১৮৯৭ সাল!ইংল্যান্ড থেকে জাহাজ এসে ভারতে পৌছালো। সেই জাহাজ থেকে নেমে এলেন সিংহিনীর মতো তেজ, প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এক আইরিশ নারী। আইরিশ কিন্তু তার কথাবার্তায় ভারতের চিত্র ফুটে উঠেছিল। সেই নারী হলেন স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা।তার মধ্যে বহু সত্তা বিরাজমান ছিল। তার বৈপ্লবিক সত্ত্বাটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
ভগিনী নিবেদিতা ভারতে আসা মাত্রই স্বামীজীর কথা অনুযায়ী ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ পড়তে শুরু করলেন। নিবেদিতা অবাক হয়ে গেলেন যে, ভারতের প্রাচীনকাল থেকে এত গৌরব থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে ভারতের চরম দুর্দশা কেন?তিনি নিজেই অনুভব করলেন এর একমাত্র কারণ হলো পরাধীনতা। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভারতমায়ের শৃঙ্খল মোচনে অঙ্গিকারবদ্ধ বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করতে।
অনুশীলন সমিতি নামক গুপ্ত সমিতির সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতার নিবিড় সংযোগ ছিল। তিনি সর্বতোভাবে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন। ড. নিমাই সাধন বসু বলেছেন, অরবিন্দের ভবানী মন্দির’-এর ওপর নিবেদিতার কালী দ্য মাদার’ বইয়ের প্রভাব ছিল। অরবিন্দ ঘোষের ‘ভবানী মন্দির’ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে বিপ্লবী আন্দোলনের পথে চালিত করতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, বিপ্লবীদের শক্তিসাধনায় এবং অরবিন্দের চিন্তায় কালী দ্য মাদার বইয়ের প্রভাব ছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার নিবেদিতার সম্বন্ধে তাঁর History of freedom movement'(১ম খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন। যে, অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সতীশ চন্দ্র বসু নিবেদিতার কাছে নির্দেশ পেয়েছিলেন। ভগিনী নিবেদিতা অনুশীলন সমিতির প্রথম বিপ্লবী পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দের দেহান্ত হয়। তার আগে বিখ্যাত জাপানি লেখক ও গবেষক ওকাকুরা ভারতে আসেন। ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। নিবেদিতা তার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন যে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে কীভাবে আরও জোরদার করা যায়। ১৯০৫ সালে বড়োলাট কার্জন বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করলেন। তার ফলে সারা বঙ্গদেশ উত্তাল হয়ে উঠল। এরপর কার্জন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। তিনি ভাষণে বলেন যে, ভারতীয়রা মিথ্যাবাদী। সেই অনুষ্ঠানে বিদ্বান ভারতীয়দের সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতাও উপস্থিত ছিলেন। এই কথা শুনে ক্ষোভে, রাগে, লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে ওঠে। নিবেদিতা বেরিয়ে যান এবং স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে একটি লাইব্রেরিতে যান সেখান থেকে একটি বই বের করে দেখান যে কার্জন কত বড়ো মিথ্যাবাদী। পরেরদিন স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখেন যে, কার্জন যখন কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন তখন তিনি মিথ্যা বলে নিজের বয়স কমিয়ে ছিলেন। তিনি রামায়ণ মহাভারত থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতীয়দের সত্যবাদিতা প্রমাণ করেছিলেন। যা তৎকালীন কোনো ভারতীয় নেতা করতে পারেননি। কারণ, ভগিনী নিবেদিতা ভারতের প্রতিমূর্তি ছিলেন। তাঁর কাছে ভারতবর্ষ ছিল পবিত্র ভূমি।
আমরা যদি লিজেল রেঁম-র কথা দেখি তাহলে দেখব তিনি বলেছেন যে, ভগিনী নিবেদিতা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের বিজ্ঞানাগারকে। বোমা তৈরির কাজে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারও বলেছেন। যে, “বিখ্যাত রাসায়নিক এবং যথার্থ বাঙ্গালি দেশপ্রেমিক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কীভাবে বোমা তন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতেন তা এক বিপ্লবীর স্মৃতিকথায় বর্ণিত আছে। ঢাকা অনুশীলন সমিতির নেতা পুলিনবিহারী দাসের সঙ্গে তার গোপন সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তিনি নিজের কয়েকজন বিশ্বস্ত ছাত্রের সঙ্গে বিস্ফোরক প্রস্তুতির ভার গ্রহণ করতে স্বীকৃত হয়েছিলেন।
ভগিনী নিবেদিতা বহু সময় তার ঘনিষ্ঠ মহল থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বহু বিপ্লবীকে ব্রিটিশরাজের রক্তচক্ষু থেকে বাঁচান। মডার্ন রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দের সম্ভাব্য গ্রেপ্তারের কথা জানতে পেরে নিজেই তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। নিবেদিতার সঙ্গে চরমপন্থী নেতা লালা লাজপত রায়ের যোগাযোগ ছিল। তিনি লিখেছেন যে, তার মুখ থেকে যে কথা শুনেছিলাম তা কখনো ভুলব না। ব্রিটিশ শাসন সম্বন্ধে তার দারুণ ঘৃণা এবং ভারতবাসী সম্বন্ধে তার প্রবল ভালোবাসা। ভগিনী নিবেদিতা ব্যক্তিগতভাবে চরমপন্থী ও বিপ্লববাদী আদর্শে আদর্শান্বিত হলেও তিনি কখনো নরমপন্থী বা মধ্যমন্ত্রীদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করেননি। কারণ, তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা। যেসব ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছিলেন সে চরমপন্থী হোক বা নরমপন্থী হোক নিবেদিতা তা না দেখে নির্দ্বিধায় তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন।
দীনেশচন্দ্র সেন একজন রাজভক্ত সাহিত্যিক ছিলেন, কিন্তু তিনি দেশের জন্য প্রচুর কাজ করেছিলেন। তার সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতার সুসম্পর্ক ছিল। নিবেদিতা তাকে বলেছিলেন যে, “দীনেশবাবু আপনার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমার মতের ঘোর অনৈক্য। যখন। সেদিক দিয়ে আপনার কথা ভাবি, তখন। আপনার কাপুরুষতা আমাকে শুধু লজ্জা নয়, মর্মপীড়া দান করে; কিন্তু তবুও আমার আপনাকে ভালো লাগে। কেন শুনবেন? আপনি বিনা আড়ম্বরে দেশের জন্য এতটা খেটেছেন ও দেশের উপর এতটা মমতার পরিচয় দিয়েছেন যে, আপনার অজ্ঞাতসারে আপনি প্রকৃত দেশভক্তের দাবি করবার যোগ্যতা রাখেন।” এর থেকে বোঝা যাচ্ছে ভগিনী নিবেদিতা কতটা দুরদর্শী নারী ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন ভারতবাসী যদি ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাহলে ভারতবর্ষ অচিরেই স্বাধীনতা পাবে। নিবেদিতা নরমপন্থী নেতা গোখলে, উপেন্দ্রনাথ বসু আনন্দমোহন বসু প্রমুখের সঙ্গে বন্ধু ত্ব রেখেছিলেন। ভগিনীর এসব কর্মকাণ্ডের জন্য ব্রিটিশ সরকার গোয়েন্দা দিয়ে তার পেছনে নজরদারি চালাতে থাকে। এমনকী বিভিন্ন প্রমাণ থেকে জানা জায় যে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা ও তার দীর্ঘ কারাবাসেরও সম্ভাবনা ছিল।নিবেদিতা গ্রেপ্তারি এড়াতে একাধিকবার ছদ্মবেশ ধারণ করেন। এমনকী ভারতের ফরাসি অধিকৃত স্থানগুলিতে আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।
ভগিনী নিবেদিতা বৈপ্লবিক বক্তব্য ছাপাবার জন্য গোপন প্রেসের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। তিনি বিপ্লবীদের সাহায্যের জন্য বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র আনারও ব্যবস্থা করতেন। নিবেদিতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি চিঠিতে মিস ম্যাকলাউডকেলিখেছিলেন যে, “ভারতের জন্য আমি কিছুই করছি না, আমি শিখছি আর তড়িৎ স্পর্শে শিউরে জাগছি। কীভাবে চারা গাছ বেড়ে ওঠে, তাই দেখতে চাইছি। সেটা বুঝে উঠতে পারলেই মনে হয় আমি জানব যে, ওটিকে রক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার দরকার নেই। ভারত জ্ঞানসাধনায় নিমগ্ন ছিল, সেই সময় একদল ডাকাত তার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে তার ভূসম্পত্তি ধ্বংস করেছে। ফলে ভারতের তন্ময় ভাবনষ্ট হয়ে গেছে। ডাকাতের দল তাকে শেখাবে? না! ডাকাতদের খেদিয়ে দিয়ে ভারতকে ফিরে যেতে হবে স্বভূমিতে। এখন এই ধরনের প্রচেষ্টাই ভারতের পক্ষে যথার্থ কার্যক্রম। সুতরাং, যতক্ষণ সরকার বিদেশি ততক্ষণ খ্রিস্টান (মিশনারি) বা সরকারের তাবেদারদের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া নয়…” এই ধরনের আগুনে লেখা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা লিখতে পারেননি যা নিবেদিতা দৃঢ় ভাবে লিখেছিলেন।
ভগিনী নিবেদিতা ১৯০২ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ভারতের নানা স্থানে ঘুরে বক্তৃতার দ্বারা ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।তিনি এক জায়গায় বলেন যে, “How long 0 Lord-how long? oh if Mother would give me’ strength like the Thunderbolt’ and words with unspoken menace in them and weight of utterance” ভগিনী নিবেদিতা ভারতকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে ভারতীয় ঐতিহ্য, দর্শন, ধর্মকে পুনর্জীবিত করতেই শক্তির আরাধনা করেছিলেন। ভারতীয়দের উদ্দেশে তার আহ্বান “হে ভারত ! তোমার সন্তানগণের মধ্যে যারা সর্বাপেক্ষা সাহসী, তীক্ষ্ণ অনুভূতিসম্পন্ন এবং শ্রেষ্ঠ তাদের ওপর এই যে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ অপমান বর্ষিত হচ্ছে— কে তার একটিরও প্রায়শ্চিত্ত করবে বলো? তিনি আরো বলেন যে, “জীবন-জীবন-জীবন আমি জীবন চাই! আর জীবনের একমাত্র প্রতিশব্দ স্বাধীনতা। তা না থাকলে মৃত্যুও শ্রেয়।” নিবেদিতা দশেরার সময়ে নাগপুরে যান। ওখানকার স্থানীয় মরিস কলেজের কর্তৃপক্ষ একটি সভার আয়োজন করেন। সভার আয়োজকরা ঠিক করেন সভার সভানেত্রী পদ অলংকৃত করবেন ভগিনী নিবেদিতা এবং উত্তম ক্রিকেটারদের হাত দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। ভগিনীকে সভানেত্রী হওয়ার কথা বলা হয় তিনি রাজিও হন কিন্তু তাকে পুরস্কার প্রদানের কথা বলা হয়নি। সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। দশেরার পূর্বদিনে ‘অস্ত্র পূজার’ দিনে। ভগিনী বিস্মিত হলেন এই ভেবে যে, অস্ত্র পূজার দিনে ভারতীয়রা বিদেশি খেলা খেলে গৌরব কুড়ানোর চেষ্টা করছে। তিনি তীব্র ভাষায়। ভৎর্সনা করে বললেন, “আমরা কীভাবে দেবী দুর্গাকে ভুলে গেলাম— তার খঙ্গকে তাঁর শক্তির বাণীকে !! তিনি আশা করেছিলেন মারাঠা বীরত্বের কিছু চিহ্ন দেখতে পাবেন এই অনুষ্ঠানে। তিনি পরেরদিন তরবারি খেলা, মল্লযুদ্ধ প্রভৃতি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এইভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভারতীয়দের সুপ্তবীর্যবান সত্ত্বাকে জাগ্রত করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ভগিনী কংগ্রেসের বেনারস অধিবেশনে অংশ নেন। তিনি সেখানে নেত্রী হিসেবে ভাষণ দেননি; ধরিত্রী যেমন গাছকে নানা উপকরণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে আর ধাত্রী যেমন ছোটো শিশুকে বড়ো করে তোলে ঠিক তেমনি ভগিনী নিবেদিতাও ধরিত্রী ও ধাত্রীর ভূমিকা নেন। তিনি ওই অধিবেশনে ভারতের জাতীয় পতাকা কী হবে তার একটি পরিকল্পনা দেন। তাঁর অঙ্কিত পতাকা ছিল রক্তাভ বর্ণের এবং মাঝে বজ্র চিহ্ন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ত্যাগের সঙ্গে বজের মতে বীর্যবান সত্তা চাই।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদানকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না কিন্তু আমরা ভারতীয়রা এতটাই আত্মবিস্মৃত জাতি যে, তাঁর অবদানকে আমরা প্রকৃত সম্মান, ভারতের স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও দিতে পারিনি। আসুন আমরা সবাই মিলে ভগিনী নিবেদিার ১৫২তম জন্মবার্ষিকীতে এই মহা মানবীর স্বপ্নের ভারতবর্ষ গঠনে ব্রতী হই।
সাগ্নিক বন্দ্যোপাধ্যায়
(ভগিনী নিবেদিতার জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত)
2019-11-01