একই দিনে ফাঁসি হয়েছিল নয়জন বাঙালি বিপ্লবীর, আমরা কি মনে রেখেছি তাদের আত্মত্যাগ ?
দেশজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব | স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তিতে তেরঙা আলোয় সাজছে গোটা দেশ | দেশকে স্বাধীন করতে নিজেদের প্রাণ দিয়েছিলেন বহু বিপ্লবী | আজ এই স্বাধীন দেশে কতজন মনে রেখেছে তাঁদের আত্মত্যাগ ? কতজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ইতিহাসের পাতায় ? আসুন আজ স্মরণ করি বাংলার নয় জন বিপ্লবীকে | আর নৌ বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাও একটু বদল করি |
ইতিহাস বইতে আমরা পড়েছি ১৯৪৪ এবং ১৯৪৬ সালে বোম্বেতে নৌ বিদ্রোহের সূচনা হয়। ভুল একদম ভুল। ১৯৪২ সালে কোচিনে চতুর্থ উপকূলরক্ষী বাহিনীর সেনারা শুরু করেছিলেন নৌ বিদ্রোহ। এই দুই নৌ বিদ্রোহের মূলগত তফাৎটাও মনে রাখা দরকার। বোম্বের নৌ বিদ্রোহ সূচনার মূল কারণ ছিল ভারতীয় নৌ সেনাদের নিম্ন মানের খাবার পরিবেশন, ইংরেজ অফিসারদের দুর্ব্যবহার ইত্যাদি। পরবর্তীকালে এই বিদ্রোহের রং বদলে যায় এবং রাজনৈতিক রূপ প্রকাশিত হয়। সাধারণ মানুষ নৌ সেনাদের পাশে দাঁড়ায় এবং সাধারণ মানুষদের ক্ষোভ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু ১৯৪২ সালের কোচিনের নৌ বিদ্রোহের পটভূমি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। কোচিনের বিদ্রোহী নৌ সেনাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল – ব্রিটিশ বাহিনীর ক্ষতি করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের ক্ষতি করে অক্ষশক্তিকে জেতবার সুযোগ করে দেওয়া। এই ইতিহাস মুছে দেওয়া হয়েছে |
১৯৪২ সালের কোচিনের নৌ বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন মানকুমার বসু ঠাকুর। ১৯১৫ সালের পর রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে সেনাবিদ্রোহের সম্ভাবনার পর দ্বিতীয় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল কোচিনের নৌ বিদ্রোহে | মানকুমার বসু ঠাকুরের নেতৃত্বে দুর্গাদাস রায়চৌধুরী ,কালীপদ আইচ, চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, নন্দকুমার দে, নিরঞ্জন বরুয়া, নীরেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, ফণিভূষণ চক্রবর্তী, আবদুল রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, অমল চন্দ্র দেব এই বিদ্রোহ সূচনা করে। সকলেই ছিলেন নেতাজি এবং রাসবিহারী বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত | তাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল – ব্রিটিশ বাহিনীর আনুগত্যের শিক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কঠোর শাস্তির ভয়কে উপেক্ষা করে স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করা। ১৯৪৩ সালের ১৮ এপ্রিল মানকুমার বসু ঠাকুর সহ সকল বিদ্রোহীরা ধরা পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মারাত্মক – তারা গোপনে শত্রুশিবিরে খবর পাচার করেছে, সঞ্চিত গোলা বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, সমুদ্রে অস্ত্র ফেলে দিয়েছে। ব্যাঙ্গালোরে হয় বিচারপর্ব। আসলে বিচারের নামে চলে প্রহসন। ফাঁসির আদেশ হয় নয় জনের – মানকুমার বসু ঠাকুর , দুর্গাদাস রায়চৌধুরী ,কালীপদ আইচ, চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, নন্দকুমার দে, নিরঞ্জন বরুয়া, নীরেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, ফণিভূষণ চক্রবর্তী। আবদুল রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অমল চন্দ্র দেবকে দেওয়া হয় ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একই দিনে এক সঙ্গে নয় জনের ফাঁসির ঘটনা আর কখনওই ঘটেনি।নয় জনই ছিলেন বাঙালি। মাদ্রাজ দুর্গে ১৯৪৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ফাঁসি হয়েছিল মানকুমার বসু ঠাকুর , দুর্গাদাস রায়চৌধুরী ,কালীপদ আইচ, চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, নন্দকুমার দে, নিরঞ্জন বরুয়া, নীরেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, ফণিভূষণ চক্রবর্তীর। এই ঘটনা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে এই ঘটনার কথা জানা যায়।
মানকুমার বসু ঠাকুর ছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রতুলচন্দ্র রক্ষিতের শ্যালক। তাঁর পিতা ভূপতিমোহন বসু ঠাকুর এবং মাতা হেমপ্রভা বসু ঠাকুর। মানকুমার বসু ঠাকুরের আদি নিবাস ঢাকা মালখানগার। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ঢাকা জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। পরিবারের অমতে কলেজ ছেড়ে ব্রিটিশ নৌ-বাহিনীতে যোগ তিনি। ভারতীয় উপকূল রক্ষা বাহিনীর ১৩ টি বিভাগীয় পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকার করেছিলেন তিনি | ফাঁসির পাঁচ দিন আগে, ১৯৪৩-এর ২২ সেপ্টেম্বর, মানকুমার জামাইবাবুকে লিখেছেন: “আমার চলে যাওয়ার সেই চরম মুহূর্ত এসেছে। আমি আপনার কাছে আমার বন্ধনমুক্ত আত্মার জন্য শুধু আশীর্বাদ চাইবো।… আমার আত্মার শান্তির জন্য আমি আপনাদের সকলের প্রার্থনা কামনা করছি।”
নয় জনের অন্যতম দুর্গাদাস রায়চৌধুরী মৃত্যুর কয়েক দিন আগে জেলখানায় বসে লিখেছিলেন একটি ‘খোলা চিঠি’: “আমাদের কেন ফাঁসি হইতেছে তাহা জানিবার জন্য আপনারা আগ্রহান্বিত। ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই ইহার কারণ।…আমরা বাঙালি সৈনিক। দেশের স্বাধীনতার আহ্বানে আমাদের নয়টি জীবনদীপ নির্বাপিত হইতে চলিয়াছে।”
২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ ভোরবেলায় এঁদের গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন ফাঁসুড়ে শিবু ডোম। পুরো নাম শিবলাল। তাঁর স্মৃতিচারণ: “সেদিন তেনারা খুব গান গাইছিলেন সবাই মিলে। যখন শেষ সময় এসে গেল, জোর গলায় বলতে লাগলেন জয় হিন্দ-জয় হিন্দ-জয় হিন্দ।” এই শিবলালই নয় বছর আগে, ১৯৩৪-এর ১২ জানুয়ারি, চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের গলায়।
আসুন আজ শ্রদ্ধা জানাই বাংলার এই নয়জন মহান বিপ্লবীকে |