একদিন এই গেটে এসে থেমে গেছিলেন বিভূতিভূষণ। যেখান থেকে যতটা পারেন যোগাড় করে লক্ষ্মীর ঝাঁপির সিঁদুরমাখা শেষ টাকাটিও বালক বিভূতির হাতে তুলে দিয়ে মা শহরের স্কুলে ছেলেকে পাঠিয়েছেন। ইছামতির ধার ধরে বনবাদাড় পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে এসে বিভূতিভূষণ পৌঁছলেন আট কিলোমিটার দূরের এই শহরে। জানেন, যে টাকা কাছে আছে, তা দিয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। তবুও গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন বিভূতিভূষণ।
জানিনা সেদিনও আজকের মত বৃষ্টি হয়েছিল কিনা। কিন্তু বালক বিভূতিভূষণ কিছুতেই গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকতে পারলেন না। কয়েকবার স্কুলের চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ালেন, কিন্তু স্কুলের ভিতরে ঢুকতে দ্বিধাবোধ করলেন। একসময় সেদিনকার মত ফিরে গেলেন বিভূতিভূষণ। বাঁশবাগান নদীরচর ঝোপজঙ্গলের ঘ্রাণ নিতে নিতে হেঁটেই শ্রীপল্লী বারাকপুরের বাড়িতে ফিরে আসলেন বিভূতিভূষণ।
পরের দিন আবার গেল বালক। বনগাঁর বড় স্কুলে সে ভর্তি হবেই। কত বড় এল প্যাটার্নের বিল্ডিং! কত ঘর তাতে! আগের দিন গিয়ে ঘুরে ঘুরে সে সব দেখে এসেছে। কিন্তু আজকেও স্কুলের ভিতরে ঢোকার সাহস পেল না বিভূতি। তার কাছে পুরো টাকা নেই যে!
পরের দিন তৃতীয়দিন। আবার আসলেন বিভূতিভূষণ। হেঁটে হেঁটে। তাঁর প্রিয় নদীতীর ধরে। সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছে, আজকের মত। সাহস করে গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। অতটুকু ছেলে সঙ্গে কোনও গার্জেনও নেই, একা একা ভর্তি হতে এসেছে। গেট পেরিয়ে ডানদিকে গিয়ে যে পলাশগাছটা ফুল ফুটে লাল হয়ে থাকে, তার তখনও জন্ম হয়নি। একজন মানুষ একটা ছেলেকে এদিকে ওদিকে ঘুরতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন যে সে কোথায় যাবে। ভর্তি হতে গেলে কোথায় যেতে হয় বিভূতি জানতে চাইলেন। সব কিছু শুনে তিনি দেখিয়ে দিলেন। বিভূতিভূষণ ভর্তি অফিসে গিয়ে পৌঁছলেন। টাকা কম পড়লো। লক্ষ্মীর ঝাঁপির সিঁদুরমাখা টাকাতেও কুলায় না অ্যাডমিশন ফিস্। এমন সময় সেই ভদ্রলোক সেখানে আবার আসলেন। দেখলেন ছেলের এত পড়ার ইচ্ছা যে শেষ টাকাটাও নিয়ে চলে এসেছে। নিজের পকেট থেকে বাকি টাকা দিয়ে বিভূতিভূষণকে নিজের স্কুলে ভর্তি করে নিলেন হেডমাস্টারমশাই চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
কয়েকদিন আগেই ছিল বিভূতিভূষণের জন্মদিন। ইছামতি, নিশ্চিন্দিপুর, অপু দুর্গা অনেকেরই জন্মদিন। আজ বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা ভিজে কালো হয়েছে অ্যাসফাল্ট। বহুবছর আগে যে গেট থেকে ফিরে গেছিলেন বিভূতিভূষণ আজ সেই প্রবেশদ্বার নতুন করে সেজে উঠলো। নাম হল তাঁর নামে। যাঁর হাত ধরে এই কাজ হল তিনি বর্তমান হেডমাস্টারমশাই কুণাল দে।
এই বিভূতিভূষণ গেট খুলে যাক। ভিতরে দুরুদুরু বুকে ঢুকে পড়ুক আজকের বিভূতিভূষণ। যুগে যুগে হেডস্যারেরা হয়ে উঠুন এক একজন চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় | বাংলার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক | জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য |
জয়দীপ