কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ আমাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লিখেছেন। যাতে আছে আমাদের বিচারব্যবস্থার কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপরামর্শ।
শ্ৰী গগৈ জানিয়েছেন, আমাদের দেশের বিভিন্ন আদালতে মামলার পাহাড় জমে রয়েছে। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ গতিতে বেড়ে চলেছে বকেয়া মামলার সংখ্যা। তার হিসেবে শুধু সুপ্রিম কোর্টেই বকেয়া মামলা আছে ৪৮,৬৬৩ টা, আর বিভিন্ন হাইকোর্ট ও অন্যান্য আদালতও একই ভাবে অমীমাংসিত মামলায় ভারাক্রান্ত। তিনি আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন কোর্টে হাজার খানেক মামলা জমে আছে ৫০ বছর ধরে, আর ২৫ বছরের পুরনো মামলার সংখ্যা অন্তত ২ লাখ।
সুতরাং বলা চলে— আমাদের বিচার-ব্যবস্থা প্রায় ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ অনেক। কিন্তু তার মতে, এর প্রধান কারণ হলো বিচারকের অভাব, প্রায় সব আদালতই এই সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। প্রধানত প্রয়োজনের তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অনেক কম। হওয়ার ফলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অগণিত বিচারপ্রার্থীকে।
এই কারণে তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন— (১) সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতির সংখ্যা অবিলম্বে বাড়ানো হোক;
(২) হাইকোর্টের বিচারপতিদের কার্যকাল বৃদ্ধি করে অবসরের বয়স করা হোক ৬৫; এবং
(৩) উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত কিছু বিচারপতিকে সাময়িক কালের জন্য পুনর্নিযুক্ত করা হোক।
তার মতে, এতে বকেয়া মামলাগুলোর যেমন দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে, তেমনি নতুন মামলার বিচারের কাজও করা যাবে যথাসময়ে।
আমরা মনে করি, প্রস্তাবগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সরকারের উচিত এই সব নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া।
প্রথমত, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সংখ্যা অবশ্যই বৃদ্ধি করা দরকার। অবশ্য আগে ১৯৮৮ এবং ২০০৯ সালে সংখ্যাটা বাড়িয়ে করা হয়েছিল যথাক্রমে ২৮৬ ও ৩১। এটা অবশ্যই জররি ছিল এবং পদক্ষেপটা ছিল গুরত্বপূর্ণ। কারণ মূল। সংবিধানে সংখ্যাটা ছিল মাত্র ৮। কিন্তু শ্রী গগৈ সঙ্গত কারণে মন্তব্য করেছেন— যেভাবে মামলার সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলেছে, তাতে বর্তমান ব্যবস্থাটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সংখ্যা না বাড়ালে বর্তমানের ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, তাঁর মতে, হাইকোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সও বৃদ্ধি করা দরকার। মূল সংবিধানে সেটা ছিল ৬০। কিন্তু ১৯৬৩ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে সেটা করা হয়েছিল ৬২।
তবে শ্রী গগৈ মনে করেন, এখন উচিত সেটা ৬৫ করা। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সের মতো। তাতেও মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির সমস্যাটা কিছু লাঘব হবে।
তৃতীয়ত, তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন— সংবিধানের ১২৮ ও ২২৪ নং অনুচ্ছেদ প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কিছু বিচারপতিকে সাময়িক কালের জন্য নিযুক্ত করার ব্যবস্থা রেখেছে। তার মতে, সেই সুযোগটা এই সঙ্কটকালে কাজে লাগানো দরকার। এইভাবে কিছু প্রবীণ বিচারপতিকে সাময়িক ভাবে টেনে আনা গেলে বকেয়া মামলার মীমাংসা করা সহজ হবে। তার মতে, এটা পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রস্তাবের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।
আমাদের মনে হয়— যদি তার পরামর্শমতো বিভিন্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে, তাহলে আর বকেয়া মামলার পাহাড় জমে উঠবে না।
পঞ্জাব হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচার পতি জি.ডি. খোলা মন্তব্য করেছিলেন, The slow movement of cases results in the accumulation of arrears which causes further delay, producing a snow-balling effect i অর্থাৎ মামলার শ্লথগতিতে সেগুলো জমে যায়, আর ইতিমধ্যেই নতুন মামলাগুলো এসে সমস্যাটাকে বাড়িয়ে তোলে। আমাদের ‘ল-কমিশন’ জানিয়েছে যে, বছরে যে মামলাগুলো ওঠে, তার মাত্র ৩৭ শতাংশ মীমাংসিত হয়,বাকিগুলো থেকে যায়, আর তার মধ্যেই নিত্যনতুন মামলা চলে আসে। এভাবেই বকেয়া মামলার পাহাড় জমে বিভিন্ন আদালতে। এতে অগণিত মানুষের হয়রানি, দুর্ভোগ, উদ্বেগ ও অর্থদণ্ড দীর্ঘস্থায়ী হয়। টেনিসনের ‘দ্য ব্রুক’ কবিতায় আছে— নদী বলছে—man may come and man may go but I go on forever i’coala বিচারক বদলি হন, উকিল অবসর নেন, ফরিয়াদি মারা যান, কিন্তু অনেক সময় মামলা চলতে থাকে। এই কারণে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি পি.এল. ভগবতী একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘Our judicial system is crashing under the weight of arrears।
অবশ্যই বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতাই এর একক কারণ নয়। আসলে আমাদের বিচার ব্যবস্থাটাই সেকেলে, ব্রিটিশ পদ্ধতিটার কোনও সংশোধন বা আধুনিকীকরণ হয়নি। তার মন্থর গতিকে দ্রুতগামী করার কোনও চেষ্টা করা হয়নি এতদিন।
তাছাড়া পদ্ধতিটা এমনিতেই কিছুটা মন্থর হওয়ার কথা। বিচারপতি দুই পক্ষের সওয়াল জবাব শোনেন, দলিলপত্র পরীক্ষা করেন, সাক্ষীদের বয়ান পর্যালোচনা করেন এবং তারপর ধীরে-সুস্থে রায় ঘোষণা করেন। সুতরাং কিছু সময় এই কাজে লেগে যাবেই। কিন্তু যদি বিচার প্রক্রিয়া অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক শ্লথগতিসম্পন্ন হয়, তাহলে অগণিত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। কথায় বলে— “Justice delayed is justice denied. I’
আরও বলা দরকার— আমাদের বিচার-ব্যবস্থাটা কেন্দ্রীভূত ও অখণ্ড—তার শীর্ষে আছে সুপ্রিম কোর্ট। সুতরাং অনেক মামলা নিম্ন আদালত থেকে ধাপে ধাপে। ওঠে। কিন্তু তার প্রত্যেক স্তরেই রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা, গতিমন্থরতা ও অর্থদণ্ড।পি.এন. ভগবতী মন্তব্য করেছেন, the liytigants have to pass through the labyrinth of one court to another until their patience gets exhausted। এই কারণে অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মুখ গুঁজে অন্যায়-অবিচার সহ্য করেন, কিন্তু কোর্টে যান না। কারণ প্রবাদ বলে— going to court is to sell the cow for a hen।’
অথচ বিচারবিভাগের প্রাথমিক কাজই হলো প্রত্যেকের জন্যে সহজে, সুলভে ও দ্রুত গতিতে ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্রীয় জীবনে নানা ধরনের বিপদ দেখা দেয়। বিশেষ করে এই দেশে জনসংখ্যার স্ফীতি, সামাজিক জটিলতা, সম্পর্কের সঙ্কট, অধিকার – সচেতনতা ইত্যাদি কারণে দ্বন্দ্ব-বিবাদ বেড়ে চলেছে। তার সুষ্ঠু ও শান্তি পূর্ণ মীমাংসা করাই আদালতের প্রাথমিক কর্তব্য। কিন্তু ব্যয়বাহুল্য, শ্লথগতি, জটিলতা যদি বিচার ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয়, তাহলে বহু মানুষের জমে থাকা ক্ষোভ ও ক্রোধ রক্তাক্ত হানাহানিতে পরিণত হতে বাধ্য। এই কারণেই দরকার একটা সুষ্ঠু বিচার বিভাগের প্রতিষ্ঠা।
আমরা আইনের শাসনের কথা বলি। কিন্তু এই অব্যবস্থা চিরদিন চলতে পারে না। একটা সহজ, সুলভ ও গতিসম্পন্ন বিচারব্যবস্থা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই হবে। তা না হলে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটা প্রহসনে পরিণত হবে।
কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পি. বি. মুখার্জি মন্তব্য করেছেন, the language of law and the procedures of the courts must not be so exclusive, as to prevent access of common man।’
সুতরাং বিচারব্যবস্থার সংস্কার সাধন করতেই হবে নিতে হবে বিভিন্ন ব্যবস্থা। তবে শুরু করা হোক বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি দিয়ে।
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত
2019-11-01