ভারতের জাতীয় পতাকার পরিকল্পনা করতে দেখা যায় ভগিনী নিবেদিতাকে। তাতে বজ্রচিহ্ন আঁকা, অভ্যন্তরে ‘বন্দেমাতরম’ কথাটি লেখা। প্রকৃতপক্ষে আত্মত্যাগ না হলে দেশ, জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। নিবেদিতার আঁকা বজ্রচিহ্ন ভারতবর্ষের দধীচি মুনির মহান আত্মত্যাগকে স্মরণ করিয়ে দেয়৷ কারণ তারই হাড় দিয়ে তৈরি হয়েছিল ভয়ঙ্কর অস্ত্র ‘বজ্র’। দেবাতারা এই বজ্র দিয়েই বধ করেছিলেন বৃত্রাসুরকে। আপন দেহত্যাগ এবং মরদেহ নির্মিত অস্ত্রে শত্রু পরাজিত হল।
অসংখ্য দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা-সংগ্রামীর বলিদানে ভারতবর্ষ আজ স্বাধীন হয়েছে। যেকোনো সেবায় আপনার যথাসর্বস্ব ত্যাগ ব্যতিরেকে তার কল্যাণ-যজ্ঞ সম্পন্ন হয় না। যুগে যুগে অসীম ত্যাগে অসংখ্য মানুষ ও মনীষী ভারতবর্ষকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। ত্যাগই ভারতভূমির মূল আদর্শ।
নিবেদিতা ভারতের পতাকায় ত্যাগের প্রতীক-চিহ্নরূপে দধীচি মুনির বজ্রের ছবি রাখতে চেয়েছিলেন। এই মনোবাসনার কথা তিনি ১৯০৪ সালে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ চন্দ্র বসু, তার স্ত্রী অবলা বসু এবং সিস্টার ক্রিস্টিনকে। তারা সমবেতভাবে তখন বুদ্ধগয়া পরিভ্রমণ করছেন। সেখানে অবস্থানের দিনগুলিতে রোজ সন্ধ্যাবেলায় বোধিবৃক্ষ-তলে ধ্যান করতেন নিবেদিতা। বৃক্ষের অনতিদূরে ছিল একটি গোল পাথর, তাতে বজ্র-খোদাই করা। এই চিহ্ন দেখিয়েই তিনি সহযাত্রীদের বলেছিলেন, ভারতের জাতীয় চিহ্ন হিসাবে বজ্রকে গ্রহণ করলে ভালো হবে। ভারতের রাজনৈতিক নেতারা অবশ্য তাঁর মত গ্রহণ করেন নি, ‘বন্দেমাতরম’ কথাটিকেও অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে উল্লেখ করেছেন।
নিবেদিতার ঐকান্তিক ইচ্ছাকে মান্যতা দিয়েছিলেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। আচার্য প্রতিষ্ঠিত ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’, যা গড়ে তোলার পিছনে বহুলাংশে অবদান ছিল ভগিনীর; তাঁরই স্মৃতিতে গবেষণা কেন্দ্রের মাথায় নিবেদিতা পরিকল্পিত বজ্র-চিহ্ন বসিয়ে দিলেন তিনি। দধীচি মুনির জয়ধ্বনি ঘোষিত হল।
নিবেদিতার আঁকা বজ্রচিহ্নে অবশ্যই পাশ্চাত্য শিল্প রীতির প্রভাব থাকবে, তার কারণ নিবেদিতা আবাল্য পাশ্চাত্য সংস্কারে নির্মিত। কিন্তু তাঁর অন্তরে যে ভারতীয়ত্বের প্রবাহ অনুক্ষণ বয়ে যেত, তাতে নির্মিত হল অঙ্কনের রিকনস্ট্রাকশন। কোনো ভারতবাসী তাতে আপত্তি করতে আসেন নি। যেমন করে খোকার প্রতি আদরে ছোট্ট শিশু মায়ের কোলে একটি পাখি হয়ে যায়, তাতে কোনো প্রাণীতত্ত্ববিদ আপত্তি করতে আসেন না! আমাদের মতে, হিন্দু শিল্প-সুষমায় পাশ্চাত্য প্রভাব এমনতর হওয়া বাঞ্ছনীয়, অথচ তার পরতে পরতে জাতীয়তাবাদের ছোঁয়া।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং ডা. সন্দীপন নন্দন ঘোষ