তাঁর নিজের যে একটা পদবী আছে, এ কথা অনেকেই মনে রাখেননি। বহুজনের বিশ্বাস মানুষটির নামই বিদ্যাসাগর (Vidyasagar)। কিন্তু বীরসিংহের ভূমিপুত্র ঈশ্বরচন্দ্র (Ishwar chandra Vidyasagar) প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিতে যে উপাধি অর্জন করলেন, সেইটেই নাম হয়ে উঠল তাঁর জীবদ্দশাতেই। এমন ঘটনা পৃথিবীতে বড়োই বিরল। আর তাইতো বাঙালির ইতিহাসে তারানাথ বাচস্পতির পুত্র জীবানন্দ, রংপুরের নীলকমল, যশোরের রাজীবলোচন, সংস্কৃত কলেজের মাষ্টারমশাই প্রাণকৃষ্ণ কিংবা শিবনাথ শাস্ত্রীর বাবা হরানন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব তাঁদের কাজের জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পেলেও সিংহভাগ বাঙালি ‘বিদ্যাসাগর’ বলতে একজনকেই বোঝেন। আর তা হবে নাই বা কেন! উঠতে বসতে, চলতে ফিরতে করে কম্মে খাওয়া বাঙালির মুখের ভাষা জোগানোর প্রধান স্থপতি তো এই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যাঁর সম্পর্কে বলেন, “কাকের বাসায় কোকিলে ডিম পাড়িয়া যায়, মানব ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপন কৌশলে বাঙালিকে বিদ্যাসাগরের প্রতি মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন।” ঈশ্বরচন্দ্রের হাতেই আধুনিক বাঙালির সত্যিই অনেকখানি মানুষ হওয়া। উনিশ শতকের বাঙালি তার চিন্তা চেতনায়ও সাবালকত্ব পেয়েছিল এই মানুষটির জন্যই।
আমাদের বর্ণ পরিচয়ের হাতেখড়ির ভার আজও তাই বিদ্যাসাগরের। বাঙালি মেয়ের ‘উওম্যান এম্পাওয়ারমেন্ট’ (Women Empowerment) শুরুও ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে। বাংলা গদ্যের স্বার্থক সূচনায়, কিংবা অকাল বৈধব্যের অর্থহীন আচারসর্বস্বতায় মরতে বসা বাঙালি মেয়ের যন্ত্রণা সবেতেই ঢাল হয়ে দাঁড়ানো এই মানুষটির কাছে তো বাঙালি চিরঋণী। প্রদীপ নিজে জ্বলে চারপাশ আলোকিত করে। দগ্ধ হওয়ার ব্যথা সে আলোতে আড়াল হয়ে যায়। বিদ্যাসাগরের সব প্রগতিশীল কাজেরও চিরসঙ্গী ওই দগ্ধতার যন্ত্রণা। সমাজের একটা বিরাট অংশের তাঁর প্রতি বিরোধিতা, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, অপমান, টিটকিরি। কিন্তু, একটা গোটা সময়কে প্রায় নিজের কাঁধে বহন করে নিয়ে যাওয়া এই মানুষটি কথা নয়, কাজে বিশ্বাস করতেন। ছোটোবেলার একগুঁয়ে স্বভাবই শাপে বর হয়ে চিরটাকাল তাঁকে বল ভরসা যুগিয়েছে। ফলত, নিজের সিদ্ধান্তকে ফলপ্রসু করতে যতদূর যাওয়ার প্রয়োজন ততদূর গেছেন ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিবার। তীব্র কষ্ট পেলেও বিদ্যাসাগরের ক্ষমাশীলতা সমাজের এই অভব্যতাকে শেষপর্যন্ত ‘করুণা’ই করেছে বারবার। ফলত, সব কাজেই বহু লড়াই পেরিয়ে, এমনকি প্রাণ সংশয়ের ফাঁড়া কাটিয়েও বিদ্যাসাগর সফল হয়েছেন। তাঁর হাত ধরে সফল হয়েছে বঙ্গ সমাজ, সংস্কৃতি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলতেই সীমাহীন দারিদ্র্য, মাতৃভক্তি, বিধবাবিবাহের পক্ষে লেখালেখি, আন্দোলোনের অভিঘাতে শাড়ির পাড়ে ‘বেঁচে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’ এসবই যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি পদে পদে ‘যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর’-এর এই অপমান, এই তীব্র মানসিক যন্ত্রণা।
কেবল সমাজ নয়, পরিবারের তরফেও বিদ্যাসাগর বারবার পেয়েছিলেন এমন আঘাত। ঈশ্বরচন্দ্ররা ছিলেন সাত ভাই। তিনজন শৈশব, কৈশোরেই মারা যায়। পূর্ণ বয়স পর্যন্ত জীবন কাটান ঈশ্বরচন্দ্র, ঈশানচন্দ্র, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন। এই ভাইদের কাছ থেকেই কারণে অকারণে অপমান, আঘাত পেয়েছেন বিদ্যাসাগর। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে বাবা ঠাকুরদাস ঠিক করেছিলেন কাশীবাসী হবেন। এই সিদ্ধান্তে বাধা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর জোরাজুরিতেই ঠাকুরদাস বীরসিংহে ফিরতে উদ্যোগী হলে ঈশানচন্দ্র জানিয়ে দেন এই বয়সে ঠাকুরদাসের গ্রামে ফিরে সংসারী লোকের মতো থাকা উচিত নয়। কাশীধামই তাঁর জন্য শ্রেয়। সংসারে গুরুত্ব হারানো ঠাকুরদাস এই সিদ্ধান্তে কতখানি কষ্ট পেয়েছিলেন তা আন্দাজ করা যায়। সেইসঙ্গে টের পাওয়া যায় কথার খেলাপ করতে বাধ্য হওয়া বিদ্যাসাগরের বিড়ম্বনা ও অস্বস্তি। শেষপর্যন্ত ঠাকুরদাস কাশীতেই থাকতে শুরু করলে জ্যেষ্ঠপুত্র ঈশ্বরচন্দ্রই নিয়ম করে সেখানে গিয়ে বাবাকে দেখে আসতেন।
মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগরকে আমরা জানি। মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য উত্তাল দামোদর সাঁতরে পেরিয়ে বিদ্যাসাগর কিংবদন্তির নায়ক। কিন্তু এখানে যে তিনি পিতৃভক্ত। অথবা বলা চলে পরিবারের প্রতি একনিষ্ঠ ও দায়বদ্ধ। যার প্রমাণ মেলে আরও। ‘সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটারি’র মালিকানা নিয়ে ভাই দীনবন্ধুর সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। মীমাংসা হওয়ার পর মালিকানার দাবি ত্যাগ করার পাশাপাশি দাদার কাছ থেকে টাকা নিতেও অস্বীকার করেন দীনবন্ধু। ভাই-এর অভাবের সংসারে এরপরেও বিদ্যাসাগর প্রতিমাসে লুকিয়ে সাধ্যমত টাকা দিয়েছিলেন, ভাই-বৌয়ের হাতে। সংসারের নির্মম পরিহাস ছোটো-বড়ো সব মানুষদের জন্যই এক বোধহয়। দাদার সঙ্গে তাই সম্পর্ক না রাখলেও দাদার কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে পরে কোনো আপত্তিই ছিল না দীনবন্ধুর। কোনো এক অজানা কারণে ক্ষীরপাইয়ের পণ্ডিত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় ও কাশীগঞ্জের মনোমোহিনী দেবীর বিধবাবিবাহে থাকেননি বিদ্যাসাগর। এই জন্য ভাই শম্ভুচন্দ্র ভারতে বিধবাবিবাহ প্রচলনের কাণ্ডারি ঈশ্বরচন্দ্রকেই বলেছিলেন ‘কাপুরুষ’। এই বিশেষণ বিদ্যাসাগরের ঘোর শত্রুও কখনও বলার সাহস রাখেনি।
নিজের গ্রাম, পরিবার পরিজন একসময় সবই ছেড়েছেন বিদ্যাসাগর। যে সমাজের সংস্কারক বিদ্যাসাগর, সেই সমাজ তাঁকে কতশত আঘাতে বিধ্বস্ত করেছে তার প্রমাণ উনিশ শতকের ইতিহাস। কখনও ইংরেজ সরকার, কখনও কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী কখনও বা সমাজের উচ্চবিত্তমহল অপমানে, আঘাতে বিধ্বস্ত করেছে বিদ্যাসাগরকে। ‘সম্বাদ প্রভাকরে’র কাটতি বেড়েছে তাঁর প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রুপে। অশ্লীল শব্দে ছড়ায়, গানে কলকাতার অলিগলিতে ঘুরেছে বিদ্যাসাগরের নামে নিন্দার বাণ। ১৮৮০ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার (British Government) ঈশ্বরচন্দ্রকে সিআইই উপাধি দিতে চায়। কেতাদুরস্ত পোশাক পরে রাজদরবারে গিয়ে পুরস্কার নেওয়ার লোক নন তিনি৷ বিদ্যাসাগর এমনিতেও তখন কর্মাটাঁড়ে। কিছুদিন পর লাটসাহেবের দুজন কর্মচারী বিদ্যাসাগরের কাছে পদক দিতে এসে বকশিশ চায়। তখন তিনি বলেন, ‘এই পদক বেনের দোকানে বেচে দাও। যা পাবে, দু’জনে ভাগ করে নিও’। এরপর, লাটসাহেবের প্রাইভেট এন্ট্রির তালিকা থেকে নিজের নামটিও কাটিয়ে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
আঘাত মেনে নিয়েছেন বারবার। তবু তোষামোদিকে দূরেই ঠেলেছেন। আঘাত, অপমান হয়ে উঠেছে অভিমান। তবু, শেষপর্যন্ত সবার সার্বিক কল্যাণচিন্তাই ছিল তাঁর সঙ্গী। কখনও বলে ফেলেছেন পরিবার পরিজন তাঁকে ভুল বুঝল। কখনও বলেছেন আমাদের সমাজের মানুষ এত অসার ও অপদার্থ তা আগে বুঝলে বিধবাবিবাহ বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন না। বিধবাবিবাহ আইন প্রচলনের ১৬৩ বছর কেটে গেলেও যে সমাজে আজও বিধবাবিবাহের সংখ্যা হাতে গোনা ও বিধবা মেয়ের বিয়ে পাড়ার কূটকচালির বিষয়, সেখানে বিদ্যাসাগরের এই খেদোক্তি আমাদের মাথা পেতেই নিতে হয়।
বিদ্যাসাগেরর মেধায়, তাঁর কৃতিত্বে, তাঁর সাফল্যে বাঙালি (Bengali) হিসাবে গৌরব যেন আমাদের সহজাত উত্তরাধিকার। কিন্তু এর পাশাপাশি ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্রকে সমাজ সংসারের অংশীদার হয়ে এই আমরা কতখানি আঘাত দিয়েছি, তাঁর জন্মজয়ন্তীর দু’শো বছরে সে কথাও ভাবার বুঝি সময় এসেছে। আমাদের সহমর্মিতায় বিদ্যাসাগরের কিছু যায় আসবে না। কিন্তু এতে তাঁর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতাই আরেকটু বাড়বে। আর তখন, সমবেত সামাজিক পাপের দায়ভার থেকে কিছুটা মুক্ত হতে পারবেন আমাদের পূর্বপ্রজন্ম, মুক্ত হতে পারবে বর্তমানও।