একটা বড় দল নিয়ে ফি বছর ঘুরতে যাওয়ার মত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাননীয় Kunal Ghosh সহ পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় টিম স্পেনে গেল নাকি বিনিয়োগ আনতে

একটা বড় দল নিয়ে ফি বছর ঘুরতে যাওয়ার মত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাননীয় Kunal Ghosh সহ পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় টিম স্পেনে গেল নাকি বিনিয়োগ আনতে । ইউরোপের পিছনের সারির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে স্পেন নাকি এদেশে বিনিয়োগ করবে । এর আগে প্রতিবছর শিল্প সম্মেলন বসিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনার নাটক করেছেন ঠিক যেমনটি করতেন বাম আমলে ।

বরং একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক । এই রাজ্য থেকে পুঁজির চলে যাওয়া থেকে শিল্পে ব্যাপক রুগ্নতা নিয়ে দু-চার কথা বলার প্রচেষ্টা করছি ।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে বা অঞ্চলের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে প্রধানত বাম আমল থেকেই অবক্ষয়টা শুরু । ১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৮৬-৮৭ সাল পর্যন্ত তথ্যে দেখা গিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গের N.S.D.P তে উৎপাদনকারী শিল্পের অবদান ১৯৭৫-৭৬ সালে ১৫.৬৬ শতাংশ থেকে ১৩.৯৬ শতাংশে নেমে এসেছে । এদিকে ঐ একই সময়ে মহারাষ্ট্র বা গুজরাটের উৎপাদনকারী শিল্পের অবদান গোটা সময় ধরেই বৃদ্ধি পেয়েছে । বিশেষ করে সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে এই অবনতি ঘটেছে আরও উঁচু হারে । বৃহৎ শিল্পে লাভের সম্ভাবনাও ( Profitability) কমেছে আশির দশক জুড়ে , আর আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নয়ের দশক ধরলে লাভের সম্ভাবনা নেগেটিভ অর্থাৎ সম্পূর্ণ অলাভজনক পরিস্থিতি ।

১৯৭৩-৭৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ ‘ Gross Output Per Factory’ -র হিসেবে মহারাষ্ট্রের সমপর্যায়েরই ছিল , কিন্তু তার পনেরো বছরে এমনই পিছিয়ে পড়ে যে ১৯৯০-৯১ সালের পরিসংখ্যানে এই হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মূল্য মহারাষ্ট্রের অর্ধেক আর ১৯৯৯-২০০০ এক তৃতীয়াংশ হয়ে গিয়েছে । এছাড়া আর একটি প্রবনতা উঠে এসেছিল তাহল স্ট্রাইক বা লক – আউট । আশির দশকের গোড়ার থেকে ‘ লক-আউট‘ -এর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল । ” Whatever be the reason for industrial dispute and whatever be the form ( strikes or lockouts) the consequent number of man days lost is significantly rising over time.”

ইলেকট্রনিক্স শিল্প সম্বন্ধে গবেষনায় দেখা যায় যে , “ West Bengal has been steadily losing its relative position , in terms of electronic goods production , since, say, 1977“

একই ভাবে রেশম শিল্পেও পশ্চিমবঙ্গ শুরু থেকে দেশের দ্বিতীয় রেশম উৎপাদনকারী হিসেবে থাকলেও তার অবস্থান কাজে লাগাতে পারেনি বাম আমলে । এই শিল্প প্রধানত গ্রামাঞ্চলে , এতে ভালো কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে আর লাভের হারও ভালো । কিন্তু কর্নাটক , তামিলনাড়ু, অন্ধ্রের তুলনায় এই শিল্প পুঁজিই আকর্ষন করতে পারলো না পশ্চিমবঙ্গে আর নব্বইয়ের দশকে পৌছে আরও ভয়াবহ অবস্থা । “ West Bengal is losing its export markets to other states. On the other hand, the low graded materials not being proportionally cheaper fail to have expanded domestic market.”

ক্ষুদ্রশিল্প নিয়ে পরিসংখ্যানে সমস্যা থাকলেও মুখার্জী এবং অন্যান্য ( Robin Mukherjee, Pranab Kumar Das and Uttam Bhattacharya : Small – Scale Industries in West Bengal, 1971-97 : Data Analysis for Study of Growth : Economic & Political Weekly , November 27, 1999 ) ১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৯৬-৯৭ পর্যন্ত একটি Statistical Series তৈরি করে তার ফলাফল প্রকাশ করেন । তাঁরা লক্ষ্য করেন এই শিল্পে ( কুটির + ক্ষুদ্র ) কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার বরাবরই সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি হারের থেকে কম । অন্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করতে গেলে দেখা যায় যে বৃদ্ধির হারে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ভয়াবহ মাত্র ২.৬ শতাংশ যেখানে সারা ভারতে গড় বৃদ্ধির হার ৭.৬৯ শতাংশ ।

ক্ষুদ্রশিল্পের ছবিটি যদি সংগতিহীন হয় তবে সংগঠিত শিল্পের ক্ষেত্রে তা বিপর্যয় । ১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৯৯-২০০০ পর্যন্ত গোটা সময় জুড়েই ভারতের ‘ Total Industrial Output’ বা শিল্পের উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের ভাগ , সে ‘ Value Of Output’ বা ‘ Net Value Added ‘ যেভাবেই মাপা হোক না কেন , ক্রমাগতই কমেছে ।

সংগঠিত শিল্পে কর্মসংস্থান ( Total Employment ) ১৯ শতাংশ কমে গিয়েছে অথচ ঐ এক সময় সারা দেশে শিল্পে কর্মসংস্থান বেড়েছে ২৮ শতাংশ । Manual Worker বা ‘ অদক্ষ শ্রমিক’ -এর কর্মসংস্থান হার আরও বেশী হারে কমেছে — পশ্চিমবঙ্গে কমেছে ২২ শতাংশ হারে দেশে বেড়েছে ২৬ শতাংশ হারে ।

অর্থাৎ দীর্ঘ বাম শাসনে পশ্চিমবঙ্গবাসীর প্রাপ্তি ছিল বেকারত্ব — বিনিয়োগকারীরা যে শুধু নতুন লগ্নী করতে রাজি হয় নি তা নয় , তার লগ্নী তুলেও নিয়েছে । বিরাট সংখ্যক উদ্যোগপতিদের কাছে পশ্চিমবঙ্গ আর বিনিয়োগের সম্ভাব্য স্থান বলেও গ্রাহ্য করা হত না আর সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে । শিল্পে একদা শীর্ষস্থানীয় এই রাজ্য বাম শাসনে যে একেবারে তলানিতে এনে ফেলেছিল সেখান থেকে আজও উঠে দাঁড়াতে পারে নি ।

এই সমাজ ব্যবস্থা সিপিএম তৃণমূল কে দিয়ে গিয়েছে । মমতার তো আর বাংলাকে গড়ে তোলার দূরদৃষ্টি ছিল না ফলে সিপিএম তাড়ানো ছাড়া তৃনমূলের আর কোনো এজেন্ডা ছিল না , ছিল না আর কোন প্রতিশ্রুতিও । তাই তৃণমূলও একই জিনিস করবে , এটাই স্বাভাবিক । তৃনমূল দলটার কোন Vision নেই । ন্যুনতম সরকার চালানোর পারদর্শিতা নেই । একটা পরীক্ষা ঠিকঠাক নেওয়ার দক্ষতা নেই । এরা হচ্ছে basically bunch of hoodlums যারা গর্ভনেন্সই বোঝে না , বোঝার দরকারই পড়ে না । এদের পক্ষে গঠনমূলক কিছু করাই সম্ভব নয় । তবে ৩৪ বছর ধরে কমিউনিস্ট শাসনের পর ১২ বছরের তৃণমূল শাসনে পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত ট্রাজেডি এই বিনিয়োগকারীরা যে শুধু এখানে লগ্নি করতে অনিচ্ছুক তাই নয় , বিরাট সংখ্যক উদ্যোগপতিদের কাছে , তাঁরা দেশীই হোন কি বিদেশি , পশ্চিমবঙ্গ আর বিনিয়োগের সম্ভাব্য গন্তব্য বলেই গ্রাহ্য হয়না । এই একদা শীর্ষস্থানীয় রাজ্য বিনিয়োগ ও উদ্যোগের প্রতিযোগিতা হার মানছে তো বটেই , উপরন্তু বহু নতুন শিল্পোদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ প্রতিযোগীই নয় । প্রত্যাখ্যাত হওয়ার চেয়েও মন্দভাগ্য যদি কিছু হয় , তা নিশ্চয় বাকি দেশ ও বিশ্বের দ্বারা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে যাওয়া ।

সৌভিক রাতুল বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.