ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সূর্যোদয় ও একজন বীর হাবিলদার রজব আলী খান
প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ বেনিয়াদের শাসন-শোষণ ও পরাধীনতাকে কাটিয়ে ভারতবর্ষে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু দেশমাতৃকার টানে যারা জীবন দেওয়ার জন্য ছিল সদা প্রস্তুত, তারা এই অসম্ভবতাকে পরোয়া করেনি কখনো। শত সহস্র বিপ্লবীর রক্ত বিলানো আত্মত্যাগের বিনিময়ে অকল্পনীয় স্বাধীনতার স্বাদ আমরা নিতে পারছি। বাংলার দামাল ছেলেরা প্রথম থেকেই ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরোদ্ধে লড়েছে। পথ দেখিয়েছে বিপ্লবের।
আজকে জানবো এমন এক অসম সাহসী বিপ্লবীর কথা। যার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরুপে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে পড়ে। টানা ৩০ ঘণ্টা চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে বঙ্গোপসাগরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন ব্রিটিশ বেনিয়াশক্তি।
মানুষের অগোচরে থাকা এমন এক সূর্যসন্তান হাবিলদার রজব আলী।
যাকে উৎসর্গ করে বাংলার বিখ্যাত কবি মোহিনী চৌধুরী রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কালজয়ী কবিতা:
“মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হল বলিদান
লেখা আছে অশ্রু জলে।”
হাবিলদার রজব আলীর জন্ম নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
অনেক ইতিহাস গবেষক ও বিশ্লেষকদের মতে, হাবিলদার রজব আলী সন্দ্বীপের আবার, কারো মতে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাইদগাঁও কিংবা আরো কয়েকজন গবেষকের মতে লোহাগাড়া এর চক্রশালা চট্টগ্রাম-এর অধিবাসী। তার জন্মসাল, পরিবার, বংশপরিচয় সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
হাবিলদার রজব আলী তরুন বয়সে সিপাহী হিশেবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বিদ্রোহের আগে ৪ নম্বর কোম্পানির হাবিলদার পদে উত্তীর্ণ হন এই বীর সিপাহি।
কোম্পানির সেনাবাহিনীর ৩৪ নম্বর নেটিভ বেঙ্গল পদাতিক বাহিনীর ১২০ জন হাবিলদার ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে পরহেজগার ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তি রজব আলী ছিলেন তাদের একজন। ক্যাপ্টেন পিএইচকে ডিউলের অধীনে চট্টগ্রাম পাহাড়তলী সংলগ্ন প্যারেড গ্রাউন্ডের সেনানিবাসে থাকতেন তিনি।
১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়াদের নানাদিক কূটচাল ও স্বদেশী জগৎশেঠ, মীর জাফরদের বিশ্বাসঘাতকতায় অস্ত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। বাংলার আপামর দেশপ্রমী জনতা মর্মন্তুদ,নির্মম ও বেদনাবিধুর এই ঘটনা কখনোই ভুলেনি। তাই তো ১৮৫৭ সালে দেশপ্রেমী সিপাহীরা শুরু করে পরিকল্পিত ভাবে ব্রিটিশ বেনিয়াদের থেকে স্বদেশমুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম। হাবিলদার রজব আলী ৩৪ নং নেটিভ বেঙ্গল পদাতিক বাহনীর বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রদান করেন, সাথে ছিলেন আরেক সিপাহী জামাল খান।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানে হাবিলদার রজব আলী পূর্ববঙ্গে বিপ্লবের সূচনা করেন। দেশপ্রেমে সমুজ্জ্বল প্রায় চারশত সিপাহী রজব আলীর নেতৃত্বে বন্দর নগরীর অস্ত্রাগার এবং কোষাগার দখল করেন। তারা ফেনী নদী অতিক্রম করে সীতাকু- হয়ে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। নোয়াখালী এবং কুমিল্লায় অবস্থানরত কোম্পানির শক্তিশালী বাহিনীকে এড়িয়ে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে রজব আলী ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যদিয়ে জটিল পাহাড়ি পথ বেয়ে ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন।
কলকাতার ব্যারাকপুরে ও বহরমপুরের বিদ্রোহ ছিলো বিচ্ছিন্ন। কিন্তু, চট্টগ্রামে সংঘবদ্ধ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন রজব আলী খাঁন। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে বিদ্রোহীরা গুলি ছুঁড়ে বিদ্রোহের জানান দেন। তারা প্রথমেই জেলের তালা ভেঙে আটক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুক্ত করে। বিদ্রোহের ডামাডোলে চট্টগ্রামে থাকা ব্রিটিশরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রে জাহাজে আশ্রয় নেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল মূলত ১২ নভেম্বর হতে। এবং তা পূর্ণতা লাভ করে ১৮ নভেম্বর রাতে।
হাবিলদার রজব আলী খানের নেতৃত্বে বিদ্রোহ বা বিপ্লব এতটাই তীব্র ছিল যে চট্টগ্রাম প্রায় ত্রিশ ঘন্টা বৃটিশ শাসনমুক্ত রাখা হয়েছিল। এই বিদ্রোহের সময় গুলি বিনিময়কালে একাধিক সৈনিক শাহাদাত-সুধা পান করেন। যাঁদের কবর দেয়া হয় ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের আঙ্গিনায়। পরে মসজিদ সম্প্রসারণের সময় তা সরিয়ে নেওয়া হয়।
তাঁরা ঢাকায় ৭৩ নম্বর দেশীয় পদাতিক বাহিনীর সাথে মিলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। সে মোতাবেক ১৯ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম পিলখানা থেকে হাতি নিয়ে সদলবলে ঢাকা রওনা হন। তবে কুমিল্লা ও নোয়াখালিতে শক্তিশালী ব্রিটিশ বাহিনী এড়াতে দুর্গম পার্বত্য ত্রিপুরা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ত্রিপুরার রাজার অসহযোগিতায় ছোট ছোট লড়াইয়ের মুখে পড়তে হয় তাদের।
এরই মধ্যে ২২ নভেম্বর সকালেই ঢাকার ৭৩ পদাতিক বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিতে শুরু করে ইংরেজরা। সরকারি খাজাঞ্চিখানার সিপাহীদের অস্ত্র কেড়ে নিলেও লালবাগ কেল্লায় প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় তারা। সামান্য জনবল আর রসদের বলেই প্রতিরোধের দুঃসাহস এই সিপাহীদের নির্মম পরিণতি ডেকে আনে। বুলেট আর বেয়নেটের আঘাতে অনেকেই নিহত হয়। দুর্গের পুকুরে তাদের ফেলে দেওয়া হয়। আর বন্দি যারা তাদের চকবাজার ও আন্টাঘরের ময়দানে গাছে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয় বেশ কয়েক দিন।
দেশীয় গাদ্দার ও বেঈমানদের চরম অসহযোগীতা ও বিরোধীতায় পরতে পরতে বিভিন্ন যুদ্ধের মুখোমুখি হন এসব দেশপ্রেমী বিপ্লবীরা। রসদ সংকট ও তীব্র ক্ষুধায় এই অসম লড়াইয়ে দেশপ্রেমী বিপ্লবীরা একে একে শাহাদাতের অমীয় শুধা পান করতে থাকেন। হাবিলদার রজব আলী সহ তিন বা চারজন সিপাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ইংরেজ বাহিনীর অব্যাহত অনুসরনের মুখে তারা গহীন পাহাড়ী জঙ্গলে হারিয়ে যান। লোকচক্ষুর অন্তরালেই একসময় হাবিলদার রজব আলীর জীবনের সমাপ্তি ঘটে। কোথায় চট্টগ্রামের এই সূর্যসন্তানের মৃত্যু হয়েছে তা আজো জানা যায়নি।
ইতিহাসে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা হলেও কোন অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়ে যান চট্টগ্রামের এই বীর কেশরী বিপ্লবী হাবিলদার রজব আলী খান। যে দেশমাতৃকার জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন দুঃখের কথা হলো সেই দেশেই বিস্মৃতির অতলে, মানুষের অগোচরে বীর হাবিলদার রজব আলী খাঁন। জাতি যদি আমাদের জাতিসত্তার শেকড়স্বরুপ এই মহানায়কদের যদি ভুলে যায় এ জাতি শিখরে পৌঁছাতে পারবে তো?
রেফারেন্সঃ
১) হাবিলদার রজব আলী — এ.কে এম মহিউদ্দিন (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)
২। Rare 1857 reports on Bengal uprisings | Times of India.
৩। সত্যেন সেন: মহাবিদ্রোহের কাহিনী
৪। The Political History of Muslim Bengal: An Unfinished Battle of Faith | Mahmudur Rahman
৫। মাস্টারদা সূর্য সেন ও সূর্যসাথীরা- জামাল উদ্দিন,
৬। ঢাকায় সিপাহী বিদ্রোহ, অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ |
৭। হাবিলদার রজব আলী ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম- মুনশী আবদুল মান্নান,
৮। বৃটিশ বিরুদ্ধে সেদিন চট্টগ্রাম সেনা নিবাসে দাবানল জ্বেলেছিলেন হাবিলদার রজব আলী খাঁ – মুহাম্মদ মাহমুদুর রহমান,
৯। হাবিলদার রজব আলী খাঁ ও তাঁর সংগ্রামী জীবনের নানা কথা,মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম, কবি, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যম কর্মী।
১০। হাবিলদার রজব আলী ও অধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম- মুনশী আবদুল মান্নান
১১। জাতীয় সংগ্রামের মহানায়ক হাবিলদার রজব আলী, জিয়া হাবীব আহ্সান, দৈনিক সংগ্রাম, নভেম্বর ১১,২০২২
ইতিহাসের নানা জানা-অজানা তথ্যাদি জানতে ও জানাতে যুক্ত হোন আমাদের পেজ ইতিহাস অন্বেষণ’ এ
সংগৃহীত