের সূচনা হচ্ছে । দিল্লি তখন এক বিষাদময় ও শীতলতম আবহাওয়ার গ্রাসে। স্বল্প কিছুকাল আগে প্রাপ্ত স্বাধীনতা এবং তজ্জনিত দেশ বিভাজনের ফলস্বরূপ ২০লাখ শিশুর অমানবিক হত্যা ও প্রায় দেড় কোটি মানুষের নিজস্ব ভিটেমাটি ছেড়ে নি:স্ব হওয়ার সাক্ষী তখন পুরো দেশ । শুধুমাত্র দিল্লিতেই তখন লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভিড়। তাদের চোখের জলে যমুনা সিক্ত, তাদের দু:খ ও দুর্দশায় আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। শরণার্থী শিবিরের ম্লান ও থমথমে পরিবেশেই তা স্পষ্ট।
নিজের জ্ঞাতির বহুলোককে আধাকাটা মৃতদেহ হিসাবে ট্রেন-বোঝাই হয়ে লাহোর থেকে এদেশে পৌঁছনোর দৃশ্য এবং সব হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ জীবিত শরণার্থীর হাহাকার পুরো দেশের চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া, দাঙ্গায় অসংখ্য প্রাণহানি, এমনকী লক্ষাধিক শিশুর বাঁচার শেষ সুযোগটুকু না পাওয়া, অগণিত মহিলার যথেচ্ছ শ্লীলতাহানি, খুন–সব মিলিয়ে খুবই হৃদয়বিদারক গোটা দেশের পরিমণ্ডল। ভারত তখন এইভাবেই অগণিত নিরীহ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের মূল্য দিচ্ছে এবং মুষ্ঠিমেয় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ক্ষমতালাভের লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফল ভুগছে ।
॥ কংগ্রেসকে ভেঙ্গে দাও ॥
তখনকার সেই দিনগুলিতে , সারা দেশ যখন বিধ্বংসী হিংসায় জর্জ্জরিত ও ক্ষতবিক্ষত তখন ১৯৪৮-এর সূচনায় জানুয়ারি মাসেই মহাত্মা গান্ধী তাঁর সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘হরিজন’ পত্রিকায় লিখলেন–
”…..ভারত তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে। তাই কংগ্রেস রাজনৈতিক দলটি তার বর্তমান রূপে ও আকারে এখন আর সময়োপযোগী নয় । সে-কারণে তাকে ভেঙে ফেলা উচিত । এখন এই পর্যায়ে দেশে সার্বিকভাবে এমন সামাজিক ন্যায়িক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দরকার যাতে ভারতের ৭০০০ গ্রাম সমভাবে বিভিন্ন শহর ও শহরতলির অংশীদার হতে উঠতে পারে; যাতে দেশে অসামরিক প্রতিষ্ঠান ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব না লাগে: যাতে দেশের উন্নতি ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যাহত না হয় । তাই দেশের সুষ্ঠু পরিচালনা ও সামগ্রিক উন্নতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলি যাতে উগ্র ও
অসুস্হ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয় ও দেশ চরমপন্হী শক্তিগুলির কবলে চলে না যায় এবং আরও নানা বাস্তবিক কারণে অখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির উচিত কংগ্রেস পার্টিকে ভেঙ্গে ফেলা এবং এক মানবরচনামূলক ও মানবকল্যাণমূলক লোক কল্যাণ সংঘ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা ।”
॥ মানবরচনাকারী ও মানবকল্যাণকারী সংঘের রচনা ॥
শুধু বলেই থেমে থাকলেন না, সেই মাসেই গান্ধীজি কংগ্রেসকে ভেঙে নতুন লোক কল্যাণ সংঘের প্রস্তাবনা ও খসড়া পত্র তৈরি করে ফেলেন। তিনি মূলভূতভাবে ‘সেবক’ কথাটি ব্যবহার করেন ভবিষ্যৎ ভারতের নেতাদের জন্য এবং তাদের বিস্তারিত আচরণবিধি ও নিত্যকাজের একটি নিয়মাবলিও তৈরি করেন।
- তারা সকলেই নিজের হাতে তৈরি খাদির কাপড় পরবে।
- তারা তাদের নিজেদের দৈনন্দিন কার্যাবলির লিখিত বিবরণ রাখবে।
- তারা তাদের ক্ষমতার অন্তর্গত এলাকাতে সমগ্র গ্রামবাসী তথা অধিবাসীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখবে।
- তারা তাদের ক্ষমতার অন্তর্গত এলাকার গ্রামগুলিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে স্বাবলম্বী করে তুলবে স্হানীয় কৃষিকর্ম ও হস্তশিল্পের মাধ্যমে।
- তারা তাদের এলাকার সমস্ত গ্রামবাসীকে মৌলিক স্বাস্হ্যসচেতনতা ও স্বাস্হ্যবিধি সম্বন্ধিত সমস্ত শিক্ষা দেবে এবং প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করবে যাতে তারা সুস্হ ও নিরোগ জীবনযাপন করতে পারে।
- তারা তাদের এলাকার সমস্ত গ্রামবাসীর জন্য ব্যবহারিক ও মৌলিক শিক্ষার ব্যবস্হা ও পরিকাঠামো নির্মাণ করবে।
এছাড়াও গান্ধীজি দেশের বিভিন্ন স্হানে তন্তুবায় সংঘ, গ্রাম শিল্প সংঘ , শিক্ষক সংঘ, হরিজন সেবা সংঘ এবং গোসেবা সংঘ গড়ে সকারাত্মক ভাবে ওইসব ক্ষেত্রের উন্নতির জন্য এবং সশক্ত ও স্বাবলম্বী দেশ বানানোর জন্য চেষ্টা করতে বলেন।
॥ Cui Bono ( ল্যাটিন ভাষায় মানে কার সুবিধার্থে) ॥
তদানীন্তন রোমে লুসিয়াস ক্যাসিয়াস নামে বহুজন সমাদৃত এক সৎ ও শ্রদ্ধাভাজন বিচারক ছিলেন, যিনি বিচারের সময় বারংবার ‘Cui Bono’ শব্দটির উপযুক্ত প্রয়োগ করতেন ।
তবে ওই পরিকল্পনা প্রকাশ ও রূপায়ণের আগেই আততায়ীর গুলিতে গান্ধীজির প্রাণ যায়। ফলে কংগ্রেস ভেঙে দেওয়া বা তাঁর লোক সেবক সংঘ স্হাপন প্রস্তাব রূপেই থেকে যায়। তাঁর মৃত্যুর ঠিক পরেই মহারাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-বিরোধী দাঙ্গাতে ব্রাহ্মণ সহ বহু লোকের জীবন নাশ হয় ও বহু পরিবার বাস্তুহারা হয়ে পড়ে । কিন্তু এতে সবচেয়ে লাভবান হয় কংগ্রেস। গান্ধীজির মৃত্যুতে তাদের শেষরক্ষা হয়, ভাগ্যও দারুণ ভাবে পরিবর্তিত হয় । তাই গান্ধীজির মৃত্যুর পরপরই কংগ্রেসের রাজনৈতিক সাফল্য ও ক্ষমতাবৃদ্ধিকে অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি এবং গান্ধীজির মৃত্যুর সময় নিয়েও নানা প্রশ্নও তাদের মনে দানা বাঁধে ।
কংগ্রেসের ক্ষমতাবান পরিবার গান্ধীজির পদবি ব্যবহার করে অত্যন্ত চালাকির সঙ্গে ভারতের সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিজেদেরকে দেশের সর্বেসর্বা করে তোলে । তারা গান্ধীজির নিঃস্বার্থ কাজকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে ক্রমে ক্রমে রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে চলে যায় এবং ধীরে ধীরে তাদের আচারআচরণ হয়ে দাঁড়ায় গান্ধীজির আদর্শ ও জীবনধারার পরিপন্থী ।
গান্ধীজির সাধারণ জীবন যাপন , দরিদ্রসেবা, গোসেবা , হরিজনসেবা , উন্নত বিকাশশীল পরিছন্ন ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী গ্রাম স্হাপন সবেরই প্রকৃতপক্ষে স্থান হয় আস্তাকুঁড়ে এবং নিছকই লোকদেখানো ও মেকি শ্রদ্ধা জানাতে গান্ধীজির ছবিকে কংগ্রেস স্হান দেয় মুদ্রাতে ও সরকারি অফিসের দেওয়ালে আর ২রা অক্টোবর জন্মদিনে জাতীয় ছুটি দিয়ে। ২রা অক্টোবর গান্ধীজির আদর্শ মেনে ছাত্রদের নিজ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও কর্মচারীদের নিজ কর্মপ্রাঙ্গণ পরিছন্ন রাখার শিক্ষা না দিয়ে তাদেরকে পূর্ণ বিরাম দিয়ে আমোদ প্রমোদ করতে ব্যস্ত রেখে গান্ধীজির প্রতি কোন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হচ্ছে তা বোঝা দুষ্কর।
অন্তত ৩০শে জানুয়ারি গান্ধীজির মৃত্যুদিনে, কংগ্রেসের তাবড় তাবড় নেতা, যারা শুধুমাত্র গান্ধীজির পদবি ব্যবহারে ব্যস্ত , তাদের উচিত দুমিনিটের লোকদেখানো নীরবতা পালন না করে গান্ধীজির শেষ ইচ্ছানুযায়ী রাজনৈতিক দল হিসাবে কংগ্রেসকে ভেঙে দিয়ে গান্ধীজির আদর্শানুরূপ লোক সেবক সংঘের প্রতিষ্ঠা করা ।