এশিয়ান গেমস শুরুর আগে থেকেই ভারতের উশু নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। অরুণাচল প্রদেশের তিন ক্রীড়াবিদকে ভিসা না দেওয়া নিয়ে ভারত-চিনের কূটনৈতিক লড়াই অনেক দূর গড়িয়েছে। সেই উশুতেই রুপো জিতে দেশকে গর্বিত করলেন নাওরেম রোশিবিনা দেবী। পদক উৎসর্গ করলেন মণিপুরবাসীকে।
দেশের জন্য পদক জিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মণিপুরের ক্রীড়াবিদ। মণিপুরে হিংসার জেরে মে মাস থেকে বাড়ি ফেরেননি রোশিবিনা। এমনকি অনুশীলনে যাতে কোনও সমস্যা না হয় তার জন্য পরিবারের লোকেদের সঙ্গে তাঁর কথা বলাও নিষেধ ছিল। পদক জিতে অবশেষে পরিবারের সঙ্গে কথা হয় রোশিবিনার। তার পরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
রুপো জেতার পর রোশিবিনা বলেন, ‘‘মণিপুর জ্বলছে। লড়াই চলছে রোজ। গ্রামে ফিরতে পারছি না। যাঁরা ওখানে সমস্যায় রয়েছেন, তাঁদের এই পদক উৎসর্গ করছি। জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে। হিংসা কবে থামবে, কবে আবার সবকিছু আগের জায়গায় ফিরবে, জানি না।’’
এশিয়ান গেমসে তিনি এসেছেন অনুশীলনের সঙ্গীকে ছাড়াই। পাশাপাশি, মণিপুরের এই ক্রীড়াবিদ গত কয়েক মাস ধরে নিজের রাজ্যে চলা হিংসা নিয়েও চিন্তিত। এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতির ফাঁকে পরিবারের সুরক্ষার কথা নিয়ে ভেবেছেন সব সময়।
৬০ কেজির ফাইনালে উঠে আগেই ইতিহাস তৈরি করেছিলেন রোশিবিনা। আজ পর্যন্ত উশুতে এর আগে একজনই ফাইনালে উঠেছেন। ২০১০ গুয়াংঝু গেমসে পদক পেয়েছিলেন ওয়াংখেম সন্ধ্যারানি দেবী। পদকের স্বপ্ন নিয়ে হ্যাংঝাউতে গিয়েছিলেন রোশিবিনাও। কিন্তু অনুশীলনের সঙ্গী তথা প্রিয় বন্ধুকে না পেয়ে গেমস শুরুর আগেই মুষড়ে পড়েছিলেন।
অনুশীলনে রোশিবিনার সঙ্গী হলেন ওনিলু তেগা। তাঁরও এশিয়াডে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অরুণাচলের বাসিন্দা হওয়ায় তাঁকে ভিসা দেয়নি চিন। সেই প্রসঙ্গে রোশিবিনা বলেছেন, “যে তিন বন্ধুকে এখানে পেলাম না, তাদের জন্যে এই পদক উৎসর্গ করছি। আমি সব সময় ওনিলুর সঙ্গে থাকি। একসঙ্গে অনুশীলন করি। আমরা খুব ভাল বন্ধু। এ ধরনের বড় প্রতিযোগিতায় পাশে পরিচিত কাউকে পেলে ভাল লাগে।”
তিনি আরও বলেছেন, “ভারতে উশু খুবই ছোট একটা পরিবারের মতো। তাই আমার সাফল্য বাবা-মা এবং তিন বন্ধুকে উৎসর্গ করছি। ওদের জন্যে এটাই আমার উপহার।”
মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলার কাওয়াফাই মায়াই লেইকেই গ্রামে বাড়ি রোশিবিনার। রাজধানী ইম্ফল থেকে গাড়িতে ঘণ্টা খানেকের দূরত্ব। ছোট থেকে জ্যাকি চ্যানের সিনেমা দেখে বড় হয়েছেন। চিনের মার্শাল আর্টে প্রথাগত ‘পাম হোল্ড ফিস্ট স্যালুট’ তাঁর খুব প্রিয়। তিনি বলেছেন, “আমার প্রথম থেকেই ওই স্যালুট খুব ভাল লাগে। তাই উশু ছাড়া আর কোনও খেলাকে বেছে নিতাম বলে মনে হয় না।”
বাকি খেলার মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সে ভাবে খেলতে যাওয়া হয় না। কিন্তু রোশিবিনার বেশি চিন্তা রাজ্য মণিপুর নিয়ে। মেইতেই সম্প্রদায়ের রোশিবিনা বাবা নাওরেম ধামু, মা রোমিলা দেবী এবং ১৬ বছরের ভাই নাওরেম প্রিয়জিৎ সিংহকে নিয়ে চিন্তিত।
বলেছেন, “এখানে বসে কিছুই করার নেই। নেতিবাচক পরিবেশ থেকে দূরে থেকে ওদের জন্যে প্রার্থনা করছি। আমার বাবা রোজ প্রতিবাদ করতে যান। মা সারা রাত পাহারা দেন, যাতে গোটা গ্রাম নিরাপদে থাকে। আমাদের গ্রাম একটা থানার সামনেই। কিন্তু আমি শুনেছি ওখানে পুলিশও নাকি বিপজ্জনক।”
মে মাস নাগাদ হিংসার খবর বাড়ার পর রোশিবিনার কোচ ছাত্রীর থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছিলেন, যাতে রোজকার খবর না চোখে পড়ে। শুধুমাত্র রবিবার হলে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান রোশিবিনা। কষ্টের জীবনে উশুতে সাফল্যই তাঁর পরিবারের মুখে হাসি ফোটাসে পারে সেটা জানেন তিনি। বৃহস্পতিবারের সাফল্যের পরে রোশিবিনার আশা, দুঃখের দিন অচিরেই বদলাবে।