অক্টোবর ৩, ১৯৭৮ | আজ থেকে ঠিক ৪৫ বছর আগের কথা । জন্ম নিল দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল । ভারত তথা এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় নলজাতক সন্তান। যার জনক এক বঙ্গ সন্তান । প্রথম নলজাতক লুইস ব্রাউন অবশ্য মাত্র ৬৭ দিন আগে জন্ম নিয়েছে ইংল্যান্ডে । সেখানকার আধুনিক সরঞ্জামের বিপরীতে কলকাতায় এক সাধারণ রেফ্রিজারেটর , অপরিসর গবেষণাগার | সম্পূর্ণ গবেষণাপত্র পাঠিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক হরমোন স্টেরয়েড কংগ্রেস (নতুন দিল্লী) ও ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ক্রায়োজেনিক্সের দরবারে । তখন তোলপাড় পড়ে গেল চিকিৎসা মহলে | ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার প্রথম টেস্ট টিউব বেবি বা আই ভি এফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) এর জনক ছিলেন এই ডাক্তারবাবু । কিন্তু তারপর কি হয়েছিল এই ডাক্তারবাবুর সাথে ?
১৯ জুন, ১৯৮১ | ঠিক ৪১ বছর আগের কথা | স্কুল থেকে ফিরছিলেন শিক্ষিকা নমিতা মুখোপাধ্যায় | কলকাতার দক্ষিণ অ্যাভিনিউয়ে ছয় তলার এক ফ্লাটে ডাক্তার স্বামীর সাথে থাকতেন তিনি | কিন্তু ফ্ল্যাটের দরজা খোলার পর যা দেখলেন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না নমিতাদেবী | সিলিং থেকে ঝুলছে গলায় ফাঁস দেওয়া স্বামীর ঝুলন্ত লাশ | সঙ্গে পেলেন একটি সুইসাইড নোট | তাতে লেখা “হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর জন্য আর অপেক্ষা করতে পারলাম না”।
কে ছিলেন এই ডাক্তারবাবু ?
ঠিক ৪৫ বছর আগে বাংলার মাটিতে ঘটেছিল এক নিঃশব্দ বিপ্লব ! সেই বিপ্লবের মূল কান্ডারি ছিলেন সেই ডাক্তারবাবু | নাম ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায় | ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার প্রথম টেস্ট টিউব বেবি বা আই ভি এফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) এর জনক তিনি | জন্ম ১৯৩১ সালের ১৬ই জানুয়ারী বিহারের হাজারিবাগে | ছাত্রজীবন কেটেছিল প্রথমে স্কটিশ চার্চ কলেজে । পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে । ওই বছরেই শারীরবিদ্যা বিষয়ে সান্মানিক স্নাতক হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন প্রজনন শারীরবিদ্যা (অর্থাৎ রিপ্রোডাকটিভ ফিজিওলজি) বিষয়ে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে । এরপর এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিউটিনাইজিং হরমোন পরিমাপের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে দ্বিতীয়বার পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে । এরপর কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি |
সারাবিশ্বের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে তখন নলজাতক নিয়ে গবেষণা চলছে জোরকদমে । ডাঃ মুখোপাধ্যায়ের কাছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বা আদর্শ পরীক্ষাগার কিছুই ছিল না | শুধু ছিল মেধা ও নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্যে অদম্য জেদ | পাশে পেলেন ক্রায়োবায়োলজিস্ট ডাঃ সুনিত মুখার্জী এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সরোজ কান্তি ভট্টাচার্যকে | ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬— দীর্ঘ ন’বছর ধরে তিল তিল করে এন আর এসেই গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন সুভাষবাবু । সর্বক্ষণ সেখানে যুগান্তকারী আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন | বন্ধুসূত্রে পরিচয় হল বনেদি মাড়োয়ারি পরিবারের আগরওয়াল দম্পতির সঙ্গে | বিবাহের বারো বছর পরেও তারা ছিলেন নিঃসন্তান | কিছু দিন চিকিৎসার পরেও অবশ্য বেলাদেবী গর্ভবতী হতে পারেননি। পরীক্ষা করে সুভাষবাবু দেখেছিলেন, বেলাদেবীর দু’টি ফ্যালোপিয়ান টিউবই অবরুদ্ধ। তখনই নিজের নতুন গবেষণা ‘টেস্ট টিউব বেবি’র পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ওই দম্পতির উপরে করতে চেয়েছিলেন তিনি |
অক্টোবর ৩, ১৯৭৮ | দুর্গাপুজোর ঠিক আগে সাফল্য পেলেন ডাঃ মুখোপাধ্যায় । জন্ম নিল দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল । ভারত তথা এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় নলজাতক সন্তান। তখন তোলপাড় পড়ে গেল চিকিৎসা মহলে |
কিন্তু এরপরেই শুরু হল ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উপর লাঞ্ছনা | নিজের কাজের বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি পাননি তিনি | কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সমাজেও একপ্রকার একঘরে করে দেওয়া হল তাঁকে | ২০১০ সালে রবার্ট এডওয়ার্ডস তার আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেলেও আবিষ্কারের পর নিজের দেশেই অবহেলা আর অপমানের মুখোমুখি হতে হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উপর অভিযোগ ছিল গুরুতর – তিনি দপ্তরের আমলাদের না জানিয়ে কেন মিডিয়াকে তার গবেষনার বিষয় জানিয়েছেন | তিনি কি করে তার ছোটো গবেষণাগারে সামান্য উপকরণ নিয়ে এই কাজ করেছেন, যেখানে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়েও অন্যেরা পারছে না | পশ্চিমবঙ্গে তখন বামফ্রন্ট সরকার | ১৯৭৮ সালের ১৮ই নভেম্বর সরকার মেডিক্যাল এস্যোসিয়েশনের অধীনে একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে | এর শীর্ষে ছিল Radio physicist এবং সদস্যদের মধ্যে ছিল একজন গাইনোকোলজিস্ট, একজন সাইকোলজিস্ট, একজন ফিজিসিস্ট এবং একজন নিউরোলজিস্ট | এই সদস্যদের আধুনিক রিপ্রডাক্টিভ টেকনোলজি সমন্ধে কোনও ধারণা ছিল না | বিশেষঞ্জ কমিটি ডাঃ মুখার্জীকে অনেক অবান্তর প্রশ্ন করে কার্যত অপমান ও হেনস্থা করে | শেষ পর্যন্ত কমিটি রায় দেয় যে “Everything that Dr. Mukhopadhyay claims is bogus.” |
জাপানের আন্তর্জাতিক এক সন্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার ডাক এলেও সরকারের বাধায় যেতে পারলেন না ডাঃ মুখার্জী | কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাঁর পাসপোর্ট । যাতে তিনি গবেষণা চালাতে না পারেন তাই তাঁকে বদলি করা হল বাঁকুড়া সন্মিলনী মেডিকেল কলেজে । সুভাষবাবুর বহু অনুরোধ সত্ত্বেও তৎকালীন স্বাস্থ্যকর্তারা সেই নির্দেশ রদ করেননি। অগত্যা বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিলেও সপ্তাহান্তে কলকাতার বাড়িতে ফিরে হাসপাতালের ছোট পরীক্ষাগারেই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন সুভাষবাবু | বাঁকুড়ায় থাকাকালীন হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন তিনি | এরপর কলকাতা আর জি কর মেডিকেল কলেজে ফিরিয়ে আনা হল তাঁকে | তবে তাঁকে সবচেয়ে বড় অপমান করা হয় তার আত্মহত্যার মাত্র কিছুদিন আগে। ১৯৮১ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাকে বদলি করা হয় চক্ষু বিষয়ক এক ইনস্টিটিউটে, ইলেক্ট্রো-ফিজিওলজির প্রফেসর হিসেবে। অথচ তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি কিংবা গবেষণা দুটোই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে। আর এই অপমানের ভার বইতে না পেরেই ১৯ জুন আত্মহত্যা করেন প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী | ১৯৮১ এর ১৯শে জুন সহধর্মিণী নমিতা মুখোপাধ্যায় কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরে দেখলেন সব গবেষণাকে ছুটি দিয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তাঁর জীবনসঙ্গী । এই ঘটনার পর নমিতাদেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বাকি জীবন শয্যাশায়ী হয়ে কাটান ।
শেষের গল্পটা একটু ভিন্ন।১৯৮৬ সালের ১৬ আগস্ট ভারতেরই আরেক বিজ্ঞানী টি. সি. আনন্দ কুমারের গবেষণার ফলে জন্ম নেয় আরেক টেস্ট টিউব শিশু হর্ষবর্ধন রেডি। ভারত সরকার আনন্দ কুমারকেই ভারতের প্রথম টেস্টটিউব শিশু নিয়ে সফলতার স্বীকৃতি হয়। তবে সবকিছু পাল্টে যায় ১৯৯৭ সালে, যখন আনন্দ কুমার কলকাতায় যান এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে। কলকাতায় আনন্দ কুমারের হাতে আসে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাজের বিভিন্ন ডকুমেন্ট। সেই ডকুমেন্টগুলো দেখে আর দুর্গার পরিবারের সাথে কথা বলে আনন্দ কুমার বুঝতে পারেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই ভারতে টেস্ট টিউব শিশু নিয়ে গবেষণার প্রথম সফল ব্যক্তি। দীর্ঘদিনের অবহেলা আর অপমানের পর আলোর মুখ দেখার সম্ভাবনা পায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা। আনন্দ কুমারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশুর গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আনন্দ কুমারের ভাষায়, “ডক্টর সুভাষকে অবশ্যই ভারতে প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশু আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিতে হবে। তার আবিষ্কারের তুলনায় অন্যগুলো একেবারেই ছোট।” আনন্দ কুমার ১৯৭৮ সালে গঠিত সেই তদন্ত কমিটির কড়া সমালোচনা করেছেন তার লেখায়। আনন্দ কুমারের বলেন এই চার সদস্যের তদন্ত কমিটির কারোরই আধুনিক প্রজননবিদ্যা বিষয়ক গবেষণা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না, যার ফল ভোগ করতে হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।
বর্তমান কালে কলকাতায় গড়ে উঠেছে ‘ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় মেমোরিয়াল রিপ্রোডাকটিভ বায়োলজি রিসার্চ সেন্টার’ । মৃত্যুর ৪০ বছর পর তাঁর কর্মক্ষেত্র নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের নামকরণ হয়েছে মহান এই বিজ্ঞানীর নামে , আবক্ষ মূর্তি বসেছে সেখানে । যে ঘরে তিনি গবেষণারত থাকতেন তার বাইরে লাগানো হয়েছে স্মৃতিফলক । এছাড়াও তাঁর মূর্তি স্থাপন হয়েছে সুদূর হাজারিবাগ শহরে । আজও ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দেখানো পথেই মা বাবা ডাক শুনতে পান বহু দম্পতি | কিন্তু এমন এক মানুষকে কত কষ্ট নিয়ে চলে যেতে হয়েছে, তা হয়ত আমাদের কল্পনার বাইরে |
২০১০ সালে সারা পৃথিবীর ১০০ টি দেশের ১১০০ জন চিকিৎসাবিজ্ঞানীর আবিষ্কার লিপিবদ্ধ করে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য ডিকশনারি অফ মেডিকেল বায়োগ্রাফি’ । সেই বইতে দুইজন বাঙালি চিকিৎসাবিজ্ঞানীর আবিষ্কারও স্থান পায় | তারা হলেন ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী , ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায় ।
ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য |