অমিত শাহের ‘কংগ্রেসমুক্ত উত্তর-পূর্ব ভারত’ গড়ার স্লোগান বাস্তব হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ক্ষমতায় থাকা শেষ রাজ্য মিজ়োরামে বিধানসভা ভোটে হেরেছিল কংগ্রেস। মঙ্গলবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেই রাজ্য আবার বিধানসভা ভোটের মুখোমুখি। পড়শি রাজ্য মণিপুরে ধারাবাহিক হিংসার আবহে মিজ়োরামবাসী রায় দেবেন উত্তর-পূর্বাঞ্চল কংগ্রেস মুক্তই থাকবে? না কি বদলে যাবে পরিস্থিতি?
নির্বাচনী ইতিহাস বলছে, প্রতি দশকে মিজ়োরামে সরকার পাল্টায়। সেই ধারা মেনেই ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সরকার পাল্টে দিয়েছিলেন মিজ়োরা। ক্ষমতায় এসেছিল এমএনএফ। অর্থাৎ, ভোটের ধারা মেনে এ বারও তাদের ক্ষমতায় থাকার কথা। ২০১৮-র ওই ভোটে এমএনএফ মিজ়োরামের ৪০টি আসনের মধ্যে জিতেছিল ২৭টিতে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস মাত্র ৪টি আসনে জিতে তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছিল। একদা ইন্দিরা গান্ধীর দেহরক্ষী দলের নেতা, প্রাক্তন আইপিএস লালডুহোমার সদ্যগঠিত জেডপিএম জিতেছিল আটটি আসনে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে ‘দল’ হিসাবে তখনও স্বীকৃতি না পাওয়ায় জেডপিএম প্রার্থীরা ‘নির্দল প্রার্থী’ হয়ে লড়েছিলেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে নিজের লালডুহোমা তাঁর দল জ়োরাম ন্যাশনালিস্ট পার্টি-সহ মোট সাতটি দলকে নিয়ে নয়া মঞ্চ জেপিএম গড়েছিলেন। আটটি আসনে জিতে বিধানসভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হয়েছিলেন। জয়ী এমএনএফ ২৬ এবং এক দশক ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস পাঁচটি আসনে জিতেছিল। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের লালথানহাওলাকে সেরচিপ আসনে পরাস্ত করেন লালডুহোমা। এর পর ‘রাজনৈতিক দল’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে জেডপিএম, তার সভাপতি হন লালডুহোমা। নয়া দলের পদ নেওয়ায় দলত্যাগবিরোধী আইনে বিধায়ক পদ হারালেও উপনির্বাচনে ফের সেরচিপে জয়ী হন। সম্প্রতি রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরসভা লুংলেইয়ের ভোটে ১১টি আসনের সব ক’টিতেই জয়ী হয়েছেন জেডপিএম প্রার্থীরা। এই পরিস্থিতিতে এ বারের মিজ়োরামের ভোটে তারা চমক দেখাতে পারে বলে ভোটপণ্ডিতদের অনেকে মনে করছেন।
৪০টি আসনের মিজ়োরাম বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ২১। যুযুধান প্রধান তিন দল শাসক মিজ়ো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ), প্রধান বিরোধী জ়োরাম পিপলস্ মুভমেন্ট (জেডপিএম) এবং প্রাক্তন শাসক দল কংগ্রেস সব আসনেই প্রার্থী দিয়েছে। বিজেপি লড়ছে ২৩টিতে। সব মিলিয়ে ১,২৭৬টি বুথে ১৭৪ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করবেন সে রাজ্যের প্রায় ৮ লক্ষ ৫২ হাজার ভোটদাতা। গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন এমএনএফ প্রধান তথা মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা (আইজল পূর্ব-১), উপমুখ্যমন্ত্রী তাওনলুইয়া (তুইচাং), বিরোধী দলনেতা লালডুহোমা (সেরচিপ), প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি লালসাওতা (আইজ়ল পশ্চিম-২)।
শাসকদল এমএনএফ ২০১৬ সাল থেকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ‘নর্থ ইস্ট ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ (নেডা)-র এর সদস্য হলেও মণিপুরের সাম্প্রতিক গোষ্ঠী হিংসার জেরে পদ্ম-বিরোধী সুর চড়িয়েছে। এমনকি, এমএনএফ প্রধান তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘‘আগামী লোকসভা ভোটের পর নরেন্দ্র মোদী আর দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না।’’ জাতিগত ভাবে মণিপুরের কুকি-জ়ো জনজাতিরা বৃহত্তর মিজ়ো সমাজের অন্তর্ভুক্ত। দুই জনগোষ্ঠীই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। মে মাসের গোড়া থেকে শুরু হওয়া মণিপুর হিংসার জেরে প্রায় ১৩ হাজার কুকি-জ়ো মিজ়োরামে আশ্রয় নিয়েছেন। ফলে এ বারের ভোটের প্রচারে আগাগোড়া বড় ভূমিকা নিয়েছে মণিপুর হিংসার প্রসঙ্গ।
মিজ়ো রাজনীতিতে প্রবল প্রভাবশালী চার্চ এবং অরাজনৈতিক ছাত্র-যুব সংগঠন ‘মিজ়ো জিরালাই পাওল’ (এমজেডপি) মণিপুরের বিজেপি সরকারের তুমুল সমালোচনা করলেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে ‘নেডা’র শরিক এমএনএফ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি। যদিও দুই বিরোধী দল জে়ডপিএম এবং কংগ্রেসের প্রচারে জোরাল ভাবে উঠে এসেছে জোরামথাঙ্গার ‘বিজেপি-সখ্যের’ প্রসঙ্গ। রাজীব গান্ধী থেকে মনমোহন সিংহের জমানা পর্যন্ত পাঁচ দফায় প্রায় ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো প্রবীণ নেতা লাল থানহাওলাকে এ বারের ভোটে প্রার্থী করেনি কংগ্রেস। ভোটে তার প্রভাব পড়তে পারে বলে দলের একটি অংশের আশঙ্কা।
বিজেপির তরফে এ বারের ভোটে ‘উত্তর-পূর্বের উন্নয়ন’ আর মাদক কারবার দমনের প্রসঙ্গ বার বার তোলা হলেও তা ভোটের প্রচারে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। সব মিলিয়ে পদ্ম-শিবিরের ‘লড়াই’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা অধ্যুষিত গোটা চারেক আসনেই সীমাবদ্ধ। যদিও মিজ়োরামে বিজেপির একমাত্র বিধায়ক বুদ্ধধন চাকমা ইতিমধ্যেই সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তবে কেন্দ্রে যে দলের সরকার, সেই দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষার ব্যাপারে উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ রাজ্যেরই প্রবণতা রয়েছে। মিজ়োরাম এ বার তার ব্যতিক্রম হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
বাস্তবের সঙ্গে জনমত সমীক্ষা বা বুথফেরত সমীক্ষা মেলে না অনেক সময়েই। তবে মেলার উদাহরণও কম নয়। কয়েকটি জনমত সমীক্ষা বলছে, ৪০ আসনের বিধানসভায় এমএনএফ এবং কংগ্রেস কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ২১ ছুঁতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে আট থেকে ১২টি আসন পেয়ে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারে লালডুহোমার দল। এবিপি-সি ভোটার সর্বশেষ জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাস, এমএনএফ ১৭-২১, কংগ্রেস ৬-১০, জে়ডপিএম ১০-১৪ এবং নির্দল, বিজেপি ও অন্যেরা মিলে ০ থেকে ২টি বিধানসভা আসনে জিততে পারে। ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতিতে একদা কংগ্রেস নেতা এবং পরবর্তীকালে বিজেপির সহযোগী লালডুহোমা কী করবেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছে মিজোরামে।