পুরুলিয়ায় একটি সংস্থার গয়নার শোরুমে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতারির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে পাঁচ। তবে পুলিশের দাবি, এই ডাকাতির মূলচক্রী ইতিমধ্যে জেলের ঘানি টানছে। তার কষে দেওয়া ছকে ডাকাতি করতে একত্রিত হয় পড়শি দুই রাজ্যের দল। তাদের কেউ ছিল ভাল শুটার। কারও কাজ ছিল শুধু ‘রেইকি’ করা। কারও দায়িত্ব ছিল পুরো অপারেশন সন্তর্পণে হয়ে যাওয়ার পর দলের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। পুরুলিয়া ডাকাতিকাণ্ডে সোমবার আরও তিন ডাকাতকে গ্রেফতারের পর এমনটাই জানাল জেলা পুলিশ।
গত ২৯ অগস্ট দুপুরে প্রায় একই সময়ে একই সংস্থার দুই ভিন্ন জেলায় গয়নার শোরুমে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। দুটো শোরুম থেকেই প্রচুর নগদ টাকা এবং গয়না লুট হয়। নদিয়ার রানাঘাটে ডাকাতির পর পরই চার ডাকাতকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে গ্রেফতার হয় মূলচক্রী অর্থাৎ ‘ডাকাত সর্দার’ কুন্দন সিংহ। কিন্তু পুরুলিয়ায় ডাকাতির পর ডাকাতদলকে ধরতে বেশ কিছুটা সময় নিয়েছে পুলিশ। প্রথমে গ্রেফতার করা হয় করণজিৎ সিংহ সাধু এবং বিকাশ কুমারকে। সোমবার ওমপ্রকাশ প্রসাদ, ডব্লিউ সিংহ এবং অজয় যাদব নামে আরও তিন জনকে পাকড়াও করেছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে লুটের নগদ টাকা এবং গয়নাগাটি মিলিয়ে প্রায় কোটি টাকার সম্পত্তি উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ।
পুরুলিয়া জেলা পুলিশ মনে করছে, ওই ডাকাতদলের সঙ্গে আরও কয়েক জন যুক্ত রয়েছে। যে ভাবে ওমপ্রকাশকে বিহার, ডব্লিউকে হাজারিবাগ এবং অজয়কে ছতরা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তেমনই বাকিদের পাকড়াও করার ব্যাপারে জেলা পুলিশ আত্মবিশ্বাসী। পুলিশের দাবি, পুরুলিয়ার ডাকাতির নেতৃত্বে ছিল ওমপ্রকাশ। তবে আসল ছক ছিল অন্য কারও। সে ইতিমধ্যে জেলেই রয়েছে। সেখান থেকে যোগাযোগ করে পুরো ডাকাতির নেতৃত্ব দেয় সে। তদন্তের স্বার্থে ওই ‘ডাকাতসর্দারের’ নাম এখনই প্রকাশ্যে আনছে না পুলিশ। তবে তারা এ-ও জানাচ্ছে, পুরুলিয়া এবং রানাঘাটের ডাকাতির সঙ্গে ডাকাতদলেরও মিল আছে। এ ব্যাপারে কুন্দন-যোগও রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ সূত্রে খবর, গত ২৯ অগস্ট ডাকাতি হলেও ভিন্রাজ্যের ওই ডাকাতদল বেশ কয়েক দিন আগে পুরুলিয়ায় ঢোকে। তারা হোটেল ভাড়া করে ছিল। হোটেল ভাড়া দিত ওমপ্রকাশ। বস্তুত, পুরুলিয়ার ডাকাতিতে শারীরিক ভাবে সে-ই নেতৃত্ব দিয়েছিল। ওই ডাকাতদলের এক এক জনের দায়িত্ব ভাগ করা ছিল। যেমন, ডাকাতির আগে ১০-১২ দিন এলাকা রেইকি করার ভার ছিল ওমপ্রকাশের উপরে। ধৃত ডব্লিউ আবার ‘প্রযুক্তিগত’ দিকটা দেখত। ডাকাতির আগে এবং পরে কোন কোন নম্বর থেকে কে কাকে ফোন করবে, ডাকাতির পর দলের এক এক জনের ফোনের সিম পাল্টে ফেলা এবং অন্য সিম ব্যবহার করার পরামর্শ এবং জোগাড়— সবই ডব্লিউর। এমনকি, ডাকাতির পর যে বাইক নিয়ে চম্পট দেয় তারা, সেটার জোগাড়ের দায়িত্বেও ছিল এই ডব্লিউ।
পুলিশ জানাচ্ছে, ২৯ অগস্ট গয়নার শোরুম লুটের পর নগট টাকা এবং গয়না ছিল ডব্লিউর কাছে। পরে সেটা যায় অজয়ের হাতে। সেখান থেকে আবার হাতবদল হতে হতে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। লুটের মাল বিক্রি হয় বাংলা, ঝাড়খণ্ড এবং বিহারে। আরও কোথাও কোথাও বিক্রি হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘ইতিমধ্যে লুটের প্রায় এক কোটি টাকার জিনিস উদ্ধার হয়েছে। আরও অল্প কিছু থাকতে পারে। আমরা সেগুলোও উদ্ধার করব। এই ডাকাতিতে আরও বেশ কয়েক জন আছে বলেই আমাদের অনুমান। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই তা স্পষ্ট হবে।’’
বিভিন্ন সূত্র মারফত খোঁজখবর তো ছিলই। তবে এই পাঁচ ডাকাতকে পুলিশ ধরেছে মূলত ‘কল ডাম্ব অ্যানালিসিস’ করে। ওই ডাকাতির সময় সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভিন্ রাজ্যের কতগুলো নম্বরের ফোনে কথা হয়, সেটা প্রথমে ট্র্যাক করে পুলিশ। সেই নম্বরগুলো থেকে কোথায় কোথায় ফোন করা হয়েছে, তাতে নজর দেন তদন্তকারীরা। ওই সিমগুলো যে মোবাইলে ব্যবহার করা হয়, তার আইএমআর নম্বর ট্র্যাক করা হয়। ডাকাতির অপারেশন শেষে ওই মোবাইল ফোনগুলিতে নতুন যে সিম কার্ড ব্যবহার হয়, তার টাওয়ার লোকেশন ট্র্যাক করতেই কেল্লাফতে। ধরা পড়ে এই পাঁচ জন। এ নিয়ে পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘তদন্ত এখনও চলছে। আমরা পুরো দলটিকেই গ্রেফতার করব। আরও কয়েক জন আছে বলে মনে করা হচ্ছে।’’