আবরার হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য লজ্জাজনক

ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা এক জঘন্য অধ্যায়। পুরো বাংলাদেশ এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার। মানুষ কেঁদেছে। প্রতিবাদ করেছে। নিন্দা করেছে। আমরাফাহাদকে বাঁচাতে পারিনি। তাকে মরতে হয়েছে। মৃত্যুর কাফেলায় যুক্ত হয়েছে আরও একটি নাম। এই হত্যার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আমি আবরার হত্যার বিচার চাই না। বিশ্বজিৎ হত্যা বিচারের মতো আবরার হত্যার বিচার নিয়ে ‘প্রহসন’হোক, তা চাই না। চাই, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। চাই, আইনকে তার নিজস্ব পথে চলতে দেওয়ার স্বাধীনতা। নিষ্ঠুরতার অনন্য নজির এ হত্যার সংবাদ পড়ার সময় সংবাদ পাঠক (চ্যানেল ২৪’র ফারাবি হাফিজ) কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শুনছি, আবরারকে মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যে ফেলে রেখে হন্তারকরা ফুটবল খেলা দেখতে গেছে? এ কেমন বর্বরতা? দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, নৈতিকতায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শুধু সরকারের প্রধান হিসেবে নয়, মা হিসেবে আবরার হত্যার বিচার করবো। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি খুন হয়। আমরা তখন জগন্নাথ হলে, ঘুম থেকে উঠে এ সংবাদ শুনে হতভম্ব হয়ে যাই। খুনি ছাত্রলিগের শফিউল আলম প্রধান ও অন্যরা। বঙ্গবন্ধু কাউকে ছাড় দেননি। সবার সাজা হয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এদের ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়, সেটা ভিন্ন ইতিহাস। ২০১৩-তে বুয়েট ছাত্র দ্বীপকে শিবির হত্যা করে। কোনো হৈচৈ হয়নি? কুষ্টিয়ার এসপি এসএম তানভীর আরাফাত বলেছেন, আবরারের পরিবার জামাত-শিবির। তসলিমা নাসরিন লিখেছেন, “আরবাব অফিসিয়ালি শিবির না করলেও শিবিরের মতো চাল চলন আর চিন্তা ভাবনা। তাতে কী! শিবিরদেরও বাঁচার অধিকার আছে।
ভিন্নমত প্রকাশের জন্যে জীবন দিতে হয়েছে আবরার ফাহাদ-কে। নৃশংস হত্যাকাণ্ড। হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুরবাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রি নিলয়, ফয়সাল আরেফিন দীপন, নাজিমুদ্দিন সামাদ, মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকি, শাজাহান বাচ্চু, জুলহাস মান্নান, মাহবুব তনয়, এরাও নিহত হয়েছেন নির্মমভাবে। ভিন্নমত প্রকাশের জন্যেই তারা মরেছেন। আবরার হত্যা নিয়ে যাঁরা এখন সোচ্চার, মুক্তমনাদের হত্যার পর তারা কি সোচ্চার ছিলেন? যারা এখন বাক-স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বামুক্তমনাদের বাক-স্বাধীনতার পক্ষে কিতখন কথা বলেছেন? আবরার শিবির না হলেও মৌলবাদী ঘরানার লোক। এজন্য মৌলবাদীরা সোচ্চার। এরা মুক্তমনাদের হত্যায় চুপ ছিল। সমস্যাটা এই জায়গায়। একটি হত্যায় আপনি খুশি, অন্যটিতে বেজার, তা হয় না। হত্যা, হত্যাই। প্রতিটি হত্যা নিন্দনীয়। এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপক প্রতিবাদ একটি শুভ লক্ষণ। কিন্তু সবার কি প্রতিবাদ করার নৈতিক অধিকার আছে ? যাঁরা মুক্তবুদ্ধির মানুষগুলোকে হত্যার পর চুপ ছিলেন, তাদের কি অধিকার আছে প্রতিবাদ করার? মুক্তচিন্তক তরুণরা তো কেউ আবরারের চাইতে কম মেধাবী ছিলেন না? আবরারের ক্ষেত্রে বেশি প্রতিবাদ হচ্ছে, প্রগতিশীলরা প্রতিবাদ করছেন, একই সঙ্গে মৌলবাদীরা প্রতিবাদ করছেন। আবরারের লাশ ব্যবহার করে ভারত বিরোধী ঝান্ডা তুলে মৌলবাদী গোষ্ঠী পুরাতন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার এই অপপ্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে বটে। মৌলবাদীদের যাঁরা এখন প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন, তাদের এই ‘সিলেকটিভ মানবতা একটি দেশ ও সমাজের জন্যে ক্ষতিকর। আববার হত্যাকাণ্ডে ভারত বিরোধিতার ঝড় বইছে। যে কারো ভারত বিরোধিতার অধিকার আছে? কিন্তু সেই বিরোধিতা যখন সাম্প্রদায়িক অ্যাঙ্গেল থেকে হয়, সমস্যা সেখানে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। চুক্তির ভেতর-বাহির কেউ জানে না, কিন্তু ‘চিলে কান নিয়ে গেল’ বলে সবাই চিলের পেছনে ছুটছেন?
মৌলবাদীরা এখন সোচ্চার, কারণ ক্ষমতায় আওয়ামি লিগ, এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা? ওঁরা আবরার হত্যাকাণ্ডকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সামাজিক মাধ্যমে এঁরা দ্রুত ছড়িয়ে দেয় যে, অনিক সরকার ও অমিত সাহার নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড। অনিক, অমিত, শিবসেনা, আর এস এস,ইস্কন ইত্যাদি। পরে জানা গেল, অনিক সরকার হিন্দু নন, মুহম্মদ অনিক। তারা কিছুটা পিছু হটলো। শুরু হলো অমিত সাহার বিরুদ্ধে প্রচারণা। মৌলবাদীদের চাপে অমিত সাহা গ্রেপ্তার হলেন। ঘটনার দিন অমিত সাহাহলে ছিলেন না। সিসিটিভি ফুটেজে তিনি নেই। এজাহারে নাম নেই। তার বন্ধু ফাহিম বলেছেন, অমিত তার বন্ধুর বাসায় ছিলেন। ফাহিম বলেন, সমস্যা হচ্ছে, অমিত হিন্দু, তাঁকে ব্লেম দেওয়া হচ্ছে। অমিতের বন্ধু আবীর বলেছে, অমিত তাদের বাসায় ছিল।
নয়া দিগন্ত, চ্যানেল আই, এনটিভি অমিতের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে। অমিত দোষী হলে তার শাস্তি হওয়া উচিত। তার রুমে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই কক্ষে ৪ জন ছাত্র থাকতেন, অন্যদের কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? এখন বলা হচ্ছে, আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার সময় ছাত্র লিগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক ও পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এজাহারের বাইরেও এ হত্যার ঘটনায় আরো তিনজনের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। অমিত সাহা বলেছেন, বুয়েটের ট্র্যাডিশনই হচ্ছে উপরের (সিনিয়রদের) অর্ডার এলে তা মানা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। প্রশ্ন হলো,১৯ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১ জন হিন্দু হলে এদের বিরুদ্ধে বিশেষভাবেঝাপিয়ে পড়ার কারণ কী? অভিযুক্ত সনাক্তে ধর্ম সামনে আসবে কেন? খুনির পরিচয় শুধুই খুনি, হিন্দু খুনি, মুসলমান খুনি, আসলো কবে থেকে?
একটি মহল আরবার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে যে, আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরপরই বুয়েটে সক্রিয় হিজবুত তাহরীর।নিষিদ্ধ ঘোষিত এই সংগঠনটির প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্ত ঘাঁটি রয়েছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত করেছে। এর আগেও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজবুত তাহরীর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে একাধিক শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করা। হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এই মহলটি বলতে চাইছে, আবরার ভারত বিরোধী মন্তব্য করেছে বলে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কোথায় যেন দেখলাম, দেশে এখন ৮০ শতাংশ মানুষ মৌলবাদী ও ভারত বিরোধী। তাই যদি হয়, তাহলে তো ছাত্র লিগকে কোটি কোটি মানুষকে মারতে হবে? ছাত্র লিগ কি মানুষ মারার যন্ত্র ? আইসিস যখন বিশ্বব্যাপী মানুষ মারে, তখন আপনারাই তো বলেন, ওঁর প্রকৃত মুসলমান নয়, তাহলে ছাত্র লিগের যাঁরা আবরারকে মেরেছে ওরাও প্রকৃত ছত্রলিগ নয় ?
আবার দেখা যাচ্ছে, প্রায় একই সময়ে দুটো খুন। একটি আবরার। অন্যটি ময়মনসিংহ কমার্স কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শাওন ভট্টাচার্য, তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দুজনই ছাত্র। একজনকে নিয়ে মানুষ প্রতিবাদী। অন্যজনকে নিয়ে টু-শব্দ নেই? শাওনের দুর্ভাগ্য, তিনি ছাত্রলিগের হাতে খুন হননি অথবা তিনি হিন্দু। আচ্ছা, আবরার না হয়ে যদি ‘দিলীপ’ হতো বা এমনকী, একজন মুক্তমনা ‘বোরহান’ হতো তাহলে কি প্রতিবাদ হতো? দুটো খুন, পার্থক্য বিস্তর! এটাই বাংলাদেশ। এগারো বছরের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির শাসনের সুফল এখন ঘরে ঘরে মৌলবাদ। সুখের বিষয়, দীর্ঘদিন হাইবারনেশনে থেকে উঠে দেশের বুদ্ধিজীবীরা এবার একটি সঠিক বিবৃতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, কারো মতে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ জিম্মি থাকতে পারে না। তারা আরও বলেন, “এক গভীর উৎকণ্ঠা ও অসীম বেদনায় নিমজ্জিত আজ পুরো জাতি। সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে রাজনৈতিক দলের আদর্শবিহীন দেউলিয়া চরিত্র।”
দৈনিক শিক্ষা নামের একটি পত্রিকা বলেছে, বিবিসি বাংলার ভুল সংবাদই কাল হলো আবরার ফাহাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে তথ্য বিকৃত করে ভুল সংবাদ পরিবেশন করে বিবিসি। এই সংবাদের ভিত্তিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্টেটাস দেয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ।ক্ষিপ্ত হয়ে আবারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ ঘটনার পর ছাত্রলিগ নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে। বিবিসির সংবাদের প্রতিক্রিয়াতে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, ভারতের সঙ্গে গ্যাস রফতানির কোনো চুক্তি সই হয়নি। যৌথভাবে এলপিজি প্ল্যান্ট স্থাপনের চুক্তি হয়েছে। পত্রিকাটি সত্য বলেছে। বিবিসি বাংলা নিউজ এখন মৌলবাদীদের আখড়ায় পরিণত। ভারতে রাম মন্দির-বাবরি কাণ্ড ভাঙানিয়ে তৎকালীন ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) ঢাকাস্থ প্রতিনিধি গিয়াস কামাল চৌধুরী মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে বলেছিলেন, “বাবরি মসজিদ ভাঙায় শাঁখারি পট্টিতে হিন্দুরা মিষ্টি বিতরণ করেছে। এই সংবাদে বাংলাদেশে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়।
এবার দেখা যাক, আবরার ফাহাদ আসলে কী লিখেছিলেন, যার জন্যে তাকে মরতে হলো? ৫ অক্টোবর ফেইসবুকে আবার লিখেন (হুবহু) : (১) ৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিয়েছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। (২) কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব। (৩) কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে ভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। হয়তো এসুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন, “পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/ এ জীবন মন সকলি দাও/ তার মতো সুখ কোথও কি আছে/ আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”
শিতাংশু গুহ
(লেখক নিউইয়র্ক স্থিত প্রবাসী বাংলাদেশি)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.