তাঁদের ইতিহাসটুকু অন্তত ভুলে গেলে আমাদের রক্তের অপমান, মাটির অপমান, ধর্মের অপমান

প্রচুর গালিগালাজ শুনেছি বছর চারেক আগে। হামাসের দ্বারা এই মৃতদেহ ধর্ষ*ণের ঘটনাটা না সামনে এলে হয়ত আর সাহস করে লিখতাম না।

সময়কাল ধরে জৌহরের ঘটনাগুলি লিখব একের পর এক। রাজপুতানা শুধু না, মধ্যপ্রদেশেও হয়েছে জৌহর। “দয়ালু” রাজা আকবরের আক্রমণের কারণেও হয়েছে। ঔরঙ্গজেবের সময়ে অন্তত তিনটি জৌহর হয়েছে, এবং তার মধ্যে একটি অসম্পূর্ণ থাকাকালে মুঘল সেনা দুর্গমধ্যে ঢুকে পড়ে মহিলাদের গবাদি পশুর মত বেঁধে নিয়ে গেছে দাসীবাজারে বেচার জন্য।

যে বা যারা বলেন, জৌহর করার জন্য পুরুষরা বাধ্য করত মহিলাদের, তাদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি মাত্র ঐতিহাসিক তথ্য রইল।

জৌহর তখনই হত যখন আর লড়ার কোন উপায় নেই। অর্থাৎ দুর্গমধ্যে জল এবং খাদ্য ফুরিয়েছে এবং অবরোধ ভাঙা সম্ভব না।

জৌহরের জন্য রানী বা রাজমাতার সম্মতির প্রয়োজন হত। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে, সভাসুদ্ধ লোকের সামনে তাঁকে স্বীকার করতে হত যে মহিলারা জৌহর করতে প্রস্তুত আছেন। কেউ না চাইলে তাঁদের ওপর জোরজবরদস্তি না করে যেতে দেওয়া হত। প্রথম জৌহরের সময় দুই রাজকন্যা সহ বেশ কিছু মহিলা জৌহর করতে অস্বীকার করেন। তাঁদের কী দশা হয়, সে অন্য গল্প। কিন্তু জোরজবরদস্তি করার নিয়ম ছিল না।

জৌহর কখনোই আলাদাভাবে হত না। জৌহর এবং সাকা হত একত্রে। যে রাতে জৌহর হবে, পরের দিন সকালে কপালে সেই ভস্ম মেখে, মাথায় ত্যাগের প্রতীক গেরুয়া পাগড়ি বেঁধে দুর্গের পুরুষরা বেরোবে মৃত্যু-যুদ্ধে। সাকার যুদ্ধে প্রাণরক্ষা মহাপাপ বলে গণ্য হত। অর্থাৎ মৃত্যু যখন নিশ্চিত, নারী এবং পুরুষ একত্রে সে মৃত্যু বরণ করত। তফাত এইটুকু যে নারীদেহটুকু দাহ করা হত মৃতদেহ ধর্ষ*ণের আশংকায়। পুরুষরা সম্মুখ-যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করত।

পূজারী ব্রাহ্মণরা সাধারণত নদী বা তালাওতে দেবপ্রতিমা/ শিবলিঙ্গ সহ সলিল-সমাধি নিতেন। খননের ফলে নদীগর্ভে বা জমিতে একের পর এক মূর্তি আবিষ্কার এরই সাক্ষ্য দেয়। পলায়ন সম্ভব হলে পালাতেনও। বৃন্দাবনের শ্রীজীর ছাব্বিশটি পাদচৌকি আছে বৃন্দাবন থেকে রাজস্থানের মধ্যে। অর্থাৎ তাঁকে নিয়ে যখন পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অন্তত ছাব্বিশটি জায়গায় গুপ্তভাবে রেখে তাঁর পূজা হয়েছে। কোথাও কোথাও একের বেশি বারও হয়েছে।

আমাদের ইতিহাসের একটা বড় অংশ প্রতিরোধের ইতিহাস। নারী-পুরুষ-শিশু, যে যেভাবে পেরেছে সেই প্রতিরোধে অংশ নিয়েছে। নালন্দা যখন জ্বালানো হয়, বা পরেও যখন ধর্মগ্রন্থ-পাঠ নিষিদ্ধ হয়েছে, এক বা একাধিক বেদ, অন্যান্য জ্ঞান-আকর অবধি ব্রাহ্মণরা, ভান্তেরা শুধু মুখস্থ করে পরবর্তী প্রজন্মে দিয়ে গেছেন, যাতে তা হারিয়ে না যায়।

তাঁদের ইতিহাসটুকু অন্তত ভুলে গেলে আমাদের রক্তের অপমান। মাটির অপমান। ধর্মের অপমান।

লেখা থাক অন্তত। কখনো যদি কেউ পড়ে।

Debasree Mitra

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.