ভারত শীঘ্রই পাঁচ ট্রিলিয়নের অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠছে

বিগত দু’ দশকের মধ্যে কোনো সরকারের তরফে সর্বাপেক্ষা দুঃসাহসিক অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্যেই পড়বে অর্থমন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারামনের নেওয়া সাম্প্রতিক । করপোরেট কর হারের ছাঁটাই। এক ধাক্কায় কোম্পানির লাভের ওপর করের হার ৩৫ থেকে ২৫.২ শতাংশে নামিয়ে আনা দেশের উৎপাদন শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন রক্ত। সঞ্চালনের সহায়ক হওয়ার অনুকূল। নতুন শিল্প উৎপাদকদের ক্ষেত্রে এই কর আবার। মাত্র ১৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে যাঁরাই নতুন শিল্পোদ্যোগে হাত লাগাবেন তারাই এই হারের সুযোগ পাবেন।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত হার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশে লাগু থাকা কর হারের সমান। যদিও তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা ভিয়েতনামের থেকে তা বেশি। অত্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে যে নতুন শিল্পোদ্যোগগুলি চালু হওয়ার আশা করা হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে কর হার সিঙ্গাপুরের সমতুল হলেও অন্যান্য সব কটি দেশের থেকে কম। এতদিন প্রচলিত নানা ধরনের প্রকল্পে অংশ নেওয়া বা অনেক ধরনের ঋণপত্র কেনার মাধ্যমে কোম্পানিগুলি যে ছাড় পেত তা তুলে দেওয়ায় কর প্রদানের পদ্ধতিও অনেক সরলীকৃত হয়ে যাবে। কমবে ঘুষ, হয়রানি ও কর নিয়ে মামলা মকদ্দমা।
ভবিষ্যতে সরকার যদি আগের মতো নানাবিধ শর্ত সাপেক্ষ ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থাকে মাথা তুলতে না দেয় সেক্ষেত্রে কোম্পানির দেয় কর নিয়ে বিতর্ক, আইন আদালত নিশ্চিতভাবে কমে আসবে। ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশেরও উন্নতি ঘটবে। সহজ করে বললে বর্তমানে সরকারের পরিবেশ বান্ধবতা, কারখানার সম্ভাব্য দূষণ ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে যথাযথ মাত্রা পালিত হচ্ছে কিনা ইত্যাদি নিয়ে কর আধিকারিকরা সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলিকে যে যথেচ্ছ হয়রানি করে থাকে তা নিরসন হয়ে যাবে। কেননা উল্লেখিত বিষয়গুলি পালন করলে যে ছাড় পাওয়া যায় তা ঠিকভাবে মান্য করা হয়েছে। কিনা তা নিয়েই করকর্তারা কোম্পানিগুলিকে নাস্তানাবুদ করে থাকে।
ব্যক্তিগত আয়করের ক্ষেত্রেও একই ধরনের হস্তক্ষেপের অবকাশ রয়েছে। এখানেও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। বহু ধরনের ছাড় রয়ে গেছে যার ফলে কর আদায়ের মূল ভিত্তিটিই কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায়। বহু টাকা আয় হলেও বিপুল ধরনের ছাড় বিদ্যমান থাকায় শেষমেশ করযোগ্য আয় অনেকটাই কমে আসে। ফলে সর্বোচ্চ কর ৪৩ শতাংশের মতো উচ্চহারে রয়েছে। এই উচ্চহার ও আনুষাঙ্গিক ছাড়ের যুগ্ম উপস্থিতিই করজনিত দুর্নীতি ও বিতর্কের মূল কারণ। ব্যক্তিগত আয়করের সর্বোচ্চ হার কোম্পানির মতো ২৫ শতাংশে বেঁধে দিয়েও সমস্ত আনুষাঙ্গিক ছাড় তুলে দিলে দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গে দেয় কর নিয়ে বিতর্ক, ট্রাইব্যুনাল অনেক কিছুই কমে আসবে।
সরকার যদি দেশের করদাতাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে যে তাদের ভবিষ্যৎ ট্যাক্স, রিটার্নে বর্ধিত ঘোষিত আয়ের ভিত্তিতে সরকার অতীতের সমস্ত রিটার্নে কী আয়ের ভিত্তিতে কর দেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না, কোনো তদন্ত শুরু করবে না সেক্ষেত্রে কর হার কমলেও আদায় শেষ অবধি বাড়বে। সামগ্রিকভাবে করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে করের নিম্ন হার পুষিয়ে যাবে। কোম্পানির লাভের ওপর করের হার কমানোর ফলে লগ্নি করা টাকার ওপর থেকে কোম্পানির হাতে। পাওয়া লাভ বাড়বে। ওই বাড়তি টাকাকে পুনর্লগ্নি করার মানসিক প্রবণতাও বাড়বে। কোম্পানি করের নিম্ন হারের ফলে লাভের মাত্রায় বৃদ্ধি ঘটলে । করপোরেট সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও বৃদ্ধি ঘটবে। করপোরেট ক্ষেত্রগুলিতে লাভের মাত্রা। বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের। সঞ্চয়ও বাড়তি লাভের প্রত্যাশায় শেয়ার বাজারমুখী হবে। তাহলে, প্রস্তাবিত কর। হার ছাঁটাইয়ের মধ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বিশেষ করে সংগঠিত ক্ষেত্রে। কিন্তু সরকার যেন কোম্পানির এই বাড়তি নগদকে। কোনোভাবে বন্ড ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের হাতে নিতে না যায় এবং তাকে চলতি খরচ খাতে না ভিড়িয়ে দেয়।
ভারতবর্ষে মূলধন কিন্তু বাজারে মজুত শ্রমশক্তির থেকে অনেক বেশি দুর্লভ। কোম্পানিগুলিকে অধিকাংশ। সময়ই মূলধন বা ঋণের ক্ষেত্রে সুদের উচ্চহার সম্পর্কে ক্ষোভ ব্যক্ত করতে দেখা। যায়। তারা কিন্তু বেতনের উচ্চহার নিয়ে। বিশেষ অভিযোগ করে না। তার ফলে এই দুর্মূল্য পুঁজিকে তারা বিরাট শ্রমিকশ্রেণীর জন্যই নির্দিষ্ট করবে এমনটা ভাবা যেতে পারে। যার ফলে উৎপাদনশীলতায় বৃদ্ধি ঘটার প্রচুর সম্ভাবনা। শুধু তাই নয়, তা নতুন লোক নিয়োগের অর্থ জোগাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের বড়ো বড়ো কর্পোরেটগুলি করে তার উল্টোটাই। তারা মূলধন এমন শিল্পে নিয়োজিত করে যেখানে মূলধনের প্রয়োজন তুলনামূলকভাবে বিপুল ও খুবই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সাপেক্ষ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় উৎপাদন শিল্পের সবচেয়ে বড়ো যে স্তম্ভ সেই। অটোমোবাইলের ক্ষেত্রে ম্যানেজিং। ডাইরেক্টর থেকে শেষ নিরাপত্তা রক্ষীর মাইনে সমেত কোম্পানির সমগ্র উৎপাদন খরচের মাত্র ৫ শতাংশ।
দেশ কিন্তু আলোচ্য যে উদ্বৃত্ত অর্থ কোম্পানিগুলির হাতে আসার সম্ভাবনা রয়েছে তা এইভাবে অপব্যয় করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে না। দেশের নাগরিকদের যদি ভালো চাকরি বাকরির ব্যবস্থা করতে হয় তাহলে আরও সংস্কার এনে। কোম্পানিগুলির বিনিয়োগের নীতিতে নতুন নিয়োগের ওপর বাড়তি গুরুত্ব। বাধ্যতামূলক করতে হবে। শ্রম আইনের। সংস্কার এই জন্যই জরুরি। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিতে হাত লাগানোর সময় কিন্তু পেরিয়ে যাচ্ছে।
এই সংস্কার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে ন্যূনতম ধাপ হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে চল্লিশ বছর আগে চালু করা একশোর বেশি শ্রমিক কর্মরত কারখানায় কোনো অবস্থাতেই শ্রমিক ছাঁটাই চলবে না। এই প্রাচীন আইন বাতিল করতে হবে।
এক্ষেত্রে ২০০৪ সাল থেকে মোদীর নিজের চালু করা গুজরাটের special economic zone-93 6701 67 সংশোধিত শ্রম আইন চালু হয়েছিল সেটি মডেল হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়লে নিয়োগকর্তা তার শ্রমিককে ছাঁটাই করতে পারবেন। শর্ত থাকবে যে যত বছর কাজ করেছে প্রত্যেক বছরের জন্য ৪৫ দিনের মাইনে তাকে দেওয়া হবে বাধ্যতামূলক।
স্বল্পমেয়াদি পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে কোম্পানি করের ওপর প্রস্তাবিত কর হার কমিয়ে আনায় জিডিপি-তে শতকরা ০.৭ শতাংশ ক্ষতি হবে। এই বিষয়টা অবশ্যই সরকারকে ভাবাচ্ছে। এই অবস্থায় সরকারি খরচের পরিমাণ যা আছে তাই রেখে দিলে সামগ্রিক রাজস্ব ক্ষেত্রের ভারসাম্য বজায় রাখায় সমস্যা হতে পারে। অন্যদিকে কর কম আদায় (কোম্পানি কর) জনিত ঘাটতি সামলাতে যদি পরিকাঠামোগত ও অন্যান্য খরচে কাটছাঁট করা হয় সেক্ষেত্রে অর্থনীতিতে সঙ্কোচনের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে চাহিদার ক্ষেত্রে যখন যথেষ্ট দুর্বলতাই দেখা যাচ্ছে।
এই দু’মুখো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেরোবার রাস্তা আর একবার অর্থনীতিতে উন্নয়নমুখী সংস্কারের চেষ্টা করা। প্রথমত, সরকার অধিগৃহীত সংস্থাগুলিতে অংশীদারির (Public Sector Enterprise) নিয়ন্ত্রিত বিক্রয়। হাইওয়ে, বিমান বন্দর, বন্দর, রেল স্টেশন, বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন প্রভৃতি পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে সরকারের যে বিপুল টাকার সম্পদ রয়েছে তা নির্দিষ্ট মূল্যে প্রয়োজনমতো বেসরকারি হাতে দিয়ে সরকারের বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ চাহিদাগুলির মোকাবিলা করুক। দেশব্যাপী সরকারি সংস্থাগুলির বিরাট। পরিমাণ পড়ে থাকা অব্যবহৃত জমিগুলির বিক্রিও এর মধ্যে পড়বে। অবশ্য সরকারি সংস্থাগুলির হাত বদল ও সম্পদ বিক্রির দুটি বিষয়ই সরকারের নীতিগত অ্যাজেন্ডার মধ্যে রয়েছে। এই নীতির দ্রুত রূপায়ণের সঙ্গে অব্যবহৃত জমি বিক্রির ক্ষেত্রেও সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই ক্ষেত্রগুলিতে সরকার সঠিকভাবে এগোতে পারলে ও দৃঢ়তার সঙ্গে হাত লাগালে সরকার এক ঢিলে চার চারটি পাখি মারবার জায়গায় চলে যাবে। (১) সরকারের রাজস্ব ঘাটতি কাঙ্ক্ষিত স্তরে বেঁধে রাখা যাবে। (২) চাহিদার ক্ষেত্রেও ভারসাম্য বজায় থাকবে। (৩) সরকার। পরিচালিত সংস্থাগুলির কর্মদক্ষতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। (৪) পরিকাঠামোগত সম্পদগুলি ও অব্যবহৃত শহরাঞ্চলের সরকারি জমিগুলির যথাযথ সদ্ব্যবহার হবে। সবগুলি মিলিয়ে সরকারের অর্থনীতির বহর ৫ ট্রিলিয়নে পৌঁছে। দেওয়ার যে স্বপ্ন তাকে সাকার করার রসদ এই নিদানগুলির মধ্যেই রয়েছে।
অরবিন্দ পানাগড়িয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.