Durga Puja 2023: মহালয়ার ৫ দিন আগেই বোধন, পুরুলিয়ার পঞ্চকোট রাজবাড়িতে ঢাকে কাঠি

মায়ের মন্ত্র গুপ্ত। গুপ্ত মায়ের আসনও। পুজোপাঠের মন্ত্র এতটাই গোপনীয়
যে মন্ত্রের লিপি আজও অপ্রকাশিত। এমনকি কোথাও কোনও কাগজ, খাতা, ডায়েরিতেও লিপিবদ্ধ হয়নি। দু’হাজারেরও বেশি বছর পরেও গাছের ছালে সংস্কৃত ও পালি ভাষায় ন’টি পাতায় ন’টি লাইন লেখা। সেই গুপ্তাতিগুপ্ত ‘শ্রীনাদ’ মন্ত্র উচ্চারণ, আগমনী গান, বলি ও আরতির মাধ্যমে পঞ্চকোট রাজপরিবারে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজো। মহালয়ার পাঁচদিন আগেই বোধন। পুজোর (Durga Puja 2023) ঢাকে কাঠি।

Panchokot

তন্ত্র বিরাচার মতে, গোপন মন্ত্রে মা শিখরবাসিনী দুর্গা পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারের ঠাকুরদালানে পুজো পান। জিতাষ্টমীর পরের দিন আদরা নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের নবমীর দিন পঞ্চকোটের কাশীপুরের দেবী বাড়িতে শুরু হয় পুজো। এই দেবী বাড়িই রাজপরিবারের কূলদেবীমাতা রাজরাজেশ্বরীর আলয়।মা শিখরবাসিনী দুর্গা এখানে অষ্টধাতুর তৈরি। চতুর্ভুজা। একহাতে জপমালা, আর এক হাতে বেদ। আর দুই হাতে বরদা ও অভয়া। গলায় নরমুন্ডু মালা। পদ্মফুলের উপর বসে থাকা রাজরাজেশ্বরী মূর্তির দুর্গা ১৬ দিন ধরে পূজা পান।

Panchokot

অর্থাৎ রবিবার আদ্রা নক্ষত্র যুক্ত কৃষ্ণ পক্ষের নবমী থেকে এই পুজো চলবে মহানবমী পর্যন্ত। ১৬ দিনের এই পুজো ষোলকল্পের দুর্গাপুজো নামে পরিচিত। এই রাজপরিবারে বর্তমানে অশৌচ চলায় তাঁরা ঠাকুরদালানে পা রাখেননি ঠিকই। কিন্তু দেবীবাড়ির চৌহদ্দিতে ছিলেন তাঁরা। বাইরে থেকেই আয়োজন করেন পুজোর। পঞ্চকোট রাজপরিবারের সদস্য তথা সিপাহী বিদ্রোহের মূল উদ্যোক্তা মহারাজাধিরাজ নীলমণি সিং দেওর প্রপৌত্র সৌমেশ্বরলাল সিং দেওর সঙ্গে। তাঁর কথায়, “নিত্যপুজোতে মা অধিষ্ঠান করেন তাঁর ঐতিহ্যশালী বেদিতে। মার্বেল পাথরের একটি বড় সিংহাসনের উপরে একটি রুপোর সিংহাসনের মাঝে সোনার সিংহাসনের মাথায়। আর মহাসপ্তমীর দিন অর্ধরাত্রি বিহীত পুজোর পর্বে দশমীর পূর্বাহ্ন পর্যন্ত মাকে গুপ্ত আসনে বসানো হয়। অষ্টাদশভূজা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে আমরা মায়ের চরণে অঞ্জলি দিই।” মায়ের গুপ্ত আসনকে বলা হয় সোড়ন। এই সময় একটি তরোয়ালও পূজা পায়। যার নাম ‘ভূতনাথ তাগা’।

এই পুজোর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। নানা পৌরাণিক আখ্যান। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীর ধার নগরের মহারাজা বিক্রমাদিত্যের বংশধর জগদ্দেও সিং দেওর কনিষ্ঠ পুত্র দামোদর শেখর সিং দেও বাহাদুর চাকলা পঞ্চকোটরাজের প্রতিষ্ঠাতা। এই রাজস্থাপনের সময় থেকেই তার পূর্বপুরুষ কুলপ্রথা অনুযায়ী শকাব্দ ২ থেকে এই পুজো শুরু হয়। রাবণবধ করার জন্য শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাদেবীর আরাধনার সূচনার্থে যে ‘বোধন’ করেছিলেন। যা ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত। সেই মত অনুসারেই ধারনগরের প্রথা এবং কুলাচারকে মেনে মহারাজা দামোদরশেখর সিং দেও বাহাদুর এই জঙ্গলমহলে দুর্গা পুজো শুরু করেন। দামোদর শেখরের নামানুসারে এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলের ‘শেখরভূম’ বা ‘শিখরভূম’ নামকরণ হয়। তাই এই দুর্গার নামও হয় শিখরবাসিনী দুর্গা।

Temple

বর্তমানে পঞ্চকোট রাজ দেবোত্তরের সেবাইত বিশ্বজিৎপ্রসাদ সিং দেওর তত্ত্বাবধানে পুজো হয়। এই রাজবংশের রাজধানী গড়পঞ্চকোট থেকে শুরু করে পাড়া, কেশরগড়, কাশীপুর যেখানে রাজত্ব স্থানান্তরিত হয়েছে সেখানেই এই পুজো চলছে ধুমধাম সহকারে। যে বনমালী পণ্ডিতের হাত ধরে এই পুজো হয় তাদের এই বংশধর বর্তমানে গৌতম চক্রবর্তী এই পুজো করে থাকেন। তাঁর কথায়, “৮০তম পুরুষ ধরে এই গুপ্ত মন্ত্রে মায়ের পুজোপাঠ চলছে। যে ভূর্জ পত্র বা গাছের ছালে এই মন্ত্র লেখা রয়েছে তার অবস্থা এতটাই করুণ যে হাত দিলেই ঝুরঝুর করে পড়তে শুরু করে। ওই ভূর্জ পত্র বিশেষ দিনে নিয়ে এসে মায়ের চরণে রেখে দিই।
ওই গুপ্ত মন্ত্র আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। তাই আর চোখে দেখতে হয় না।”

রাজপরিবারের সদস্যরা বলেন, রাজরাজেশ্বরী দেবীই হলেন কল্যাণেশ্বরী দেবীর প্রতিমূর্তি। যিনি মাইথনের কাছে সবনপুরে প্রতিষ্ঠিত। এই মা ভূজ্যপত্রে (গাছের ছাল) বা খত (চিঠি)-তে অঙ্গীকার করেন, “আমার প্রতিমূর্তি রাজরাজেশ্বরীর মন্দিরে যতদিন যাবৎ দুর্গাপুজো হবে আমি সেখানে মহাষ্টমীর দিন সন্ধিক্ষণে বিশেষরূপে অধিষ্ঠিত হব। এবং প্রমাণস্বরূপ দেবী দুর্গার যন্ত্রে সিঁদুরের উপর পায়ের ছাপ ফেলে আসব।” তাই
মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে এই শিখরভূমে মা দুর্গার পায়ের ছাপ দেখা যায়। তাই তো কথিত আছে, “মল্লেরা শিখরে পা / সাক্ষাৎ দেখবি তো শান্তিপুরে যা….।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.