জাতীয় নবজাগরণের একটি ধারা ছিল সাহিত্যাশ্রয়ী, তাকে ‘ভাবসর্বস্ব ধারা’ বলা চলে। অনেক মনীষীই এই ধারণায় চলেছেন, তার একটি সার্বিক আবেদনও ছিল। এই ধারাকে বলা যায় জাগরূকের Top Down Approach বা উতর-চাপান। উপর থেকে নবজাগরণের ভাবপ্রবাহ সমাজের মধ্যে সাহিত্যের দুয়ার খুলে পৌঁছে দেওয়া। যারা ভেতরে আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিলেন তারাই এই ভাব-ধারায় জারিত হতে পারতেন। কিন্তু তার বাইরেও অসংখ্য দেশবাসী ছিলেন যারা নবজাগরণের সংজ্ঞা, স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে অপারগ ছিলেন৷ কাজেই নবজাগরণের বৃহত্তর ধারায় প্রত্যক্ষ সমাজের নানান সমস্যাকে অনুধাবন ও উপলব্ধি করিয়ে সমাজ ও জীবনের মধ্যে তার স্রোত বইয়ে দেবার মানুষ যারা ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল (৭ নভেম্বর, ১৮৫৮ — ২০ মে, ১৯৩২) সেই ধারার অন্যতন প্রতিনিধি। নবজাগরণের Bottom Up Approach বা ভূমি-উদ্ভূত ধারার অন্যতম দিশারি তিনি।
‘লাল-বাল-পাল’ এই ত্রিধারার বিশিষ্ট মুখ বিপিনচন্দ্র, যে ত্রয়ী মনে করতেন ‘স্বরাজ’-ই অভীষ্ট লক্ষ্য৷ বিপিনচন্দ্র পরিচিত হয়েছিলেন ‘বাংলার বার্ক’ নামে। বিশ শতকের প্রথম দশকে ভারতবাসী টের পেয়েছিলেন দেশের পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা কাকে বলে! কেবল বাংলা নয়, বঙ্গভঙ্গের সময় তিনি ভারত জুড়ে ব্রিটিশ-বয়কটের মতো নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন দিকে দিকে গড়ে তোলবার লক্ষ্যে নানান জায়গায় সক্রিয় হয়েছিলেন এবং বক্তব্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত করেছিলেন মানুষকে। দক্ষিণ ভারতেও তাঁর বক্তব্যের অনুপ্রেরণা পৌঁছালো জাতীয়তাবাদী মানুষের মধ্যে। সেই সঙ্গে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল তাঁর ক্ষুরধার কলম। সংবাদপত্রকে স্বরাজ-ভাবনার প্রকাশ-মাধ্যম করে তুললেন তিনি। বিপিনচন্দ্র ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনকে আধ্যাত্মিক আন্দোলন হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এ ঈশ্বরেরই কাজ, মনে করতেন তিনি।
কিন্তু তিনি আজ এক বিস্মৃত এবং উপেক্ষিত চরিত্র। বিবিধ প্রতিভায় বাংলা তথা ভারতের এক যুগকে তিনি প্রতিনিধিত্ব করলেও; বাংলার নবজাগরণে, শিক্ষা ও সাধনায় প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা বইয়ে দিলেও; সমসাময়িক যুগকে ছাপিয়ে পরবর্তী যুগের সঙ্গে সংযোগ-সামর্থ্য তৈরি করার ক্ষেত্রে পারদর্শী হলেও আমরা তাঁকে ভুলে গেলাম। এই বিস্মৃতির মূল কারণ সম্ভবত তদানীন্তন রাজনীতি।
বিদ্যাসাগর কলেজে পাঠ গ্রহণের সময় ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর আদর্শে বিপিনচন্দ্র পাল হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে হলেন ব্রাহ্ম। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাবে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হলেন তিনি। ১৮৮৫ সালে যোগ দিলেন কংগ্রেসে। ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক হিসাবে নিজেকে তৈরি করতে তিনি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড গেলেন (১৮৮৯)। বাগ্মিতার জন্যই সেখান থেকে অন্য একটি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা। দুর্দান্ত সেই বক্তৃতা, শুনে মোহিত হয়ে যেতেন মানুষ; তখনও স্বামীজি আমেরিকায় পৌঁছান নি। কিন্তু প্রবল ধাক্কা খেলেন আমেরিকার এক শ্রোতার কাছ থেকে; তিনি এক অতি সত্য অথচ তেতো-কথা শোনালেন বিপিনকে, বললেন একজন পরাধীন দেশের মানুষের কাছ থেকে কোনো কথাই তারা শুনবেন না, শুনলেও তা গ্রহণ করবেন না। কথাটি দারুণ বাজলো বিপিনের। শপথ নিলেন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতেই হবে, তারজন্য অগ্রণী ভূমিকা নেবেনই তিনি। ফিরলেন দেশে, সুযোগ পেলেন কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ন্যাশানাল লাইব্রেরি) গ্রন্থাগারিক হিসাবে কাজ করার, পড়লেন অসংখ্য বই। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের দীক্ষায় দেশের সনাতনী ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতিও আগ্রহ বাড়লো। সেইসময় দেশপ্রেম আর হিন্দুত্বের প্রতি আগ্রহকে সমার্থক বলে বিবেচিত হত। ঊনিশ শতকের শেষ দশকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে নিলেন বৈষ্ণব মতে দীক্ষা (তখনই বৈষ্ণব সাধনায় অনুরাগের শুরু। তাঁর লেখা ‘কৃষ্ণতত্ত্ব’ নিয়ে গ্রন্থও রয়েছে।) এরপরই শুরু হল রাজনৈতিক সক্রিয়তা — অনলবর্ষী বক্তৃতা আর সেই সঙ্গে নির্ভীক কলম। ১৯০১ সালে সম্পাদনা করলেন ইংরাজি সাপ্তাহিক ‘নিউইণ্ডিয়া’; তাতে চললো রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার। বুঝলেন দেশের কাজের জন্য বলিষ্ঠ মানুষ চাই। যোগ্য মানুষ তৈরির জন্য তাই দেশবাসীকে বারেবারে উদ্বুদ্ধ করলেন। সেইসময় বাঙ্গলার রাজনৈতিক আন্দোলনকে শেষ করে দেবার জন্য বাঙ্গলাকে ভাগ করলো ইংরেজ। ১৯০৫ -এ শুরু হল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, তার রাশ নিজের হাতে নিলেন বিপিনচন্দ্র। ১৯০৬-এর আগষ্টে প্রকাশ করলেন ইংরাজি দৈনিক ‘বন্দেমাতরম’, তাতে সামিল করলেন অরবিন্দ ঘোষকে। ব্যাস, আগুনে রাঙ্গা হল বাংলার বিপ্লববাদের দাবানল। অর্থাৎ অখণ্ডতার সাধনা দিয়েই অরবিন্দের জাতীয়তাবাদ শুরু হল। অখণ্ড বাঙ্গলার জন্য আন্দোলন। বঙ্গজননী আর ভারতমাতা অরবিন্দের কাছে ছিল অভিন্ন। বাঙ্গলাকে ভাগ করতে দেওয়া যায় না। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সামিল হয়ে দেশমাতৃকার ঋণ শোধ করতে উদ্যত হলেন অরবিন্দ।
১৯০৫-০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বরাজের বহুতর মাত্রা ফুটে উঠেছিল, তার একটি ধারা ছিল শিক্ষা-স্বরাজ। আর এই স্বরাজেরই ফলশ্রুতিতে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’-এর শুভ-স্থাপনা হল। এই মঞ্চেই শুভ আবির্ভাব হল অরবিন্দের; তার আগে তিনি বাঙ্গলায় রীতিমতো অপরিচিত, কাজ করছেন বরোদা রাজের রাজকর্মচারী রূপে। ডন সোসাইটি ও তার মধ্যমণি সতীশচন্দ্রের মূল্যবান আবিষ্কার অরবিন্দ ঘোষ, হয়তো তাতে সিস্টার নিবেদিতার যথেষ্ট ভূমিকা থেকে থাকবে। এই সতীশ-মণ্ডলীই বোধহয় বলতে পারতেন, “আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে/পরিচিত জনতার সরণীতে।” সে সময় বাঙ্গালার/ভারতের রাজনীতিতে সুরেন্দ্রনাথ অনেকটাই মলিন, কারণ তার নরম (মডারেট) মনোভাব। বঙ্গভঙ্গের উত্তাল মুহূর্তে তিনি বলতে পারেন নি ষোলোআনা স্বরাজ চাই, বলতে পারেন নি রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা — সর্বত্রই ষোলোআনা স্বরাজ আনতে হবে। কে বললেন? রাশভারী গলার দূরদর্শী দার্শনিক নেতা বিপিনচন্দ্র পাল।
অনেকের মতে ১৯০৫-০৮ সালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল মুখ বিপিনচন্দ্র — যেমন তার বিদ্যা, রাষ্ট্রীয় জ্ঞান, বিপ্লবের সঙ্গে সান্নিধ্য, তেমনই কর্তব্য নিষ্ঠা। আর তিনিই বাঙ্গালিকে সেই মননে উদ্দীপিত করলেন। তারই যথার্থ সঙ্গত দিলেন অরবিন্দ ঘোষ। কাজেই এ ছিল বিপিন – অরবিন্দের যৌথ উদ্যোগ।
১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় শিক্ষা পরিষদ। বিপিনচন্দ্র পাল জাতীয় শিক্ষার সেই আদর্শকে জীবনে গ্রহণ করলেন, স্বরাজ সাধনার অঙ্গ হিসাবে। তবে শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গীও ছিল, তা আর কারো মধ্যে সেরকমভাবে স্পষ্ট হয়ে দেখা যায় নি। তা হল, সংকীর্ণতার উর্ধে শিক্ষা ও জ্ঞান নিয়ে তাঁর উদার এবং বিমুক্ত দৃষ্টি। তিনি বিশ্বাস করতেন জ্ঞান সবসময় কাল এবং দেশ নিরপেক্ষ হয়, তা কখনই দেশ বা কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারে না। তাই বিদেশি দর্শন বা কলাবিদ্যা বলে যা কিছু আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তাও চেতনার রঙে আমাদেরই। জ্ঞানের জগতে অবগাহন করার ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকার আছে। বিশ্বজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে হলে রক্ষণশীল মানসিকতা ত্যাগ করতেই হবে।
তবে তিনি ‘বিলাতী ছাঁচে’ শিক্ষা প্রবর্তনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ভারতীয় শিক্ষাবিদের অনেকে সেই সময় সঠিকভাবে উপলব্ধি করতেই পারেন নি, বিলাতে এবং ভারতে শিক্ষিত হবার প্রক্রিয়ায় তফাৎ আছে৷ কারণ ভারতীয় জনসমাজ এবং পাশ্চাত্যসমাজের গঠন এক নয়, একেবারেই ভিন্ন। বিলাতে শিক্ষিত হবার গোড়ার কথা বর্ণমালা শেখা। জ্ঞান রাজ্যের সব চাবিকাঠি সেখানে বইয়ের পাতায় পাতায় রয়ে গেছে। কিন্তু ভারতবর্ষে নিরক্ষর মানুষও লোকশিক্ষার শিকড়ের শিক্ষায় শিক্ষিত হতেন। তাতে বর্ণমালার সম্পর্ক না থাকলেও চলত। জীবনচর্যা ও মানসচর্চায় সে জ্ঞান নিয়মিত সংবাহিত হত। সংস্কৃতির আবহে প্রভূত পরিমাণে জ্ঞান আহরণের সুযোগ থাকত। ফলে ভারতবাসীকে সে অর্থে ‘অশিক্ষিত’ বলা চলে না।
তিনি জাতীয় নিয়ন্ত্রণে এবং জাতীয় ধারায় সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক এবং কারিগর নির্মাণের জন্য তদনুরূপ শিক্ষা-ব্যবস্থা সংগঠনের পক্ষে উদ্যোগী হয়েছিলেন৷ এটা তাঁর শিক্ষা-দর্শনের থেকে এসেছিল। তাই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের বিষয়ে সমসাময়িক বাড়াবাড়ির পর্যায় তিনি মেনে নিতে পারেন নি। পাশ্চাত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি৷
ভাষাশিক্ষা সম্পর্কে তাঁর মতামত ছিল স্পষ্ট, বিদেশী ভাষা কখনই জাতীয় শিক্ষার বাহন হতে পারে না। মাতৃভাষাই একমাত্র শিক্ষার বাহন হওয়া সম্ভব — এই দরকারি কথাটি এর আগে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ বলে থাকলেও বিপিনচন্দ্র ভাব-বিলাসিতা বর্জন করে যুক্তিবাদী মনের বিশ্লেষণ দিয়ে তার সত্যকে দিকে দিকে প্রকাশ করলেন। এটাই তার অনন্য কাজ।
বিপিনচন্দ্র পালের বহুমুখী প্রতিভার সাক্ষী ছিল সমকালীন রাজনীতি ও সমাজনীতির ইতিহাস। তিনি কেবলমাত্র রাষ্ট্রনীতিবিদ, দেশনায়ক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, দার্শনিক ছিলেন না। তিনি একজন প্রগতিশীল শিক্ষাবিদও ছিলেন, যার পরিচয় আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বিপিনচন্দ্র পালের শিক্ষানীতি বুঝতে হলে তাঁর ব্যবহৃত ‘Spiritual Movement’ কথাটির অর্থ নিরূপণ করতে হবে, যে পন্থায় কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন লক্ষ্য নয়, কেবলমাত্র রাজনৈতিক পালাবদল লক্ষ্য নয়, ক্ষমতার রাজনৈতিক হস্তান্তর নয়; যথার্থ স্বাধীনতা পেতে প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের আত্মোপলব্ধি এবং অকুণ্ঠ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে৷ এই আত্মোপলব্ধি ও ত্যাগ আসে যথাযথ শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা থেকে৷ এই শিক্ষা আসবে জাতীয় শিক্ষার রূপায়ণে।
বিপিনচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখছেন, “ন্যাশানাল বা জাতীয় কথাটা আমাদের রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ-এর নিকট হইতে পাই নাই, আনন্দমোহন-এর নিকট হইতে পাই নাই, কেশবচন্দ্রের নিকট হইতেও পাই নাই। এ বিষয়ে আমাদের গুরু ছিলেন নবগোপাল মিত্র মহাশয় আর নবগোপাল মিত্র মহাশয়ের দীক্ষাগুরু ছিলেন পুণ্যশ্লোক রাজনারায়ণ বসু মহাশয়।” আমরা দেখতে পাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলছেন, ন্যাশানাল কথাটা সর্বপ্রথম প্রচলন করেন নবগোপাল মিত্র। সে সময় সবাই তাঁকে নাম দিয়েছিলেন ‘ন্যাশানাল মিত্র’। তিনি হিন্দু মেলা (১৮৬৭)-র গুরুত্বপূর্ণ আবেদক ছিলেন। বিপিনচন্দ্র পালকে আমরা দেখতে পাই এই নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত (১৮৬৮) ‘ন্যাশানাল জিমনাসিয়াম’-এর ছাত্র হিসাবে। যেখানে শারীরশিক্ষার সঙ্গে দেওয়া হত দেশভক্তি ও জাতীয়তাবাদের পাঠ। ছেলেরা যেমন দেশীয় লাঠিখেলা, কুস্তি, তলোয়ার যুদ্ধ শিখতেন, তেমনই ইউরোপীয় কসরতও সেখানে শিখতেন সমান তালে। ‘হিন্দুমেলা’-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিপিনচন্দ্রের শিক্ষা-ভাবনা আমাদের এক সুস্নাত বোধের জগতে নিয়ে যায়।
বিপিনচন্দ্রের মতে ভারতবর্ষের নবযুগের প্রবর্তক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। রামমোহন যে বীজ বপন করেছেন তা থেকেই ভারতবর্ষের নবজীবনের উৎপত্তি। সেই বীজই অঙ্কুরিত, পল্লবিত, পুষ্পিত ও ফলিত হয়ে আধুনিক ভারতবর্ষকে ছেয়ে দিয়েছে৷ যারা এই বীজে জলসিঞ্চন করেছিলেন, যাদের সেবা ও ত্যাগে সেই বীজ সতেজ বৃক্ষে পরিণত হয়েছিল, তাদের প্রায় সকলকেই তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। তাদের কারও কারও সঙ্গে তাঁর স্বল্পবিস্তর ঘনিষ্ঠতাও ছিল। এখন নবজীবন যখন, তখন তার মধ্যে শিক্ষা দর্শনও বাদ থাকে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৮২৩ সালের ১১ ই ডিসেম্বর রামমোহন তদানিন্তন বড়লাটকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, “আমাদের প্রয়োজন হল আবশ্যকীয় বিজ্ঞান (Useful Sciences), যেমন গণিত, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রসায়ন, শারীরবিদ্যা।”
১৯০৬ সালের মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা পরিষদে বিপিনচন্দ্র ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ও প্রচারক। এই সংগঠন গড়ে ওঠার পূর্বে ১৯০৫ সালের ১৬ ই নভেম্বর শিক্ষা বিষয়ক যে প্রাসঙ্গিক সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। এই সংগঠনের হয়ে তিনি শিক্ষা বিষয়ক বহু বক্তৃতা দেন এবং নিজের রচনায় শিক্ষা চিন্তার পরিচয় দিতে থাকেন। যদিও সংগঠন-নির্দিষ্ট শিক্ষা-ব্যবস্থাই প্রচার করতেন, কিন্তু সেই দর্শনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আপন চিন্তাধারাকে বিশিষ্ট রূপ দিতেন। বিপিনচন্দ্রের কণ্ঠ জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করলো। তিনি বললেন, জাতীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে এবং জাতীয় ধারায় পরিচালিত শিক্ষাই হচ্ছে ‘জাতীয় শিক্ষা’। তার সঙ্গে সংযোজন করলেন, এ শিক্ষা আপন মাতৃভাষাতেই সম্ভব। বললেন, জাতীয় শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে জাতীয় ভাগ্যের বাস্তব রূপায়ণ। পরবর্তীকালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি জাতীয় শিক্ষানীতিকে অনেকাংশে গ্রহণ করেছে৷
কর্মজীবনের শুরুতে কয়েকটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হলেও তাঁর শিক্ষক জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি৷ পরে তাঁকে সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও রাষ্ট্রনীতি চর্চা করতে হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি দেশের শিক্ষা সমস্যা নিয়ে উদাসীন ছিলেন না। তিনি শিক্ষার সংজ্ঞা নিরূপণ না করেও, শিক্ষা তত্ত্ব রচনা না করেও, তাঁর রচনায় এবং বক্তৃতায় মৌলিক শিক্ষাচিন্তা বিষয়ক নানান কথা বলেছেন। শিক্ষা ছাড়াও ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক হিসাবে তিনি নানান জায়গায় লোকশিক্ষা দিয়েছেন, রাজনৈতিক মঞ্চেও শিক্ষণীয় কথাই বলেছেন; তাই তিনি একজন আদ্যন্ত শিক্ষাবিদ।
তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল নৈতিক শিক্ষার উপর। মনে করতেন, সেটাই সমস্ত শিক্ষার ভিত্তি। নীতি শিক্ষার জন্য আমাদের পঞ্চ মাধ্যম (দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, কর্মপ্রয়াস, আবেগ) -এর যথাযথ অনুশীলন ও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার বলে মনে করতেন। মনে করতেন ব্রিটিশ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় চরিত্রের বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। কারণ এরসঙ্গে জাতীয় জীবনের যোগাযোগ অল্প। তিনি ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখলেন শিক্ষা বিষয়ে এবং তৎকালীন শিক্ষা-নীতির সমালোচনাও করলেন৷ এইভাবে সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসাবে শিক্ষাজগতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করলেন। তিনি বলতেন, শিক্ষায় বস্তুজ্ঞান জন্মাতে হবে, কেবল শব্দজ্ঞান নয়। ইংরেজরা তাদের শাসন পরিচালনার সুবিধার্থে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করে রেখেছে, কাজেই সেই শিক্ষা ভারতবর্ষের এবং ভারতবাসীর উপযোগী হতে পারে না।
এবার আলোচনা করবো, বিপিনচন্দ্রের জবানবন্দিতে বলা কিছু কথা, যার মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় প্রতিভাত হয়েছে৷ প্রথমে বলা যাক কর্মফল নিয়ে তাঁর অনুভবের কথা। তিনি বলছেন, বিশ্বের মুক্তি ভিন্ন ব্যক্তি মানুষের মুক্তি নেই। নিঃসঙ্গ একাকিত্বের কল্পনাও এই সৃষ্টিতে সম্ভব নয়। যতদিন না সমাজের সামগ্রিক প্রায়শ্চিত্তের শেষ হয়, ততদিন কারও মুক্তি নেই। মনুষ্য সমাজ এক সঙ্গবদ্ধতার ইতিহাস। এখানে মানুষ একা জন্মগ্রহণ করে না, একা নিজের সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফল ভোগও করে না; মানুষ বিশাল বিশ্বের অনাদিকৃত কর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে সংসারে জন্মায়। ইহজীবনে নিজের কর্ম দিয়ে বিশ্বের কর্মের বোঝাকে লাঘব করে অথবা বর্ধিত করে। সূতিকাগারের দরজায় দাঁড়িয়ে সেই ত্রিধারা-সঙ্গমের অনুভূতি পাওয়া সম্ভব, যেখানে সদ্যজাত শিশু তার পিতামাতার জীবন-ধারার মিলনে উৎপন্ন হয়ে প্রবাহের পথ পায়। জীবনস্রোতে বয়ে চলতে চলতেই অনুভূত হয়, বিশ্বের অনন্ত জীবন-স্রোতের ক্ষণিক তরঙ্গ। তিনি বলছেন (আত্মজীবনী ‘সত্তর বছর’), “মানুষের কর্মের দায় এক পুরুষ বা দুই পুরুষের নহে।… আমার জন্মে পিতামাতা তাঁহাদের কর্মবোঝা কেবল আমার মাথায় চাপাইয়া দেন নাই; তাঁহারাও পূর্ব-পুরুষদিগের কর্মের বোঝা মাথায় লইয়া এই পৃথিবীতে আসিয়াছিলেন।” মানুষ বিশ্বের কর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। একা জন্মগ্রহণ করে না, একা নিজের সুকৃতি ও দুষ্কৃতির ফলভোগ করে না, একা নিজের কর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে ইহলোকও ত্যাগ করে না। যাদের পেছনে রেখে যায়, তাদের মাথাতেই সেই বোঝা চাপিয়ে যায়।
তাঁর সমাজ ও ইতিহাস ভাবনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছে। সমাজকে চিনতে হলে, সমাজের ইতিহাসকে জানতে হলে সেই সমাজের অন্তর্গত স্বতন্ত্র মানুষগুলিকে চিনতে হয়৷ তিনি বলছেন, প্রত্যেক মানুষের জীবনে সমগ্র মানব সমাজের ইতিহাস প্রচ্ছন্ন রয়েছে। ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে সমসাময়িক সমাজ জীবনের ধারা মিলেমিশে থাকে। তাই সব মানুষের ভেতরে সমসাময়িক সমাজের জ্ঞান, ভাব ও কর্মচেষ্টা ফুটে ওঠার সুযোগ থাকে। এটি বলতে গিয়ে তিনি বস্ত্রবয়নের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। বললেন, টানা ও পোড়েন মিলে কাপড় বোনা হয়। তেমন প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন ও সামাজিক জীবন মিলে বিশ্বমানবের আত্মপ্রকাশের তাঁত উৎপাদিত হয়। এভাবেই ভিন্ন ভিন্ন জাতির বিভিন্ন কালপর্বের ইতিহাস রচিত হয়। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের গোড়ার কথা শোনাতে গিয়ে তিনি বলছেন, ব্যষ্টিরূপে ব্যক্তিকে ও সমষ্টিরূপে সমাজকে দেখতে হয়। ব্যষ্টিকে ছেড়ে সমষ্টির বাস্তবতা থাকে না। আবার সমষ্টিকে ছেড়প ব্যষ্টির সার্থকতা বোঝা যায় না৷ এদিক থেকে দেখতে গেলে আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের চিন্তাচেতনা-সম্ভূত যে ‘একাত্ম মানবতাবাদ’-এর ধারা গ্রহণ করেছে, তারও পূর্বসূত্র আমরা বিপিনচন্দ্র পালের দর্শনের মধ্যে দেখতে পাই।
আমরা দেখি তাঁর আত্মজীবনীর মধ্যে একটি সুস্পষ্ট শিক্ষা-দর্শন লুকিয়ে আছে। সেখানে নানান প্রাসঙ্গিক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জড়জগতের সঙ্গে মানবজীবনের পারস্পরিক মিথোষ্ক্রিয়তার কথা উপলব্ধি করাচ্ছেন। “এই সৃষ্টিতে জড় ও চেতন যাহা কিছু ছিল ও যাহা কিছু আছে, সকলের সঙ্গেই সদ্যজাত মানব শিশুর জীবন জড়াইয়া রহিয়াছে। আলো ও অন্ধকার, রৌদ্র এবং বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, দাবানল ও ভূকম্পন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, পর্বত ও সমুদ্রের সৃষ্টি, সাগরের তরঙ্গ ও নদীর স্রোত, বিশাল বনস্পতির সমাচ্ছন্ন নিবির্ অরণ্যানী, প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় জীবজন্তুসকল, কীট, পতঙ্গ, পুষ্পলতা সকলে মিলিয়া সৃষ্টির আদি হইতে এই ক্ষুদ্র মানব শিশুর জীবনকে গড়িয়া পিটিয়া তুলিয়াছে।” অতএব আমরা প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
আধুনিক বিজ্ঞান-ভাবনা তাঁর মধ্যে বিশেষভাবে ছড়িয়ে ছিল তা বুঝতে সক্ষম হই, যখন দেখি তিনি লিখছেন, “এই বিশ্বের প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যে সমগ্র সৃষ্টির ইতিহাসটি লুকাইয়া আছে। জড়-বিজ্ঞান সেই গোপন লিপিরই উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিতেছে। বিশ্বের প্রত্যেক জীবকোষাণুর মধ্যে সৃষ্টির সমগ্র প্রাণীজগতের ইতিহাস অঙ্কিত রহিয়াছে। জীব-বিজ্ঞান তাহারই আলোচনা করিয়া জীবের প্রকৃতি ও অভিব্যক্তির তথ্য বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছে।”
তথ্যসূত্র
১. সত্তর বৎসর ।। আত্মজীবনী।। বিপিনচন্দ্র পাল (পুস্তকাকারে প্রকাশ ১৯৬২), যুগযাত্রী প্রকাশক লিমিটেড, কলকাতা।
২. বিপিনচন্দ্র পাল : জীবন, সাহিত্য ও সাধনা, ড. শিবদাস চক্রবর্তী, ১৯৬০, চলন্তিকা প্রকাশক, কলকাতা।
৩. ভারত ইতিহাস পরিক্রমা, প্রভাতাংশু মাইতি ও অসিত কুমার মণ্ডল।
৪. ভারতের জাতীয় আন্দোলন, অনাদিকুমার মহাপাত্র