আমাদের দেশে মাঝেমধ্যেই নির্বাচন পর্ব লেগে থাকার কারণে নির্বাচনী ফল বেরোলেই তাকে নিয়ে তড়িঘড়ি খুব সাহসী বা খুবই বোকা বোকা বিশ্লেষণ দেওয়ার রেওয়াজ আছে। এর ফলে অনেক সময়ই অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতটি ধরাই পড়ে না। তবুও নির্বাচনী ফলাফল বেরোবার দিনেই আমার নজরে পড়া লক্ষণগুলি আমি সামনে রাখছি। সাধ্যমতো যুক্তিও সাজাচ্ছি। দুটি রাজ্যই এই পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকছে।
(১) হরিয়ানায় বিজেপির ফলাফলে স্পষ্ট সেখানকার জাঠ ভোট এককাট্টা হয়ে দলের বিরুদ্ধে গেছে। ২০১৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ৩৩.২ শতাংশের চেয়ে এবারে দলের ভোট বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬.২ শতাংশ হয়েছে। অথচ দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হলো। এর কারণ জাঠেরা পুরনো জাত-পাতের হিসেব মেনে পঞ্জাবি মনোহরলাল খট্টরকে সরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
(২) মহারাষ্ট্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আসনের সঙ্গে জেতা আসনের অনুপাতে বিজেপির সাফল্যের হার বেড়েছে। ২০১৪ সালে অনেক বেশি—১৬৪টি আসনের মধ্যে ১০৫টিতে জয় পেয়েছে। সাফল্য হার ৭০ শতাংশ। সে সময় জোটসঙ্গী শিবসেনা আলাদা লড়েছিল। অবশ্য এই নির্বাচনে বিজেপি ও শিবসেনা উভয়েরই প্রাপ্ত ভোট শতাংশ অল্প হলেও ২ শতাংশের আশপাশে কমেছে। অবশ্যই ভোটের হারের এই হ্রাস পাওয়াকে কখনই শাসক জোটের বিরুদ্ধে কোনো বড়োসড়ো সুইং হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। কেননা বিজেপি-শিবসেনা এই দু’দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যতটানাপোড়েনই থাক না কেন সরকার গঠন করার প্রশ্নে তারা পর্যাপ্ত স্বস্তিদায়ক সংখ্যায় রয়েছে। হরিয়ানার ক্ষেত্রেও বিজেপিই এককভাবে সব থেকে বড়ো দল।
(৩) আজকাল রাজ্য নির্বাচনের ফলাফল ও কেন্দ্রীয় নির্বাচনের ফল প্রায়শই সম্পূর্ণ আলাদা হচ্ছে। সে কারণে কোনো রাজ্য নির্বাচনের জনাদেশকে রাষ্ট্রীয় নির্বাচনের ফলাফলের ইঙ্গিতবাহী বলে ভাবাটা অজ্ঞতারই নামান্তর। আমরা কয়েকমাস আগেই প্রত্যক্ষ করেছিরাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে ২০১৮ নভেম্বরে বিজেপি ক্ষমতা হারালেও কয়েকমাসের মধ্যেই এ বছর মে মাসে লোকসভা নির্বাচনে এই তিনটি রাজ্যেই মানুষ বিপুল ভোটে বিজেপিকেই নির্বাচিত করেছে। একই ভাবে ২০১৭ সালে গুজরাট বিধানসভার ক্ষেত্রেও বিজেপির আসন কমলেও লোকসভার ক্ষেত্রে অন্য দলগুলি খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। ওড়িশার নির্বাচন লোকসভার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে হলেও লোকসভায় বিজেপি যে সাফল্য পেয়েছিল বিধান সভায় আসনসংখ্যা তার অনুপাতে অনেক কম। সেখানে প্রাদেশিক বিজু জনতা দলই চমকপ্রদ সাফল্য বজায় রাখে। আবার দেখুন কর্ণাটকে ভোটদাতারা বিজেপিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি। কংগ্রেস ও জনতা দল (এস)-এর বিষম জোট বেশি দিন টেকেনি সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভায় কর্ণাটকেও বিজেপি তুমুল সাফল্য পায়।
এই উদাহরণগুলি থেকে এটা সহজেই বোঝা যায় না কি যে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার সাম্প্রতিক ফলাফল সেখানকার স্থানীয়। বিষয়ভিত্তিক ছাড়া অন্য কিছু নয়? যেমন মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিক্ষুব্ধ মানুষদের সেখানকার বিজেপি নেতৃত্ব সফলভাবে শান্ত করেছিল। কিংবা হরিয়ানায় জাঠদেরও বেশি আন্দোলনমুখী হতে দেয়নি। শুধু তাই নয়, হরিয়ানা মন্ত্রীসভার ৭ জন মন্ত্রীর পরাজয়ই প্রমাণ করে সেখানকার স্থানীয় অসন্তোষ কতটা বাড়ছিল।
তাহলে আমি জাতীয় স্তরে অর্থনীতির দশা নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিলাম এই উদাহরণগুলি সবই তো তাহলে তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। জাতীয় সমস্যাগুলি কি তাহলে রাজ্য নির্বাচনে কোনো রেখাপাতই করেনি? অর্থনীতির নিম্নগতি কি তাহলে আদৌ কোনো সাবধানবাণী দিচ্ছে না?
(১) মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার নির্বাচনের প্রাক্কালে কংগ্রেস ছিল সম্পূর্ণ ছন্নছাড়া অবস্থায়। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের মতো তারকা প্রচারক ও ভোট বিশেষজ্ঞের জুড়ি একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এমন একটা পরিস্থিতিতেও হরিয়ানায় বিরোধী হিসেবে যে সংখ্যাটা কংগ্রেসের এসেছে স্থানীয় নেতৃত্বকে আরও আগে সক্রিয় করলে পরিণামে হেরফের হলেও হতে পারত। মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে প্রচারে খুঁজেই পাওয়া যায়নি।
(২) দু’ রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি অর্থনীতির প্রসঙ্গ প্রায় তোলেইনি। এর সঙ্গে জড়িত অনুষঙ্গগুলিও উত্থাপিত হয়নি।
দলের নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জাতীয়তাবাদ ও পূর্ণ কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির ওপর সমগ্র গুরুত্ব আরোপ করা। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রীর কিষাণ যোজনাকে যাতে আরও বেশি কৃষকেরসঙ্গে জোড়া যায় সেদিকে নজর দেওয়া। দ্বিতীয়ত, জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ বিলোপজনিত কারণে জাতীয় স্তরে যে প্রভাব পড়েছে তার পূর্ণ প্রচার করা।
এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বেআইনি অনুপ্রবেশকারী সংক্রান্ত নীতি নিয়ে সরকারের মনোভাব ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এন আর সি) নিয়ে প্রচার। সর্বশেষ যথাযোগ্য কারণে বীর সাভারকরকে ভারতরত্ন দেওয়ার প্রসঙ্গটিও সংযোজিত হয়। এই চতুর্মুখী ফলা যে কোনো বিরোধী পক্ষের মোকাবিলায় নিশ্চিত ভাবে পর্যাপ্ত বলেই মানতে হবে। সেই অনুযায়ী একটি ছাড়া তাও (কেবলমাত্র হরিয়ানার ক্ষেত্রে) সকলেই দলকে সন্দেহাতীতভাবে বড়ো জয়ের দাবিদার বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু প্রত্যাশিত বড়ো সাফল্য না পাওয়ার পেছনে একটা কারণ যে অত্যন্ত সন্তর্পণে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল সেটা এড়িয়ে গেলে চলবে না।
(৩) সেই সঙ্গোপনে অগ্রসর হওয়ার কারণটি কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশের অর্থনীতিরও স্তিমিত হয়ে পড়া। ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়াকে তাই এড়ানো যায়নি।
ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে মহারাষ্ট্রের অর্থনীতির পরিমাণই সবচেয়ে বৃহৎ। হরিয়ানা ছোটো রাজ্য হলেও দেশের মধ্যে বহরে ১৩তম অর্থনীতি। মাথাপিছু আয়ের হিসেবে হরিয়ানা পঞ্চম। দুটি রাজ্যেই ভালো পরিমাণ শিল্পোদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট গ্রামীণ অঞ্চলে বাস করা মানুষজনও রয়েছেন। অর্থনীতির নিম্নগতি সমস্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ীই শহর ও গ্রামীণ উভয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ওপরই প্রভাব ফেলেছে। গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে ভোগ্যপণ্যের চাহিদায় বড়ো ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রদু’টি রাজ্যের গ্রামাঞ্চলেই বিজেপির নির্বাচনী ফলাফলে এর প্রতিফলন দেখা গেছে। যে কারণে অর্থনীতির শ্লথ গতির নির্বাচনী ফলাফলের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই বলাটা নেহাতই বীরত্বব্যঞ্জক কাজ ছাড়া কিছু নয়।
(৪) একটু অন্যভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলে এমনটা কি বলা যায় না যে স্থানীয় বিষয়গুলি যতটা প্রকটভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে গেছে তার অনেকটাই অর্থনীতির নিম্নমুখীর কারণে। যদি সর্বভারতীয় অর্থনীতি ক্ষেত্রের পরিস্থিতির চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকত তাহলে হরিয়ানার জাঠেরা বা মহারাষ্ট্রের স্থানীয় বিষয়গুলির অভিঘাত হয়তো গ্রামাঞ্চলে বিজেপির ফলাফলকে কম প্রভাবিত করত।
(৫) পরিশেষে বলা যায়, পূর্বাভাস না মেলার আশা করলেও জিডিপি-তে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির আগাম ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে সেটাই আমাদের লক্ষ্য পূরণের পক্ষে যথেষ্ট নয়। ২০২০ অর্থনৈতিক বর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের পরিসংখ্যান এখনও আসেনি। তবুও অর্থনীতির হিসেবে গড়ে বছরে ৮ শতাংশ টানা বৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলে তবেই সামগ্রিক সমৃদ্ধিকে ছোঁয়া যাবে। না হলে ৫শতাংশ বৃদ্ধির পড়ার সম্ভাবনা। এর প্রভাব নির্বাচনী ফলাফলে কোনোনা সময়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। হরিয়ানা মহারাষ্ট্রের ফলাফল দলকে অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে বলছে।
শৌভিক চক্রবর্তী
2019-11-01