প্রেসিডেন্সি কলেজ | সরস্বতী পুজো | সকাল সকাল অঞ্জলি দিতে উপস্থিত হলেন এক ছাত্র | কিন্তু পুজোমণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়ায় তার উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্ররা। ব্যাপারটা এ রকম যে, তুমি যতই মেধাবৃত্তি পাও, আসলে তো ছোট জাত। তাই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারো না। এই ঘটনা অবশ্য তার সাথে নতুন কিছু নয় | নিচু জাতের বলে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে তার সাথে একসাথে কেউ খেতেও বসতেন না | এই ঘটনাই জাতিভেদের বিরূদ্ধে আজীবন লড়াই করার বারুদ ভরে দিয়েছিল ছাত্রটির মনে |

মেঘনাদ সাহা | ঢাকা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরের শেওড়াতলি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১০ কিলোমিটার দূরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। যাওয়া-আসার দুস্তর সমস্যা। তাই বিদ্যালয়ের কাছাকাছি বসবাসকারী ডাক্তার অনন্ত দাসের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বাড়ির গোয়ালঘর দেখাশোনা, বাসন মাজার মতো কাজ তাকে করতে হত। তবেই জুটত খাবার, মাথা গোঁজার ঠাঁই। যদিও কাজগুলো মনের আনন্দেই করতেন তিনি। কারণ, তার বদলে মিলত পড়াশোনার সুযোগ। কিন্তু অনন্ত দাসের বাড়িতে ছিল জাতপাত নিয়ে চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি। সে ‘নিচু জাত’-এর ছেলে। তাই বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ। নির্দেশ ছিল, নিজের বাসনপত্র গ্রামের পুকুর থেকে নিজেকেই ধুয়ে মেজে আনতে হবে। বাড়ির বাসনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললেই কেলেঙ্কারি। কৈশোরের অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি বুঝেছিলেন, জাতিভেদ, অসাম্য আসলে সমাজের এক গভীর অসুখ।

সালটা ১৯১৯ । তিনি বুঝেছিলেন প্রত্যেকটা নক্ষত্র আলাদা ধরনের স্পেকট্রা (বর্ণালি) দেয়। তিনি ভাবলেন, এই স্পেকট্রার সঙ্গে তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক আছে, আছে স্পেকট্রার সম্পর্ক।তিনি সমীকরণ দাঁড় করালেন। সে সমীকরণের নাম হয়ে গেল ‘সাহা আয়োনাইজেশন ইকুয়েশন’। সাহা সমীকরণ দিয়ে নক্ষত্রের তাপমাত্রা ও গঠন সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া সহজ হয়ে গেল। খ‍্যাতি ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপ-আমেরিকার বিজ্ঞানী মহলে। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত করা হল। পদার্থ বিদ্যায় ১৯২৫ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রথম তাঁর নাম সুপারিশ করেছিলেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন। কিন্তু কয়েকজন দেশীয় ও বিদেশী বিজ্ঞানীদের বিরোধিতায় তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি। এরপরেও তাঁর নাম আরো চারবার প্রস্তাব হয়েছিল, যা নোবেল পদকের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। প্রতিবারই তাঁর নাম নানা অজুহাতে বাতিল করে দেওয়া হয়।দেশের লোক বলল নীচু জাত আর বিদেশিরা বলল কালা আদমী। জাতপাত আর বর্ণবিদ্বেষের শিকার হলেন পরাধীন দেশের এক কৃতি বিজ্ঞানী।

দেবরাজ ইন্দ্রের নামানুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল মেঘনাথ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বৈদিক ধর্মীয় আচরণের গোঁড়ামি মেঘনাথকে এতটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ। যিনি ইন্দ্রজিৎ – রাক্ষসদের প্রতিনিধি। সেই থেকে গোটা বিশ্বের কাছে তিনি মেঘনাথ নন, মেঘনাদ নামে পরিচিত হন। ১৯৫১ সালের লোকসভা নির্বাচনে মেঘনাদ সাহা নির্দল প্রার্থী রূপে দাঁড়িয়ে বিপুল জয় পান। উল্লেখযোগ্য হল, মেঘনাদ সাহার নির্বাচনী ইস্তাহারে তাঁকে ‘সাম্যবাদী’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। তাঁর প্রচারচিহ্ন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দুই প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, কোদাল ও বেলচা। সেখানেও তিনি তথাকথিত নিচুতলার মানুষেরই প্রতিনিধি।

আর শুধু বিজ্ঞানীই বা বলছি কেন, মেঘনাদ সাহার আরও একটি পরিচয় ছিল। সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে ছিল তাঁর গোপন ভূমিকা। ছিলেন নেতাজি অনুরাগী আর বাঘা যতীনের সহযোগী । যোগাযোগ রেখে চলতেন অনুশীলন সমিতির সাথেও।

জন্মদিনে বিনম্র প্রণাম |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.