১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা হিন্দুরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন। এরপর বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গ্রহণ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো। ১৯৭২ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি হয় দুটি স্বাধীন দেশের সঙ্গে যাতে একে অপরকে একটি সহযোগী দেশ হিসাবে গ্রহণ করে। সুতরাং পাকিস্তান পর্ব শেষ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু আসার আর কোনো কারণ থাকল না। কিন্তু ঘটনা যে অন্যরকম তা সবাই জানে। ইসলামি সমাজে অন্য ধর্মের মানুষেরা বারবার আক্রান্ত হন সুতরাং আবার উদ্বাস্তু আসা শুরু হলো, পাকিস্তান আমলের মতোই। সমস্যা হলো ১৯৭২ থেকে যেসব হিন্দু উদ্বাস্তু আসতে থাকলেন আগের মতো তাদের জন্য কোনো আইনি রক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের একটি প্রধান পার্থক্য হলো যে এই উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়া কঠিন হয়ে গেল। এমনকী তাঁদের ভারতে থাকাটাই বেআইনি। এর মধ্যে ভারতের নাগরিকত্ব আইন কয়েকবার সংশোধন করে আরো কঠোর হয়েছে। জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন। উদ্বাস্তুদের নাগরিক হবার পথে আরও বাধা। সৃষ্টি করে।
গত কয়েক দশক ধরে উদ্বাস্তু সংগঠনগুলি নাগরিকত্বের দাবি রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের কাছে বারবার করে এসেছে। কিন্তু সিপিআইএম, তৃণমূল ও কংগ্রেস উদ্বাস্তুদের এই স্বীকৃতির জন্য কোনো প্রচেষ্টা নেয়নি। গত ৪৫ বছর ধরে কেন্দ্রে মূলত রাজত্ব করেছেন কংগ্রেস দল। তারা এই বিষয়টি নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন, শিল্পী-সাহিত্যিক- সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও টিভি বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা— কোনও মহল এই বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেনি। এদের সবার নীরবতার একটাই কারণ যে উদ্বাস্তু নিয়ে। আলোচনা হলেই বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদের দাপটের খবর সবাই জেনে যাবে, মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার আড়াল আর কাজ করবে না। যদিও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ, লেখক, মানবাধিকার সংগঠন এই নিয়ে যথেষ্ট সরব।
নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯ জুলাই ২০১৬-তে লোকসভায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ পেশ করেন। এই সংক্ষিপ্ত বিলটিতে বলা হয়েছে যে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের যাঁদের পাসপোর্ট আইন, ১৯২০ ও বিদেশি আইন ১৯৪৬-এর থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে তাদের আর অবৈধ অধিবাসী বলে গণ্য করা হবে না। সংখ্যালঘু বলতে হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন পার্সীদের উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে তারা ভারতীয় নাগরিক হবার জন্য যোগ্য হলেন। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত যে হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান উদ্বাস্তুদের ঘরবাড়ি ছাড়ার বা ভারত ছাড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা, তাঁরা আগামী দিনে ভারতের নাগরিক হিসেবে এদেশেই থাকবেন।
এরপরই শুরু মুসলমান তোষণবাদীদের খেলা। এই আইনটি পাশ হয়ে গেলে হিন্দু উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা। মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা এই অধিকার পাবে না। বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিতাড়নের কোনো আইনি জটিলতা থাকবে না। ফলে বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের জন্য মাঠে নেমে পড়লেন সেকুলার নেতারা। বিলটি লোকসভায় পেশ করা হলে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি প্রধান দল তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআইএম ও কংগ্রেস এর বিরোধিতা করলো। এদের বিলের বিরোধিতার কারণ একটাই কেন এই বিল থেকে মুসলমানদের বাদ দেওয়া হলো। এদের সবার মূল কথা এইবিল সংবিধান বিরোধী। এটি সংবিধানের ১৮নং ধারা প্রদত্ত মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে। ধর্মের ভিত্তিতে এই বিভাজন সম্ভব নয়। এই অভিযোগগুলির জবাব- এই আইনটি করা হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা অনুযায়ী যা আগেই বলা হয়েছে। সত্যিকারের উদ্বাস্তু স্বার্থে যারা আন্দোলন করেন তাদের উচিত এই তিনটি দলের বিরুদ্ধে উদ্বাস্তুদের সচেতন করা ও এদের ইসলামি তোষণবাদী রূপকে চিনিয়ে দেওয়া। যাদের অত্যাচারে উদ্বাস্তু হয়ে মানুষেরা পালিয়ে এসেছেন সেই লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষা করাই এই তিনটি দলের মূল উদ্দেশ্য। এজন্যই এই বিলটি পশ্চিমবঙ্গের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই বিল পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ধারণ করবে।
পশ্চিমবঙ্গে আমরা কেন এন আর সি চাই তার উত্তরটি খুব সহজ। বাংলাদেশ গঠনের পর বিশেষত বামফ্রন্ট সরকার আসার পর দলে দলে বাংলাদেশি মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে থাকে। ৬ মে, ১৯৯০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত লোকসভায় বলেছিলেন যে ভারতে ১ কোটি বাংলাদেশি আছে। ১১ অক্টোবর ১৯৯২-এর গণশক্তি পত্রিকায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু লিখলেন, ১৯৭৭ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত বি এস এফ ২ লক্ষ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর ১৪ জুলাই ২০০৪ সালে কংগ্রেসের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ জয়সোয়াল লোকসভায় জানালেন যে ভারতে মোট ১ কোটি ২০ লক্ষ ৫৩ হাজার ৯৫০ জন বাংলাদেশি রয়েছে। অবশেষে ২০০৫-এ লোকসভাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সমস্যা ও সিপিএমের তাদের দিয়ে ভোট করানোর অভিযোগ তুলে স্পিকার কে কাগজপত্র জুড়ে হৈ চৈ বাঁধালেন। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ যে ভয়ানক সমস্যা তা জ্যোতি বসু থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবাই জানেন। জ্যোতি বসুরা বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে মূলত ভোটেরখেল খেলছিলেন ক্ষমতায় থাকার জন্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ করবার ইসলামি পরিকল্পনায় মদত দিচ্ছেন।
আমরা চাই পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুক্ত করে পশ্চিমবঙ্গ যে আদর্শে গঠিত হয়েছিল তা ফিরিয়ে আনতে। সেজন্য আইনি ও সাংবিধানিক পথে পশ্চিমবঙ্গে এন আর সি চালু করে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করতে। এর জন্য কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান উদ্বাস্তু কিছুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, কারণ ২০১৫ সালে পাসপোর্ট ও বিদেশি আইন সংশোধন করা হয়ে গেছে। এছাড়া নাগরিকত্ব বিল সবাই মিলে পাশ করাতে হবে ফলে আগামীদিনে উদ্বাস্তুরা সবাই নাগরিকত্ব পেয়ে যাচ্ছেন। খুব পরিষ্কার করে উদ্বাস্তু ও অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে যে বিরাট তফাত তা বলতে হবে। তারপর বলতে হবে এন আর সি চালু করবার কথা। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতকে যদি ইসলামি মৌলবাদী আধিপত্য ও দখলের হাত থেকে বাঁচাতে হয় তবে এন আর সি করে বাংলাদেশি মুসলমানদের চিহ্নিত করে তাদের বিতাড়িত করতে হবে। কোনো ভারতীয় মুসলমানের এতে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এটা নরেন্দ্র মোদী সরকারের কোনো বিশেষ স্বার্থ রক্ষার ব্যাপার নয়, এটা পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বের প্রশ্ন। তা না হলে আগামীদিনে হিন্দু বাঙ্গালিকে আবার উদ্বাস্তু হতে হবে?
আবীর গাঙ্গুলী
2019-11-02