অনেক পুরোনো দিনের কথা | বিএ পাশ করে হরিণাভির একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন এক তরুণ | একদিন ক্লাসের ফাঁকে স্টাফরুমে বসে আছেন, হঠাৎ একটি অল্পবয়সি ছেলে এসে বলল, চলুন,আমরা দু’জনে মিলে একটা বই লিখি।

সেই তরুণ শিক্ষক মনে মনে হাসলেন | ভাবলেন বই তো দূর অস্ত, কোনও দিন কোনও গল্প, প্রবন্ধ লেখার কথাও তাঁর মাথায় আসেনি | এই ভেবে ওই অল্পবয়সি ছেলেটিকে বারণ করে দিলেন তিনি |

সেই ছেলেটিও ছাড়ার পাত্র নয় | পরের দিন স্কুলে পৌঁছে সেই শিক্ষক দেখেন, যেখানে-সেখানে সাঁটা বিজ্ঞাপন |‘‘শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে….শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে উপন্যাস।’’ সেই শিক্ষকের বুঝতে বাকি রইল না এটা কার কাজ ! মনে মনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি | একবার হাতে পেলে হয় সেই ছেলেকে | অন্যদিকে সহকর্মীদেরও চোখে পড়ল সেই বিজ্ঞাপন | অনেকেই তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, বাঃ, মশাই! আপনি তো বেশ গোপন রসিক দেখছি। তা কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস?

কিছুক্ষণ পরেই সেই শিক্ষকের সাথে হঠাৎ দেখা সেই ছেলেটির | ছেলেটাকে কার্যত কলার চেপে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এইসব রসিকতার মানে কি ? কোন প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেয় সে এ সব করল ! তাতে ছেলেটি একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলেছিল, ভেবেছিলাম দু’জনে মিলে লিখে ফেলব, আর উপন্যাসের নামও ঠিক করে ফেলেছি – ‘চঞ্চলা’ | তার এই ভাবলেশহীন উত্তরে আর কিছু বলতে পারেননি শিক্ষক মশাই |
এদিকে রোজই রাস্তায়, বাজারে, স্কুলে, সকলের একই প্রশ্ন— কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস ? কাউকে বলতে পারছেন না যে উপন্যাস তো দূর অস্ত, এমনকী তিনি যে আদৌ লেখক নন, বিজ্ঞাপনটা পুরো মিথ্যে |

একদিন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল শিক্ষকের | রাতে রাগের চোটে কাগজ-কলম নিয়ে বসে একটি ছোট গল্প লিখলেন। পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার একটি মাসিক পত্রিকায় | পত্রিকার নিয়ম অনুযায়ী সঙ্গে একটি ঠিকানা লেখা খাম স্ট্যাম্প সেঁটে পাঠালেন |

তিন দিন পর থেকেই অপেক্ষা। দুরু দুরু বুকে স্কুলে বসে ভাবছেন এই বুঝি খাম ভর্তি অমনোনীত গল্প ফেরত এল | প্রায় সপ্তাহ তিনেক পর সেই খাম এল | দেখামাত্র তিনি খামটা পকেটে চালান করে দিলেন | রাতে বাড়ি ফিরে খুললেন সেই খাম | পেলেন একটি চিঠি | সম্পাদক মশাই লিখেছেন, “আপনার রচনা মনোনীত হয়েছে, শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।”

১৩২৮, মাঘ মাসের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সেই গল্প | সেটি ছিল তাঁর প্রথম গল্প | নাম ‘উপেক্ষিতা’। এই গল্পটি সেই বছর শ্রেষ্ঠ গল্পের পুরস্কারও ছিনিয়ে নেয়।

পরবর্তীকালে সেই শিক্ষক তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ছেলেটি (সেই ছেলেটির আসল নাম ছিল যতীন্দ্রমোহন রায়) বোধহয় ঈশ্বরের দূত হয়ে সে দিন তাঁর কাছে এসেছিল। ওই বিজ্ঞাপন কাণ্ডটি না ঘটলে তিনি কোনও দিন লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না |

চিনতে পারলেন সেই শিক্ষককে ?
পরবর্তীতে তিনিই লিখেছিলেন পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ‍্যক, ইছামতী, অশনি সংকেত, চাঁদের পাহাড়, সুন্দরবনে সাতবছর, মেঘমল্লার প্রভৃতি বিভিন্ন কালজয়ী গ্রন্থ |

তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় | বাংলার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক | জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য |

© অহর্নিশ
তথ্য : অচেনা বিভূতি (আনন্দবাজার পত্রিকা)
ছবি – সহধর্মিণী রমা দেবীর সঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঁচটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস সংগ্রহে রাখার মত বই । এই বইতে একসাথে পাবেন পথের পাঁচালী , দেবযান, অপরাজিত, আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল এই পাঁচটি উপন্যাস ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.